শিউল মনজুর॥ এ সমাজে ধর্ণাঢ্য মানুষের সংখ্যা কম নয়। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন এদেশে লক্ষাধিক কোটিপতি রয়েছেন। সংখ্যাটি একেবারে কম নয়। একটি উন্নয়নশীল দেশে এসংখ্যাটি কিন্তু অনেক বেশি। অথচ এখনো এদেশের আনাচে কানাচে এমনকি শহরের অলিতে গলিতে রেল কিংবা হাইওয়ের আশে পাশে লক্ষ লক্ষ লোকের অমানবিক জীবন যাপন দেখে চোখে জল চলে এসে যায়।
কিন্তু যাদের চোখে জল আসার কথা তাদের দেখারও সময় নেই। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও তাদের দৃষ্টি সমাজের রঙিন ক্যানভাসেই শুধু আবর্তিত হয় না অথবা সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার জন্যই শুধু সময়কে ব্যয় করেন না, তারা অন্তরদৃষ্টি মেলে দিয়ে দিব্যদৃষ্টি মেলে দেখেন, পথ চলেন। তাঁদের চোখেই শুধু সমাজের অমানবিক দৃশ্যগুলো ক্যামেরাবন্দীর মতো হৃদয়ে গেঁথে যায়।
তারা ভাবেন, শুধুমাত্র নিজেকে এগিয়ে নিলে হবে না। সমাজের নিঃস্ব অসহায় মানুষগুলোকেও এগিয়ে নিতে হবে। নিজেরা শুধু আলোকিত হলে হবে না, সমাজকেও আলোকিত করতে হবে। নিজেরাই শুধু স্বাবলম্বী হলে চলবে না আশপাশের মানুষগুলোকেও স্বাবলম্বী হবার পথ দেখাতে হবে। এ রকম মানবিক চিন্তা কয়জনে করে? অর্থ আছে বিত্ত আছে কিন্তু চিত্ত নেই- এ রকম মানুষের সংখ্যাই তো বেশি।
সিলেট বিভাগে বিত্তশালী মানুষের সংখ্যা অসংখ্য। এর মধ্যে গুটি কয়েক মানুষ, সমাজ পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন, এর মধ্যে সিলেটের নয়া সড়কে বসবাসকারী মিনারা বেগম একজন। তিনি মানবিক দৃষ্টি সম্পন্ন একজন বড়মাপের মানুষ। মাদার তেরেসা কিংবা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো তিনিও দুঃস্থ অসহায় অশিক্ষিত সমাজের নারী সমাজকে এগিয়ে নেবার প্রত্যয় নিয়ে দীর্ঘদিনযাবত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এবং বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে তিনি সমাজের দরিদ্র নারী গোষ্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
তাঁর এই প্রচেষ্টা অত্যন্ত আনন্দের এবং ভীষণ ভালো লাগার। শুধুমাত্র অসহায় নারী সমাজকেই নয়, ছিন্নভিন্ন পথ শিশু থেকে শুরু করে সমাজের দরিদ্র পরিবারকেও সাধ্যমতো মিনারা বেগম নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন যা এরকম সময়ে বিরল ঘটনাই বলা চলে।
সম্প্রতি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে এই বহুগুণ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব মিনারা বেগমের সাথে পরিচয় ঘটে। তারপর তাঁর কার্যক্রমের কথা শুনে মুগ্ধ হই, অভিভূত হই। যেখানে তাঁর স্বামী পরলোকে সেখানে নারী হয়ে একক প্রচেষ্ঠায় প্রতিকুল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে অসহায় নারী সমাজের ভাগ্য পরিবর্তনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, যা প্রশংসার চেয়েও অনেক অনেকগুণ বেশি।
সমাজ পরিবর্তনে তাঁর দীর্ঘকাজের পরিধি অবলোকন করে আমার নিকট মনে হয়েছে তিনি নিবেদিত প্রাণ একজন মানুষ যিনি আলোকিত সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সকাল সন্ধ্যা কাজ করে যাচ্ছেন। এক কথায় তিনি যে, আলোকিত সমাজ গড়ার ফেরিওয়ালা তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
অবহেলিত শিক্ষা বর্হিভূত সমাজের নিম্ন আয়ের নারী সমাজকে নিয়ে প্রথমে চিন্তা করেন। তাঁর চিন্তায় আসে এসব নারীকে যদি শিক্ষার কিঞ্চিত আলো দেয়া যায় তাহলে তাঁদের সন্তানকে তারাই আগ্রহ সহকারে শিক্ষা অর্জনের জন্যে স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় পাঠাবে। এ লক্ষে তিনি পূণ্যভূমি সিলেটে ১৯৯৮ সালে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে গড়ে তুলেন, বয়স্ক নারী শিক্ষাকেন্দ্র। এই শিক্ষা কেন্দ্রটি বা প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ ইং পর্যন্ত চালু ছিল।
এখান থেকে সমাজের অসংখ্য অশিক্ষিত নারী স্বাক্ষর জ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষার গুরুত্ব বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়। প্রায় কয়েকশত অবহেলিত অশিক্ষিত নারী এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার আলো নিয়ে তাঁদের পরিবারকে শিক্ষায় দীক্ষিত করার অনুপ্রেরণা অর্জন করে।
শিক্ষার পাশপাশি নারীরা যাতে কর্মক্ষম হয়ে ওঠে সে জন্যও কাজ করেছেন। তিনি সিলেট শহরের অসংখ্য বস্তিবাসী নারীকে টেইলারিং পেশায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষে বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। এখান থেকে এ পর্যন্ত কয়েকশত নারী টেইলারিং পেশায় দক্ষতা অর্জন করে স্বাবলম্বী হয়ে স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করছে। সেই সাথে অনেকে গার্মেন্টস কারখানায়ও কাজ করে সম্মানজনকভাবে জীবিকা উপার্জন করছে। যা আমাদের সমাজের জন্যে অত্যন্ত ইতিবাচক।
১৯৮৬ সালে মিনারা বেগম, সিলেট শহরের নয়াসড়কে সর্ব প্রথম বিউটি পার্লার, সাজ বিউটি পার্লার স্থাপন করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করতে গিয়ে তৎকালীন সময়ে তাঁকে ধর্মীয় গোড়া ব্যক্তিদের বিরূপ সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি এতে দমে যাননি বরং আরো সাহস নিয়ে সাজ বিউটি পার্লারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে সাজ বিউটি পার্লার প্রতিষ্ঠার প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে। বিউটি পার্লারের মাধ্যমে তিনি শুধু ব্যবসা করে মুনাফা উপার্জন করার চিন্তা করেন নি। বরং এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গত ৩০ বছরে সহস্রাধিক তরুণীকে বিউটি পার্লারের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
এই সব তরুণীরা অনেকেই আজ সিলেট শহরের উপর অথবা পৌরসভা ও উপজেলা শহরে বিউটি পার্লার স্থাপন করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করে স্বাবলম্বি হয়ে উঠছে। বর্তমানে সিলেট শহরেই প্রায় তিন শতাধিকের উপর বিউটি পার্লার রয়েছে। যার পথিকৃৎ নয়া সড়কের সাজ বিউটি পার্লার এবং এর পুরো কৃতিত্ব আলোকিত সমাজ গড়ার ফেরিওয়ালা মিনারা বেগমের। ব্যবসা স্থাপনে তিনিই যে নারীদের মধ্যে প্রথম উদ্যোক্তা ও অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন তা অনস্বীকার্য।
মিনারা বেগম মিনারের মতই সাহসী ও উদ্যমী। কিন্তু কার্যক্রমে মহৎ একজন সাদাসিদা রমণী। এই মহতী সদালাপি রমণী মিনারা বেগম সিলেট জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাথেও জড়িত। খেলাধুলায় সিলেট অঞ্চলের মেয়েরা যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে মেয়েদেরকে অনুপ্রাণিত করার কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি নিজেও এক সময় ব্যাডমিন্টনের ভালো খেলোয়াড় ছিলেন।
এই মহতী রমণীর জন্ম ও বাড়ি সিলেটে। সিলেট শহরের উপশহরে তাঁর পৈতিৃক নিবাস। পিতা মরহুম মশাহিদ আলী চৌধুরী ছিলেন সরকারী চাকুরীজীবি এবং মা ওলিউন্নেছা ছিলেন সফল গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে মিনারের ষষ্ট। তাঁর বড় বোন ডা. আনোয়ারা খাতুন সিলেটের একজন বিশিষ্ট গাইনি বিশেষজ্ঞ। অন্যান্য ভাইবোনও সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তিনি নিজে অল্প বয়সে সংসার জীবনে প্রবেশ করায় উচ্চ শিক্ষায় ডিগ্রি অর্জন করতে না পরলেও ভারতের কলকাতা থেকে বিউটিশিয়ানের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী মিনারা বেগমের বিয়ে হয় ১৯৭৭ সালে। তাঁর স্বামী মিসবাহুল মান্নান (আফতাব) বিমান বাহিনীতে কাজ করতেন এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বামী মিসবাহুল মান্নান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পাশাপাশি তাঁর স্বামী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক সংগঠন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন। ২০০৪ সালে তাঁর স্বামী ইন্তেকাল করেন। মিনারা বেগমের সন্তানেরা সবাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী।
মিনারা বেগমের কর্মময় জীবনের গল্প লিখে গেলে উপন্যাসের মতই দীর্ঘ হবে। মিনারা বেগম বাধা ও প্রতিকুলতার প্রাচীর ভেঙে এ অঞ্চলের মেয়েদের এগিয়ে নিতে আজও সচেষ্ট ও আন্তরিক। তিনি ভারত, ইংল্যান্ড, দুবাই, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ সফর করেছেন। এই সব দেশ সফরের মধ্যদিয়ে তিনি নারীদের এগিয়ে যাবার যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা নিজ দেশে কাজে লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বিভিন্ন সামাজিক ও নারী সংগঠনের সাথে মিনারা বেগম ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। তিনি বৃহত্তর পার্লার ওনার এসোসিয়েশনের সভাপতি, বাংলাদেশ ওম্যান চেম্বারের সদস্য, বাংলাদেশ ওম্যান বিজনেস ফোরাম সিলেট শাখার সদস্য, লায়ন্স কাব অব হলিল্যান্ডের সেক্রেটারী এবং প্রাক্তণ রোটারিয়ান ও রোটারী কাব জালালাবাদ এর সাবেক সদস্য।
এই বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে মিনারা বেগম কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ অসংখ্য পদক অর্জন করেছেন। তবে তাঁর মতো সফল নারীকে জাতীয়ভাবে মূল্যায়ণ অতি জরুরী। আমি এই মহতী রমণীর দীর্ঘ জীবন ও আরো আরো অনেক সাফল্য কামনা করি।