এম. আবু সিদ্দিক, ভোলা ॥ চারদিকে নিবিড় কালচে সবুজের সমারোহ। দূর থেকে চোখে পড়বে অস্পষ্ট বনরেখা। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সে রেখা কখনও ঢেউ খেলানো কখনও সমতল। ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে। অস্পষ্ট কুয়াশার রেশ কাটতে না কাটতেই সূর্যরশ্মির বর্ণচ্ছটা মেঘনার বিশাল বুকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ক্রিস্টালের মত স্বচ্ছ হয়ে। ভোলা জেলার সর্বশেষ স্থল সীমা চর কচ্ছপিয়া থেকে চোখে পড়বে এই দিগন্তবিস্তৃত চোখজুড়ানো সবুজের বিশাল আয়োজন। কচ্ছপিয়া বেড়িবাঁধের উপর দাঁড়ালে একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠবে টুকরো টুকরো বনভূমি। সে বনভূমি ঘিরে আছে দিগন্ত বিস্তৃত মেঘনার অথৈ জলরাশি।
এ দ্বীপের বৃষ্টি সম্পর্কে সঠিক ঐতিহাসিকভাবে কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও জানা গেছে, ১৯১২ সালে এ দ্বীপের জন্ম। তৎকালীন জার্মান যুবরাজ প্রিন্স ব্রাউন জনমানবহীন এ দ্বীপে জাহাজ নিয়ে আসেন শিকারের উদ্দেশ্যে। দেখতে পান একটি বিড়াল ও কুকুর ছুটাছুটি করছে। সেই দৃশ্যাবলী তাকে মনে করিয়ে দেয় নির্জন এই দ্বীপের নামকরণ। পরবর্তীতে যার নামকরণ করা হয় কুকরী মুকরী।
জলদস্যু পর্তুগীজ ও ওলন্দজরা দস্যুবৃত্তি লুটতরাজ করে নির্জন দ্বীপে নিরাপদে আশ্রয় নিত। এই দ্বপকন্যাকে প্রকৃতির রুদ্ররোষ থেকে রক্ষা করতে সদ্য জেগে ওঠা চরগুলোকে সংরক্ষণের জন্য ১৯৪৭ সন থেকে উপকূলীয় এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে বনায়ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই কর্মসূচীই পরবর্তী সময়ে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প হিসেবে রূপলাভ করে।
নতুন সৃজিত বনসমূহ রক্ষণাবেক্ষনের জন্য শত শত কর্মকর্তা কর্মচারীকে দায়িত্ব প্রদানেসর মাধ্যমে একদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বঙ্গোপসাগরের অসীম শক্তিশালী বৈরী বাতাস আর জলোচ্ছ্বাস যাতে মানুষের জীবনকে তছনছ করতে না পারে সে জন্য এই বিশাল বনভূমি ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। প্রকৃতির সাথে মানুষের যুদ্ধে জেতার এ অসামান্য আয়োজন এ অঞ্চলের সাহসী অথচ সাধরণ মানুষকে অসীম প্রেরণা যোগাচ্ছে।
ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার চর কচ্ছপিয়ার দূরত্ব ভোলা সদর থেকে প্রায় ১২০ কিঃ মিঃ। কচ্ছপিয়ার বেড়িবাঁধে দাঁড়ালেই চরকুকরী-মুকরী এবং চরপাতিলার বিস্তৃত বনভূমির ছায়া চোখে এসে পড়বে। চরকচ্ছপিয়া থেকে কখনো আঁকা-বাঁকা খাল ও এখনো প্রশস্ত মেঘনার বুক চিরে যন্ত্রচালিত নৌকায় ১ ঘন্টা পথ কুকরী-মুকরী। ডিসেম্বরের নদী শান্ত পাটির মত বিছানো অথচ বর্ষা মৌসুমে এর ভয়ংকর চেহারা এ অঞ্চলে বসবাসরত সাহসী মানুষগুলোকেও ভয় ধরিয়ে দেয়্ যোগাযোগের মাধ্যমে একতলা যন্ত্রচালিত খেয়া নৌকা অথবা ট্রলার কুকরী-মুকরী যাওয়া যাবে দু’দিক থেকেই। কচ্ছপিয়া থেকে সরাসরি অথবা চরপাতিলার বুক চিরে ভাড়ানি খাল দিয়ে। এ খালের শেষপ্রান্ত মিলিত হয়েছে মেঘনার বিশাল বুকে। এখানে ধু ধু বালিয়াড়ির উপর দাঁড়ালে জোয়ারের সময় বঙ্গোপসাগরের একটা শোঁ শোঁ শব্দের সাথে জোয়ারের ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার ছন্দ দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাবে কক্সবাজার, নিঝুমদ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতের কথা।
এই দ্বীপের আকর্ষণীয় স্পটটির নাম ‘বালুর ধুম’। এখভান থেকে সরাসরি দক্ষিণ দিকে তাকালে দেখা যাবে ঢালচর। ঢালচরের পরই বঙ্গোপসাগর। ঢালচরেও নিবিড় বনের ছবি দেখা যাবে। ‘বালুর ধুম’ থেকে ডান দিকে বেরিয়ে গেলে এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে কুকরী-মুকরী পৌঁছা যাবে।
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাইনা আর’ প্রকৃতি প্রিয় কবি জীবনানন্দ’র এমন কাব্য পর্যটন এলাকা কুকরী-মুকরীকে নিয়েও করা যায়।
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হইতে শুধুদু’পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকু’র এই অভিব্যক্তি চরফ্যাসনের
উপকূলবর্তী দ্বীপ কুকরী-মুকরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
নৈসর্গিক সৌন্দর্য নয়নাভিরাম দৃশ্য, ম্যানগ্রোভ অরণ্য যে কোন পর্যটকদের সৌন্দর্যপিপাসু দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করবে। যা অনেকের কাছে এখনো অজানা। চরফ্যাসনে বসবাস করেও অনেকে জানেনা কুকরী-মুকরীর বালুর ধুম, কুয়াকাটা, কক্সবাজারের সাদৃশ্য দৃশ্যাবলী এখানেও বিদ্যমান। বালুর ধুম, পাতিলা অর্েয রয়েছে হাজার হাজার মায়াবী হরিণ, ছোট্ট নৌকায় চেপে ছোট্ট লেকে নিঃশব্দে নিশ্চুপে চলতে গেলে দেখা যাবে মায়াবী হরণের ছুটোছুটি। পরিবেষ্টিত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, সর্পিল লেক, বালুকাময় তীর, সি-বিচ, সামুদ্রিক নির্মল হাওয়া, তরঙ্গ গর্জন, সবই কুকরীর বালুর ধুমে। যা মনোমুগ্ধকর রূপসজ্জা আর প্রকৃতির লীলাভূমি। অন্যান্য দ্বীপের চাইতে কুকরী-মুকরী দ্বীপ অনেকটা সিভিলাইজড। এখানে অন্যান্য সৈকতের চেয়ে নৈসর্গিক সৌঃন্দর্য এবং বৈচিত্র বিদ্যমান।
সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুকরী-মুকরীকে নিয়ে এতদি.ন কেউ ভাবেনি। সম্প্রতি ইলেক্ট্রনিক্স সিভি মিডিয়ায় সম্প্রচারের পর এ দ্বীপ সম্পর্কে ভ্রমণ পিপাসুদের আকৃষ্ট করেছে। চরফ্যাসন এলাকার অনেকেই বাড়ির কাছে আরশী নাগর’র ঠিকানা আছে তা আগে জানত না। শীত মৌসুম থেকে কয়েকটি পিকনিক পার্টি বালুর ধুম এলাকায় গিয়ে স্বচক্ষে দেখে বর্ণনা করেছে এই আরশী নগরের কথা। ফলে কুকরী-মুকরী সম্পর্কে কৌতুহলের শেষ নাই।
এখানে একটি ইকোপার্ক প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আধুনিক সভ্যতায় পর্যটকরা আরো উজ্জীবিত হবে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবিত চর কুকরী-মুকরী ইকোপার্ক প্রকল্পে বাস্তবাযন হলে একুশ শতাব্দীর সমুদ্র বিলাসগামী পর্যটকগণ সভ্যতার সংস্পর্শে উজ্জীবিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলে পার্ক নির্মাণ হলে ভোলাবাসীর একটি দীর্ঘ দিনের দাবী বাস্তাবায়িত হবে।
চিত্তবিনোদন জীববৈচিত্র সংরক্ষণ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ৫টি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে চরকুকরী-মুকরীর ইকোপার্ক স্থাপন প্রকল্প ফাইল বন্দি অবস্থায় রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, বাগান সৃজন এবং জনবল নিয়োগসহ কুকরী-মুকরীতে ইকোপার্ক নির্মাণের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা রয়েছে।
এখানে প্রকৃতির নৈসর্গিক শোভাকে অবলম্বন করে ইকোপার্ক স্থাপনের স্বপ্ন দ্বীপবাসীর দাবী দীর্ঘ দিনের। লালিত স্বপ্ন এখন বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের প্রতিনিধির মাধ্যমে ইকোপার্ক নির্মাণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
ভোলা-৪ আসনের সাবেক এক এম.পি তৎকালীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালীন ৬ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে চর কুকরি-মুকরীতে ইকোপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের টাকা বরাদ্ধ করতে না পাড়ায় তা পরবর্তীতে বাতিল হয়ে যায়। জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে দ্বীপের সামগ্রিক উন্নয়ন, চিত্তবিনোদন ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে দেশী বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ এবং শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এ যাবৎ আলোর মুখ দেখেনি।
কুকরী-মুকরী ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আবুল হাসেম মহাজন জানান, প্রকৃতির লীলাভূমি বেষ্টিত অপরূপ সৌন্দর্যের দ্বীপ কুকরি-মুকরি। এই এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ্ আল ইসলাম জ্যাকব বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে কুকরি-মুকরিকে পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য তিন তারকা মানের হোটেল মোটেল, ৭ লক্ষ টাকায় পাখি পর্যবেক্ষন বিল্ডিং সহ শতাধিক কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করেছেন।
এ ছাড়া মন্ত্রী চরফ্যাসনকে জেলা ঘোষনার জন্যে গত ৭ বছরে চরফ্যাসন-মনপুরায় ২ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করে বরিশাল বিভাগে সেরা এম.পি হিসেবে ব্যাপক ভাবে আলোচিত হয়েছেন। কুকরি-মুকরিতে পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্র হলে দক্ষিণ ভোলার উপকূলবাসীসহ ভ্রমন বিলাসী পর্যটকদের মন উজ্জীবিত হবে এবং বিছিন্ন কুকরী-মুকরী দ্বীপটি লোকে লোকারণ্য হয়ে গতিশীল উন্নয়ন কর্মকান্ডে ভূমিকা রাখবে বলে সকলে আশাবাদী।
চরফ্যাসন প্রেসকাবের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মনির আহমেদ শুভ্র জানান, বরিশাল বিভাগে ভোলা-৪ আসনের উন্নয়ন ইতিহাসের এক মাইল ফলক অধ্যায়। চরফ্যাসন-মনপুরা এলাকাবাসী গর্বিত এই সংসদ সদস্যকে নিয়ে। কুকরি-মুকরি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা সময়ের ব্যাপার। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১০ কোটি টাকা বরাদ্ধে কুকরি-মুকরিতে থ্রি স্টার মানের ৩ তলা বিশিষ্ট আধুনিক রেস্ট হাউজ নির্মাণ কাজ চলছে। আগামী জুন নাগাত এই রেস্ট হাউজের কাজ সমাপ্ত হবে। আধুনিক এই রেস্ট হাউজে ৩০টি এসি রুম এবং সংশ্লিষ্ট স্থানে হেলিপ্যাড, ট্রেনিস ও সুইমিং পুল থাকবে। এই এলাকাবাসীর দাবী ব্যাপক উন্নয়ন করায় আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব কে মন্ত্রী সভায় পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়।
চরফ্যাসন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মনির উদ্দিন চাষী জানান, আর নয় কুয়াকাটা, নিঝুম দ্বীপ এবং কক্সবাজার। প্রকৃতি বেষ্টিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুকরী-মুকরীকে। অভয়ারণ্যের চমৎকার দৃশ্য চুম্বকের মতই আমাকে আকর্ষণ করছে। ভ্রমন পিপাসুরা একবার হলেও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিকে স্বচক্ষে ঘুরে আসুন। শীতের মৌসুমে বাজার ব্যবসায়ী সহ বিভিন্ন পেশাজীবি লোকজন কুকরী পর্যটন কেন্দ্রে বনভোজনে যাচ্ছে।
ভোলা-৪ (চরফ্যাসন-মনপুরা) আসনের এম.পি ও পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আলহাজ্ব আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ইতিমধ্যে কুকরী-মুকরীকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র করার জন্য কাজ শুরু করেছেন।
বর্তমান সরকার পর্যটন এলাকা হিসেবে কুকরী-মুকরীকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। জাতীয় সংসদ সদস্য এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এত সম্ভাবনা আর সৌন্দর্যকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা, অপরূপ দ্বীপকে নিয়ে আধুনিক একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলে ভ্রমন পিপাসুদের সুযোগ করে দিন। একবার হলেও ঘুরে আসুন স্বপ্নের দ্বীপ কুকরী-মুকরী। এ দ্বীপ নিয়তই ভ্রমন পিপাসুদের ভ্রমণে হাতছানি দেয়।