এক॥
বছরের বার মাসের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাস নানা কারণে আমার নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে ভাষার জন্য আমাদের বাংলার গর্বিত সন্তান সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, আউয়ালসহ অনেকে প্রাণ দিয়েছেন। আমরা তাঁদের জন্যে মায়ের ভাষায় কথা বলতে শিখেছি। আবার এই একুশের চেতনা আমাদেরকে স্বাধীনতা যুদ্ধে দারুণ রকম প্রেরণা দিয়েছে।
একমাত্র ভাষার জন্যে পৃথিবীতে এদেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছে, যে কারণে মনের ভেতর সব সময় একটা গর্ব অনুভব করি। এই একুশে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। আবার এই ফেব্রুয়ারির পুরোমাস বাংলা একাডেমির উদ্যোগে উদযাপিত হয় বই মেলা। বলা হয়ে থাকে প্রাণের মেলা।
সেই সঙ্গে ঋতু পরিক্রমায় এই মাসে শুরু হয় প্রিয় বসন্ত ঋতু। অনুষ্ঠিত হয় বসন্ত উৎসব। সেই সঙ্গে জাতীয় কবিতা পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত হয় জাতীয় কবিতা উৎসব। যেখানে দেশে বিদেশের অসংখ্য কবিরা এই উৎসবে যোগ দেবার জন্যে ছুটে আসেন। তখন নানা রঙে রঙিন হয়ে ওঠে আমাদের সময়। আবার এই মাসেই উদযাপিত হয় ভালোবাসা দিবস। সব মিলিয়ে উৎসব মুখরিত একটি মাস আমরা উপভোগ করি।
কিন্তু সব উৎসবকে ছাপিয়ে বই মেলাটা হয়ে ওঠে আমাদের নিকট সবার প্রিয় মেলা, বই মেলা। এই মেলাকে কেন্দ্র করে লেখক-পাঠক একত্রিত হন। বইয়ের সাথে মানুষের যে চিরকালের সুসম্পর্ক তা বইমেলার মধ্যদিয়ে জাগ্রত হয়। তাই বই মেলা ছোট বড় সবার নিকট প্রিয় একটি মেলা। এই মেলা শুরু হবার সাথে সাথে মনের ভেতর মেলায় ছুটে যাবার একটি প্রেরণা আপনা আপনি তৈরি হয়।
হয়তো লেখালেখির সাথে জড়িত বলেই কিনা জানি না। তবে যতদূর মনে পড়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্যে মফস্বল থেকে ঢাকায় আসার পথ তৈরি হবার পর থেকে প্রতিটি বই মেলায় অংশ গ্রহণ করেছি। কোন কোন বই মেলায় এমনও হয়েছে প্রতিদিন ছুটে গেছি মেলা প্রাঙ্গণে। সারাদেশ থেকে ছুটে আসা লেখকদের সাথে ভাব বিনিময় করেছি। নতুন নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ নিয়েছি।
মনে পড়ে আশি দশক থেকে বই মেলায় যাচ্ছি। কোন বই মেলায় যাইনি এ রকম মনে পড়ে না। প্রতিটি বইমেলায় গমণ করেছি। সাধ্যমতো নতুন নতুন বই কেনার চেষ্টা করেছি। এবার পারিবারিক ও সামাজিক কারণে বই মেলায় যেতে বিলম্ব হলেও শেষের দিকে এসে একটি সকাল ও একটি বিকেল বই মেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করে আনন্দের সাথে সময় কাটালাম।
দুই॥
মেলার ২৭তম দিন শনিবার, সকাল (২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬)
সকাল ১১টায় মেলা প্রাঙ্গনে প্রবেশ করি। শিশু প্রহর চলছে। ফাঁকাফাঁকা। বিকেলের মতো মানুষের ঢল নেই। অসংখ্য শিশুরা তাদের প্রিয় বিষয় আর প্রিয় লেখকদের বই কেনার জন্যে মেলায় ছুটে এসেছে। মনে হলো বই কেনার জন্যে এটাই উপযুক্ত সময়। আমিও প্রিয় লেখক বন্ধুদের বই কেনার জন্যে স্টলে স্টলে ঘুরতে থাকি।
এক সময় ঘুরতে ঘুরতে সিসিমপুর ক্যাম্পাসে এসে থমকে দাঁড়াই। কয়েকশত শিশু সিসিমপুরের গান শুনে শুনে একটি বটগাছকে কেন্দ্র করে সারিবদ্ধভাবে ঘুরছে। দৃশ্যটি ধারণ করার জন্য বিভিন্ন প্রাইভেট চ্যানেল ভিডিও করছে। আমিও সিসিমপুরের শিশুদের আনন্দ ক্যামেরা বন্দী করি।
তারপর আবারো ঘুরে বেড়াই মেলার এদিক ওদিক। ঘুরতে ঘুরতে কিনে ফেলি, কবি মামুন রশীদ এর টিটু মিলনায়তন ও ভূতের সঙ্গে একদিন, শিশুসাহিত্যিক, প্রকৃতি ও বিজ্ঞান মনস্ক লেখক ইব্রাহিম নোমান এর ভূতের ইশকুলে সেলফি, সুপরিচিত ছড়াশিল্পী আসলাম সানী এর প্রিয় বাংলদেশ, বিশিষ্ট ছড়াকার মাহমুদুল্লাহ এর রঙিন ঘুড়িসহ ছোটদের কিছু বই।
এক সময় তথ্য কেন্দ্র থেকে ঘোষণা এল মেলার ২৭তম দিনের এই পর্যন্ত মেলায় তিনহাজার তেত্রিশটি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। আবার বিকেল তিনটায় নতুন বইয়ের পরিচিতি নিয়ে হাজির হবার আশাবাদ ব্যক্ত করে তথ্যকেন্দ্রের ঘোষকরা বিদায় নিলেন। আমিও ঘুরতে ঘুরতে জল তৃষ্ণা আর ক্ষুধায় কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ায় আগামীকাল ফিরে আসার প্রত্যাশা নিয়ে মতিঝিলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি।
তিন॥
মেলার ২৮তম দিন, বিকেল (২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬)
বেলা ধীরপায়ে প্রবেশ করি মেলায়। তখন ঘড়ির কাটায় বিকেল পাঁচটা। কয়েকজন লেখক বন্ধুকে ফোন দিয়ে মেলায় আসার জন্যে অনুরোধ জানালে বললো, সন্ধ্যার পর আসবে। আমি আমার মতো একা একা ঘুরতে ঘুরতে সংগ্রহ করি কবি ওবায়েদ আকাশের পাতাগুলো আলো, আমার সবচেয়ে প্রিয় কথাসহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবেরের দূরের গল্প, শক্তিশালী লেখক আনিসুল হকের শ্রেষ্ঠ কিশোর গল্প, সুপরিচিত ছড়াকার শাহজাহান আবদালির শিশুতোষ বই কার ছেলে সেরা, বন্ধুবর বিশিষ্ট উপন্যাসিক সালাম সালেহ উদদীনের ব্যর্থ দিন ব্যর্থ রাত ও সেরা গল্প সংকলন, আরেক প্রিয়জন যার লেখার মধ্যে ভিন্ন স্বাদ খুঁজে পাই সেই সাহসী গল্পকার আলীম আজিজ এর কালো হরফের অশ্বারোহী এবং এবারকার মেলায় আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি দেশের সুপরিচিত কবি ও গল্পকার, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের খুব কাছের বন্ধু, যার সাথে এই জীবন চলার পথে অনেক স্মৃতি জড়িত সেই প্রিয় মানুষ চঞ্চল শাহরিয়ার তাঁর নতুন গল্প বই এতোদিন কোথায় ছিলেন আমাকে উৎসর্গ করেছেন। কবি বন্ধুর কাছে আমি ভালোবাসার ঋণে আবদ্ধ হয়ে গেলাম।
চার॥
এক সময় হাঁটতে হাঁটতে কান্ত হয়ে এলে মেলা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলা একাডেমির সামনে নিরিবিলি রাস্তায় বসে পড়ি। নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ নিতে নিতে ভাবতে থাকি এ বছর মেলার বয়স আর মাত্র একদিন। মেলার ২৯তম দিনে আমি হয়তো আসতে পারবো না। অথচ প্রিয় ও সুহৃদ অনেক লেখকের বই এখনো সংগ্রহের বাকি রয়ে গেছে। অবশ্য পকেটের অবস্থাটাও গড়ের মাঠ। এবছর মেলায় আর হয়তো কেনা হবে না। অন্য সময় প্রিয়জনদের বই সংগ্রহ করতে হবে।
হঠাৎ করে চোখের দৃষ্টিতে ধরা দিলেন কবি তোবারক আলী। তিনি মেলা থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছেন। আমি কবি বলে ডাক দিতেই তিনি আমার দিকে তাকালেন, আমিও বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালাম। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার পর ব্রাম্মণবাড়িয়ার ইতিহাস ঐতিহ্যের বই দেখিয়ে বললেন, নিজের জেলা ব্রাম্মণবাড়িয়া কিন্তু নিজের জেলা সম্পর্কে অনেক কিছু জানি না। তাই বইটি সংগ্রহ করা। কবি তোবারক আলীর এমন সহজ সরল উচ্চারণ আমাকে মুগ্ধ করলো। তিনি বললেন, দেখা হয়ে ভালো লাগলো, কাল আসলে দেখা হবে। আমি সালাম দিলাম, তিনি চলেন।
আমি আবার বিশ্রামের জন্যে বসে পড়লাম নির্দিষ্ট জায়গায়। কিন্তু বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকার টি২০ খেলা দেখার জন্যে মনটা বাসায় ফিরে যাবার জন্যে তাড়া দিচ্ছে। এমন সময় যায়যায়দিনের সাহিত্য সম্পাদক বিশিষ্ট উপন্যাসিক প্রিয়জন সালাম সালেহ উদদীনের সাথে দেখা। তারপর দুজন মিলে আবারো মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ। ঘড়ির কাটা আটটার কাছাকাছি। বই এর ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা ধীরে ধীরে মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়ছে। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বই মেলার প্রাঙ্গণ। এমন সময় আরো দুজন লেখকের সাথে পরিচয় ঘটে। একজন জহিরুল হক আরেক জন সুবির।
জহিরুল হক এর মেলায় নতুন বই এসেছে। কবি সুবিরকে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি তাঁর কোন বই বের হয়েছে কি না? একজন তরুণ লেখক ছবি তোলার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলে সবাই ক্যামেরাবন্ধী হবার জন্যে দাঁড়ালেন। তখন ছড়াকার শাহজাহান আবদালি ও হঠাৎ করে আসা কবি শেলী সেলিনা দাঁড়ালেন। ছবি তোলার পর্ব শেষ হলে, আগামিকাল কবি শেলী সেলিনা আমাদেরকে আপ্যায়নের প্রতিশ্রুতি দিলে সবাই তাঁকে ধন্যবাদ জানালেন। আর আমি মনে মনে ভাবলাম, হায় আমার হয়তো আগামিদিন আসা হবে না। আমি সবাইকে মিস করবো।
শিউল মনজুর কবি ও কথাসাহিত্যিক।