সারওয়ার বাবর চৌধুরী
ছেলেবেলায় রোজা মাসের একটা আলাদা আমেজ ছিল ! চারিদিকে একটা রোজা রোজা গন্ধ পেতাম ! সন্ধ্যেবেলা আর ভোররাতে সাইরেন বাজতো ! সাইরেন বাজতো দু’ভাবে ! একটা হতো ওয়ার্নিং আরেকটা ফাইনাল ! ওয়ার্নিং সাইরেন দিয়ে বোঝানো হতো, সময় ঘনিয়ে এসেছে, রেডি হও ! আর ফাইনাল বা চূড়ান্তটা দিয়ে বোঝানো হতো, সময় একেবারেই নেই ! শুরু করতে পারো ! সেই সাথে আজানতো কম্বলচারি !
ইফতারের সময় ‘ফাইনাল সাইরেনে’র সাথে সাথে রাস্তায় ‘পাহাইড়রা বরফ’! ‘পাহাইড়রা বরফ !’ বলে হাঁক ভেসে আসতো গলির মাথা থেকে ! তখন ফ্রিজ ছিল না অনেকের বাসায়! আমাদের বাসাতেও ছিল না ! ভিড় ঠেলে বরফ আনার ঝক্কি নেওয়া হতো না অনেক সময়ই ! আমি তো ছোট ! হুট করে আমার বাইরে বের হওয়াটা বারণ ছিল ! আব্বা কিংবা বড় ভাই…আমাদের দাদা, ও যদি আনতো, তাহলেই বরফ পানিতে শরবত খাওয়া হতো !
আর ভোররাতের আমেজটা যেন এখনো মনে সজিব-সতেজ হয়ে আছে ! ভোর রাতে খেয়ে দেয়ে আমাদের ওখানে (ধানমণ্ডি-১৫) সবাই বাইরে বের হয়ে যেতো ! এমনকি মেয়েদের অনেকেই জোট বেঁধে বের হতো ! মেয়েদের মধ্যে খালাম্মাদের যেমন একটি গ্রুপ ছিল তেমনি স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদেরও আলাদা গ্রুপ ছিল ! একই ভাবে ছেলেদের মধ্যে গ্রুপ ছিল কেবল জুনিয়র আর সিনিয়রগ্রুপ ! খালাম্মাদের বিপরীতে খালু বা পুরুষ অভিভাবকদের কোন গ্রুপ তখন বেরুতেন না ! এরা সবাই বের হতো যার যার বাড়ির সামনের আঙ্গিনায় বা মাঠে ! কেউ পায়চারি ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে গল্প করতো কেউ কেউ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গোল হয়ে বসে আড্ডা মারতো ! এই আড্ডাও হতো পূর্বকোন ফর্সা হওয়ার আগ পর্যন্তই!
তার আগে, ভোররাত শুরু হওয়ার আগেভাগেই আরেকটি কাণ্ড ঘটতো ! একদল ছেলে বাইরে বের হতো ! ওরা সব মেইনরাস্তা থেকে প্রত্যেক কলোনীর সামনের রাস্তায় এসে যেতো গলায় সুরেলা গান বেঁধে ! ‘রোজা রাখো ভাই ! সেহরীর সময় হয়ে..এলো ! রোজা রাখো ভাই !’ এইসব বলে বলে গান করতো ওরা ! ওই দলে আমার দাদাকেও দেখতাম ! দাদা সেই রাতভোরেই উঠে ওদের সাথে যােগ দিতো !
আসরের নামাজের পর ওদের দলনেতা আজাদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে রোজার গানগুলোর মহড়া দিতে হতো ! রাতেও ওই সময় ওদের হাতে বাদ্যযন্ত্রও থাকতো ! বেশ মধুময় লাগতো ! এলাকার আরেক বড় ভাই-আজাদ ভাইয়ের লেখা ও সুরে কয়েকজন মিলে গাইতো ওরা ওইসব প্যারোডি টাইপ গান ! আমি একদিন ওদের সাথে ভিড়তে চাইলে দাদা আমাকে বকা দিয়ে তাড়িয়ে দেয় ! যা ভাগ ! এখানে পিচ্চিরা আসবে না ! সেই জেদে আব্বাকে নালিশও করি ! বলি, দাদা পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে রোজ দু’বেলা বাইরে সময় নষ্ট করছে ! আশ্চর্য ! আব্বা আমার কথা যেন শুনতেই পাননি ! এমন একটা ভাব করলেন ! আসলে শুনেছেন ঠিকই ! দাদার এই কাণ্ডে আব্বার একটা মৌন সমর্থন ছিল ! তাই রেগে যাননি সাথে সাথে ! অন্য অভিযোগে আব্বা কী করেন তাও জানি ! আসলে আব্বাকেও তো কিছুটা বুঝতে পারতাম তখন ! কিন্তু এখনকার রোজা কার কেমন লাগে কে জানে !
আমার কিন্তু একেবারেই পানসে পানসে লাগে ! সাইরেনের শব্দ নেই ! রোজা রোজা গন্ধটি নেই ! তার উপর রাত আড়াইটা বাজলেই চতুর্দিকের মসজিদে মাইকে হুজুররা ইসলামী গান বাজনার নামে যা শুরু করেন.. একেবারে হুলস্থুল ব্যাপার ! ননস্টপ ! আমার অন্তত: একটুও ভালো লাগে না ! কান ধরে আসে ! এক কথা হাজার বার বলতে থাকেন ! এত ঘন ঘন ডাক তো আগেও দেওয়া হতো না ! বরং হঠাৎ হঠাৎ মসজিদ থেকে বলা হতো ‘আর মাত্র এত মিনিট বাকি আছে…ব্যস !’ অথচ এখন অ্যালার্ম বেল, মোবাইল, টেলিভিশন ইত্যাদি ঘরে ঘরে রয়েছে ! যার যখন ইচ্ছে উঠে যেতে পারেন ! অন্য কাউকে বলা লাগে না ! অনেকেই আছেন, ভোর রাত পর্যন্ত জেগেই কাটান ! তা সত্ত্বেও দুনিয়া কাঁপিয়ে হুজুরদের হাঁকডাক ! এদেশে মুসলমানদের সাথে সাথে অন্য ধর্মাবলম্বিরাও থাকেন ! তাছাড়া অনেকেই অসুস্থ থাকেন ! মাইকের শব্দ, গজল-গানের শব্দ তাদের কাছে কষ্টকর মনে হতে পারে ! কে শোনে কার কথা !
তারচে বরং এখন রমজানের আবহকে ধরে রাখতে চাইলে কেমন হয় !? টাইম করে সাইরেন ! টাইম করে রাস্তায় কোরাশ গানের আয়োজন ! করা যেতে পারে না ! কিন্তু কোরাশ গানেও এখন সমস্যা দেখছি ! কোরাশ গানের বিনিময়ে আগে কেউই বাড়ি বাড়ি গিয়ে পয়সা খুঁজতো না ! এখন অনেক এলাকায় বখাটে ছেলেরা সেই আবহ সৃষ্টির নামে হৈহুল্লোর করে বলে শোনা যায় ! এরা পড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলে ! ঈদের বখশিসের নাম দিয়ে ! এই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে জুয়া-জোচ্চুরি, খুনখারাবির ঘটনাও ঘটতে শুনেছি ! হায়রে ! আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা…
সারওয়ার বাবর চৌধুরী: সাংবাদিক