মুহম্মদ জাফর ইকবাল
যেমন ধরা যাক গণতন্ত্র নামের বিষয়টা। সারা জীবন শুনে এসেছি, জেনে এসেছি এবং বিশ্বাস করে এসেছি যে দেশ চালাতে হয় গণতন্ত্র দিয়ে। আমাদের পাশেই বিশাল ভারতবর্ষ কী চমৎকার গণতান্ত্রিক ভাবে বছরের পর বছর চলে আসছে। সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। তার পাশেই আমরা, বাংলাদেশ হওয়ার পরও জোড়াতালি দিয়ে চলছে। মাঝখানে বড় একটা সময় মিলিটারি শাসন করে দেশের বারোটা বাজিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত যখন গণতন্ত্র এসেছে তখন একটা নড়বড়ে গণতন্ত্র। এখনো নির্বাচন নিয়ে কতো রকম অভিযোগ। যখন ভারতবর্ষের গণতন্ত্র নিয়ে তাদের হিংসা করে এসেছি তখন হঠাৎ করে নরেন্দ্র মোদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন। সন্ত্রাসী হিসেবে আমেরিকায় যে মানুষটি নিষিদ্ধ ছিলেন, হঠাৎ করে আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা সেই নিষিদ্ধ মানুষের সাথে গলাগলি করার জন্য ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিলেন। ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতবর্ষে এখন গরুর সম্মান রক্ষা করার জন্য নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে ফেলা প্রায় নিত্যনৈর্মেত্তিক ব্যাপার।
আমি ভাবলাম, ঠিক আছে ভুলেভালে একবার এই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে পরের নির্বাচনে ভারতবর্ষের মানুষ নিজেদের ভুল শুধরে নেবে, ঠিক মানুষকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বানাবে। কিসের কী? আমি অবাক হয়ে দেখলাম এবারে নরেন্দ্র মোদি আগের থেকে বেশি ভোট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এবারে নির্বাচনের আসল শক্তিই হল ধর্মীয় উম্মাদনা। শুধু তাই নয় এবারে নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ প্রশাসনকে পুরোপুরি ব্যবহার এবং টাকার খেলা। গণতান্ত্রিক একটা পদ্ধতিতে একটা দেশ চোখের সামনে এভাবে পাল্টে যাচ্ছে দেখতে কেমন লাগে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে কি জার্মানি এভাবে আস্তে আস্তে নাৎসি জার্মানি হয়ে গিয়েছিল? এতোদিন বলে এসেছি, গণতন্ত্র খুবই ভালো। আজকাল বলি, গণতন্ত্র খুবই ভালো, কিন্তু তারপর থেমে গিয়ে মাথা চুলকাই বাক্যটা কীভাবে শেষ করব বুঝতে পারি না।
সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রের মোড়ল হচ্ছে আমেরিকা। মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র সাপ্লাই করতে গিয়ে সেখানে কী অবস্থা করেছে সেটা আমরা চোখের সামনে দেখছি। খবরে দেখলাম, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে বিশুদ্ধ এবং পরিশীলিত করার জন্য তারা একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এই দেশের মার্কিন কূটনীতিকদের সাথে আমার কোনোদিন দেখা হয় না, দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম সৌদি আরবের রাজা বাদশাহদের সরিয়ে সেখানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে তাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কীনা। পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা সমাধান নিয়ে তাদের নিজস্ব প্রস্তাব থাকে। আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে তাদের একজন কংগ্রেসম্যানের প্রস্তাব সবচেয়ে চমকপ্রদ, মিয়ানামারের রাখাইন প্রদেশটি দখল করে বাংলাদেশকে দিয়ে দেওয়া। গুরুতর বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করা ঠিক না। কিন্তু এই প্রস্তাবটি শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গিয়েছিল। এই আমেরিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণে আমার জীবনে কোনো উনিশ-বিশ হয়নি, কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশের অর্ধেক মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণ-বিদ্বেষ কিংবা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের জন্য অপরিসীম অবজ্ঞার সাথে একমত এটা চিন্তা করে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
যাই হোক, ধরে নিই গণতন্ত্র অনেক বড় ব্যাপার, আমার মত আদার ব্যাপারী এই বিশাল জাহাজের খবর বুঝবে না, কিন্তু আমাদের সমাজের চারপাশের দৈনন্দিন ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই বুঝতে পারব। আজকাল খবরের কাগজ মানেই হচ্ছে খুনখারাপির খবর। কতো রকম খুন দেখে আতংক হয়। কিছুদিন হল খুনের খবরের সাথে শুরু হয়েছে ধর্ষণের খবর। শুধু ধর্ষণ নয়, অনেক সময় গণধর্ষণ (ইস্ কী ভয়ংকর একটা শব্দ) সেখানেই শেষ নয় ধর্ষণ-গণধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড। খবরের কাগজ পড়তে হলে নয়মাসের বাচ্চা থেকে শতবর্ষী বৃদ্ধাকে ধর্ষণের খবর পড়তে হয়। আজকাল ধর্ষক হিসেবে শিক্ষকেরাও এগিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষক। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা ভয়ংকর রোগে সবাই আক্রান্ত হয়ে গেছে। এই খবরগুলো পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে একবার মনে হল পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষেরা এই সমস্যাকে কীভাবে সমাধান করে সেটা একটু দেখি। আমাদের দেশে স্কুল কলেজে ছেলেমেয়েদের ঠিক করে বড় করি না, পরিবার ছেলেমেয়েদের ঠিক করে মানুষ করতে পারে না, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক কিছু গোলমাল করে বিচার করা যায় না, শুধু তাই না বড় বড় মাস্তান এবং গড ফাদারেরা নয়ন বন্ডদের পুষে পুষে বড় করে, রাজনীতির মানুষেরা এদের ব্যবহার করে কাজেই আমাদের সমস্যার শেষ নেই। খুন ধর্ষণ যদি ভয়ংকর রোগ হয়ে থাকে তাহলে আমরা শুধু রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু দক্ষ দেশগুলো নিশ্চয়ই এই রোগটি ছড়িয়ে পড়তেই দিচ্ছে না। পৃথিবীর পরিসংখ্যানে চোখ বলাতে গিয়ে আমি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেছি। যে দেশগুলোর সবকিছু ঠিক করে করার ক্ষমতা আছে এবং আমার জানামতে সবকিছু ঠিকভাবে করে তাদের অনেকের পরিসংখ্যান আমাদের থেকে ভালো নয়, অনেকের পরিসংখ্যান আমাদের থেকেও খারাপ। স্ক্যান্ডিনিভিয়ান দেশগুলোর সামাজিক অবস্থা নিয়ে আমার সবসময়েই একটা উচ্চ ধারণা ছিল, পরিসংখ্যান দেখতে গিয়ে আমার সেই ধারণায় চোট খেয়ে গেল, সুইডেনে ধর্ষণের হার আমাদের দেশের ধর্ষণের হার থেকে ছয় সাত গুণ বেশি। না, তথ্যটা দেখে আমি স্বস্তি পাইনি, বরং হতবুদ্ধি হয়ে আছি, অপেক্ষা করে আছি সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টা বিশ্লেষণ করে আমাকে বোঝাবেন। আমার পক্ষে এটা বোঝার কিংবা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই। বিভ্রান্ত হয়ে আছি।
আমাদের দেশ এই দেশের স্টাইলে সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা করছে। সেই সমাধানের চেষ্টা করার প্রক্রিয়াটার নাম ক্রসফায়ার। ক্রসফায়ার একটা ইংরেজি শব্দ এবং ডিকশনারিতে নিশ্চয়ই তার আসল অর্থ দেওয়া আছে। আমাদের দেশে ক্রসফায়ারের অর্থ হচ্ছে অপরাধী সন্দেহে বিনা বিচারে মেরে ফেলা। এই পদ্ধতি কাজ করে কীনা আমি জানি না। শুনেছি কোনো কোনো দেশে এটা কাজ করেছে এবং সেইসব দেশ এখন খুবই আইন মেনে চলা শান্তিপূর্ণ দেশ। কিন্তু আমি অনেক খুজেঁও সে সম্পর্কে কোনো তথ্য কোথাও পাইনি। বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি ফিলিপাইনে এটা কাজ করছে না, সেখানে সাত হাজার থেকে বেশি মানুষকে মেরে ফেলেছে কিন্তু তাদের মাদকের সমস্যা মিটেছে সেরকম নিশানা নেই। আমাদের দেশে ক্রসফায়ার যথেষ্ট জনপ্রিয় পদ্ধতি বলে মনে হয়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো আজকাল বেশি উচ্চবাচ্য করে না। মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে একবার কক্সবাজার গিয়েছি- বিচে বসে আছি, তখন একজন কমবয়সী আর্মি অফিসারের সাথে দেখা হল। (আমি কক্সবাজার এসেছি খবর পেয়ে সে আমাকে খুজেঁ বের করেছে।) সেই কম বয়সী আর্মি অফিসার নিজে থেকেই বলল, উত্তরবঙ্গে তার পোস্টিং থাকার সময় সে একজন ভয়ংকর খারাপ মানুষকে ক্রসফায়ার করেছে (তখন এই প্রজেক্টের নাম ছিল অপারেশান ক্লিন হার্ট)। বোঝাই যাচ্ছিল ঘটনাটি তাকে বিচলিত করেছিল এবং আমার কাছে থেকে সে কোনো এক ধরনের নৈতিক সমর্থন কিংবা সান্তনা পেতে চাইছিল। আমি তাকে কোনোটাই দিতে পারিনি, তাকে বলেছিলাম একজন কখনই বিনা বিচারে অন্যজনের প্রাণ নিতে পারে না, আমরা সমাজে থাকার জন্য নিয়ম করে নিয়েছি যত খারাপই লাগুক আমরা কখনোই বিনা বিচারে হত্যা করার দায়িত্ব নেব না। আমি এখনও এটা বিশ্বাস করি (ক্যাম্পাসে যখন একজন আমাকে খুন করে ফেলতে চেয়েছিল, তাকে ধরে সবাই যখন পিটিয়ে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল আমি তখন তাদের থামাতে চেষ্টা করেছিলাম) তারপরও মনে হয় আজকাল যখন ভয়ংকর অপরাধীকে ক্রসফায়ার করে ফেলে তখন সেটা শুনে আগের মত বিচলিত হই না। ক্রসফায়ারের কথা শুনতে শুনতে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। নাকী অপরাধের মাত্রা আমার যুক্তিতর্ককে আবেগ দিয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলছে বুঝতে পারি না। বিভ্রান্ত হয়ে যাই।
যতগুলো উদাহরণ দিয়েছি সবগুলো এক ধরনের জটিল উদাহরণ। আরো মাটির কাছাকাছি উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথম যখন শুনেছি গ্যাসের দাম শতকরা তিরিশ ভাগ বেড়ে গেছে আমি রীতিমত আঁতকে উঠেছি, একদফায় ত্রিশ শতাংশ? সর্বনাশ। বিষয়টা নিয়ে অনেকদিন পর দেশে হরতাল হলো মোটামুটি উত্তপ্ত পরিবেশ। তখন হঠাৎ একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ জানালেন, দেশের মাত্র বিশ শতাংশ মানুষ সরাসরি রান্নাঘরে গ্যাস ব্যবহার করার সুযোগ পায়। আশি ভাগ মানুষের কাছ গ্যাস পৌঁছায়নি। তথ্যটুকু কতোটুকু সঠিক আমি জানি না কিন্তু যদি এটা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে হঠাৎ করে পুরো বিষয়টাকে আমি আর একটা জাতীয় ব্যাপার ভাবতে পারছিনা। দেশের শতকরা বিশ ভাগ সুবিধাভোগী মানুষের জীবনযাত্রার জন্য আমার কী দুর্ভাবনা করায় প্রয়োজন আছে? (আমি নিজে সেই সৌভাগ্যবান বিশভাগের একজন) বাম রাজনৈতিক দল আর সরকার মিলে দেন দরবার করে কোনো একটা সমাধানে পৌছে যাক, আমি দর্শক হয়ে ব্যাপারটা দেখি, বোঝার চেষ্টা করি। (সরাসরি গ্যাস ব্যবহার না করলেও গ্যাস ব্যবহার করে যে সব কাজ কর্ম করা হয় সেই সুবিধা নিশ্চয়ই দেশের সব মানুষই ভোগ করে সেটা কতোখানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কেউ একজন নিশ্চয়ই সেই হিসাব করে বলবে তখন বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করব। এখন এটি আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে।)
আরও মাটির কাছাকাছি উদাহরণ দিই। যখন ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হল তখন আমার মনে হল কাজটা ঠিকই হয়েছে। ঢাকা এতো বড় একটা মেট্রোপলিটন শহর, তাকে একটা আধুনিক শহর হিসেবে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে হলে আসলেই তো বড় বড় রাস্তা থেকে রিকশা তুলে দিতে হবে। তারপর যখন দেখলাম রিকশাওয়ালারা সব পথে নেমে এসেছে তাদের রুটি রুজি বন্ধ হওয়ার প্রতিবাদ করার জন্য তখন আমার মনে হলো, সত্যিই তো রিকশা চালানোর মত কঠিন আর অমানবিক ব্যাপার কী হতে পারে? সেই কষ্ট করে বেঁচে থাকা মানুষের আয় উপার্জন কেন আমরা বন্ধ করতে চাইছি? তাদের জন্য সত্যিকার আয়-উপার্জনের ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করে রিকশা বন্ধ করে দেওয়ার আমাদের কী অধিকার আছে? তাদের কি ঘর সংসার নেই? স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নেই? তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজে যায় না? মোট কথা আমি বিভ্রান্তিতে ভুগতে শুরু করেছি।
আমার বিভ্রান্তি নিয়ে এবারে হালকা কয়েকটা উদাহরণ দিই। আমার যে সব সহকর্মী বা ছাত্রছাত্রী জাপান বা কোরিয়াতে মাস্টার্স পিএইচডি করতে গিয়েছে তারা সবাই দেশে ফিরে এসে বলেছে, ওইসব দেশে সবাইকে শুধু কাজ এবং কাজ করতে হয়, নি:শ্বাস ফেলার সময় নেই। আমি শুনেছি এবং ভেবেছি বাহ! কী চমৎকার কাজের পরিবেশ। এতো কাজ করে বলেই তো জাতি হিসেবে তারা এতো সফল। বেঁচে থাকতে হলে তো কাজ করতেই হবে। তখন হঠাৎ একদিন দেখলাম ইউরোপের কোনো কোনো দেশ ভাবছে সপ্তাহে দুইদিন ছুটি কাটিয়ে টানা পাঁচদিন কাজ অনেক বেশি হয়ে যায়। সপ্তাহে চারদিন কাজ করে তিনদিন ছুটি কাটালে কেমন হয়? খবরটা পড়ে আমার মনে হলো, সত্যিই তো এই চমৎকার আইডিয়াটা আমার মাথায় কেন আসেনি? আসলেই তো, একটা মাত্র জীবন, সেটা কী শুধু কাজ করে করে কাটিয়ে দিলে হবে? যত কম কাজ করে, যত বেশি ছুটি উপভোগ করা যায় সেটাই তো ভালো।
এই হচ্ছে আমার অবস্থা। যেটাই শুনি সেটাই বিশ্বাস করে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। গত রাতে একটা খবর পড়ে আবার বিভ্রান্ত হয়ে গেছি। সারাজীবন শুনে এসেছি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়, ধোয়া কাপড় পরতে হয়। গতরাতে দেখলাম খবর বের হয়েছে জামা-কাপড় ধুতে নাই। জামা কাপড় ধুলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। যত কম ধোয়া যায় তত ভালো। কথাগুলো হেজিপেজি পাগল-ছাগলের মুখ থেকে আসতো তাহলে সেটা হেসে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এগুলো গরুত্বপূর্ণ মানুষের কথা। জিনসের এর প্যান্ট নির্মাতা লিভাইসয়ের সিইও বলেছেন- জিনস কখনো ধুতে হয় না। তিনি যে জিনসটা পরে আছেন সেটা তিনি দশ বছর খেকে পরে আসছেন, একবারও ধুয়ে পরিষ্কার করেননি। খবরটা পড়ে আমার মনে হলো আসলেই তো এতোদিন শুধু শুধু কাপড় ধোয়ার পিছনে এতো সময় নষ্ট করে এসেছি। কাপড় ধুতে না হলে জীবন কতো সহজ! (আমার একশ হাতের ভেতর হয়তো কেউ আসবে না, কিন্তু একটা বড় অর্জনের জন্য ছোট খাটো ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে।)
আমি নিশ্চয়ই বোঝাতে পেরেছি যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোক আর হালকা বিষয়ই হোক আমি আজকাল খুব সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যাই।
সেদিন খবরের কাগজে একটা খবর পড়ে আমি মেরুদণ্ড সোজা করে বসেছি। জামায়াত সম্পর্কে বলতে গিয়ে অন্য অনক কিছুর সাথে কর্নেল অলি আহমদ বলেছেন, ‘তারা দেশ প্রেমিক লোক’। না, এবারে আমি এতোটুকু বিভ্রান্ত হইনি। আমি খুব ভালো করে জানি দেশটির নাম যদি হয় বাংলাদেশ, তাহলে তারা দেশ প্রেমিক না। লন্ডন টাইমস লিখেছিল, রক্ত যদি স্বাধীনতার মূল্য হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশ অনেক মূল্যে স্বাধীনতা কিনেছে। সেই রক্তের দাগ জামায়াত ইসলামীর হাতে লেগে আছে এবং সেটা তারা কোনাদিন মুছে ফেলতে পারবে না। তারা বাংলাদেশ চায়নি। একাত্তরে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছে। বদর বাহিনী তৈরি করে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, লেখকের হাত কেটেছে, চোখের চিকিৎসকের চোখ তুলে নিয়েছে, হৃদরোগ চিকিৎসকের বুক চিরে হৃদপিণ্ড বের করে নিয়েছে। প্রায় অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে গেছে, কিন্তু তারা একবারও নিজেদের দোষ স্বীকার করেনি। দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি। একাত্তর আমাদের কাছে পুরানো ইতিহাস নয়, একাত্তরের ইতিহাস আমাদের বুকের রক্তক্ষরণ।
আমি অনেক সহজে বিভ্রান্ত হয়ে যাই, কিন্তু এই একটি ব্যাপারে আমার কোনো বিভ্রান্তি নেই। কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না।
লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।