মহামারি পর্যায়ে ধর্ষণ: পরিবারই দায়বদ্ধ

জুঁই জেসমিন

আগের যুগে কলেরা, ডায়রিয়া রোগে অসংখ্য শিশু মারা যেতো, এখন ধর্ষকের কবলে পড়ে শিশুদের প্রাণ যাচ্ছে। কলেরা ডায়রিয়ার মতো ধর্ষক, খুনি, সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ংকর ভাইরাসে। ধর্ষণ হত্যার যে বৃহৎ কারণ; তা চিহ্নিত না করে, সমাধানে না নিয়ে আসলে, সচেতন মূলক ব্যবস্থা না নিলে- ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

গত ছয় মাসে ৪৯৬ জন শিশু ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে। এসব ঘটনার পিছনে মূলত দায়ী কারা? পরিবারই দায়ী। কারণ কোনো খুনি বা ধর্ষক কিন্তু পরিবারের বাইরের না। কোনো না কোনো পরিবারের তারা। আর দারিদ্রের কারণে কেউ এমন ভয়ংকর অপরাধী হতে পারে না। অপরাধী হয় পরিবার বাবা মায়ের অবহেলার কারণে। পৃথিবীতে যত মনীষী আছেন, বেশির ভাগ তাঁরা দারিদ্রের আলিঙ্গনেই ইতিহাসে মহান ও অমরত্ব লাভ করেছেন। তাই পরিবার তথা বাবা মায়ের সচেতনতা জরুরী।

বাবা মায়েরা যাকে তাকে চরম বিশ্বাস করে তাদের হাতে ছেলে মেয়েকে ছেড়ে দেয়। তারা এতো ব্যস্ত চাকরি আর কাজ নিয়ে, সন্তানের প্রতি যে কর্তব্য পালন করা, সময় দেওয়া, এ দায়িত্ববোধ টুকুতে যেন বেজোড়। শুধু অন্যের ওপর দায়িত্বভার চাপিয়ে দিলেই চলবে না। মা বাবা ছাড়া একজন শিশু কারো কাছে নিরাপদ নয় এবং কী মাদকাসক্ত বাবার কাছেও সন্তান নিরাপদ না। বাড়িতে মেহমান এলে, মেহমানের সাথে ছেলে বা মেয়েকে এক ঘরে এক বিছানায় থাকতে দেওয়া হয়। পুরুষদের চোখে মেয়ে তো মেয়েই, বয়স হোক বা না হোক শিশু হলেও সেতো নারী ।

চরম সত্যি হলো একজন ছেলে বা মেয়ে-পরিবার তথা আত্মীয় ও পরিচিতি থেকেই যৌন হয়রানির স্বীকার হয়। অনেক পরিবারে দেখা যায় ভাই বোনের বিছানা একটা। আর স্বামী স্ত্রী থাকে এক ঘরে। নিম্ন শ্রেণী থেকে মধ্য শ্রেণীর পরিবার গুলোতে দেখা যায় এক হতে দুটি ঘর। এই ঘরের মধ্যে চাল গম আসবাবপত্র থাকা খাওয়া পড়ালেখা ইত্যাদি। আবার আত্মীয় স্বজন এলেও তাদের সাথে একসাথে এক বিছানায় থাকা, খাওয়া। এ যুগে বাড়ির ভাড়াটিয়াদের সাথে দহরম-মহরম অনেকের খাতির।

আজ যে রাজধানীর এই ছোট্ট শিশু সামিয়া আফরিন সায়মা ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের আহার হলো কুমিল্লার হারুণের দ্বারা। একটু ভাবুন তো, কতটা সম্পর্ক ভাল ভাবে গড়লে তার কথা মতো কিংবা তার এক ইশারাই শিশুটি ছাদে যায় তার সাথে? এর আগে নিশ্চয় নানান প্রলোভন দেখিয়ে চকলেট বা এটা সেটা পাখি ফুল দেখিয়ে শিশুর মন নরম করেছে? কিংবা তার বাবা মায়ের সাথে বেশ ভাব জমিয়েছে মেয়েটাকে কাছে টানার আদর আশ্রয়ে? বাবা মায়েদের মন গলে যায় একটুতেই, বাইরের কেউ তাদের সন্তানকে আদর করলে। চকলেট দেওয়া মানে সন্তানকে ছেড়ে দেওয়া এই আমাদের বিবেক। অন্যের একটু আদর সোহাগ কতটা সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসতে পারে, তা প্রত্যেক বাবা মা’কে ভাবা দরকার। একদিনে তো এতো বড় ঘটনার জন্ম দিতে পারেনা।

বড়রা এতো বেশি বড় ভুল করে, চলতে ফিরতে সত্যিই বেশ ভাবিয়ে তোলে, যত বড় হচ্ছি তত বুঝতেছি বড়রা কি কি ভুল করে অজান্তে অখেয়ালে। জার্নি করার সময়ও অনেকে নিজের মেয়েটাকে পাশের সিটের অপরিচিত চাচ্চুর কোলে দিয়ে দেয়। আর চাচ্চুটা কি করে আদরের ছলে, বার বার গাল নাড়ে, কান নাড়ে সুড়সুড়ি দেয় এটাসেটা, কান্নাকাটি করার সুযোগ নেই, “চাচ্চুটা ভাল দুষ্টুমি করছে, মজা করছে, বসে থাক তার কোলে।” সন্তানের অসুবিধেটা গুরুত্ব দেওয়া হয়না এই সমাজে, নিজ আরাম স্বার্থের তাগিদে। এই মজা এই দুষ্টুমিটা যে কেমন? তা বুঝার চেষ্টা করেনা- মা বাবা ভাই বোনেরা। কিন্তু বুঝতে তো হবে, বুঝা দরকার প্রত্যেকের।

আমার মনে হয়না আজ পর্যন্ত যত শিশু ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে বা হচ্ছে তা অপরাধীদের অপরিচিত কেউ ? বরং বেশ পরিচিত এবং কী বেশ সুসম্পর্কও থাকে বটে। অনেক যুবক আছে যা পরিবার স্ত্রী পুত্র বাড়িতে রেখে দূরে গিয়ে কর্ম রুজি করে এবং চাহিদা ভোগের জন্য উদ্দেশ্য হাসিল করে আশেপাশের শিশু থেকে মহিলার সাথেও সম্পর্ক তৈরি করে। আবার মাদক দ্রব্য সেবন, তা তো আছেই। এই পরুষগুলো যৌন চাহিদা পূরণে যা ইচ্ছে তাই করতে বসে, তা না হলে ছোট্ট শিশুটিও কেন রক্ষা পায়না? কেন নিরাপদে থাকতে পারেনা? আবার ফুটপাত অলিগলিতে তো বেকার নেশাখোরদের উৎপাত আছেই, আর আছে হাতে স্মার্ট ফোন নোঙরা ভিডিও ছবি দেখার জন্য।

বাবা মায়েরা নিজ সন্তানের খেয়াল না রাখলে, সন্তানের স্বস্থি অস্বস্থি ভাল মন্দ প্রকাশ করার সুযোগ না দিলে এবং তাদের কথার গুরুত্ব না দিলে ঘটনা সামনে হাজির হবেই। আজ আপনার চোখে একজন শিক্ষক বা হুজুর মহান হতে পারে তাই বলে আপনি আপনার সন্তানকে ইচ্ছে মতো তাদের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন না। আসুন আমরা সতর্ক সাবধান হই প্রত্যেকে। তা না হলে, এমন ঘটনা থেকে কোনো দিনই মুক্তি পাওয়া যাবেনা। সন্তানেই আপনার আসল সম্পদ, সন্তানকে মানুষ করা, নিরাপদে রাখা আপনারই দায়িত্ব।

jui.jesmin306@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts