শাহ মতিন টিপু : পাবলো পিকাসো। বিশ্বখ্যাত স্পেনের এই চিত্রশিল্পী ও ভাস্করকে কে না জানে। বিংশ শতাব্দীর সেরা চিত্রকরদের মধ্যে তিনি অন্যতম। জন্মসূত্রে স্পেনীয় হলেও জীবনের একটা বড় অংশ ফ্রান্সে কাটিয়েছেন। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে উত্তর আধুনিকতার জনক বলা যায় তাকে। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে বিশ্বের চারুকলাকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।
বাস্তববাদী অঙ্কনরীতি যেমন তার হাতে নতুন মাত্রা পেয়েছে, তেমনি পরাবাস্তববাদী শিল্পরীতিও সমৃদ্ধ হয়েছে তার প্রতিভার স্পর্শে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে তার বিশ্বখ্যাত শিল্পকর্ম ‘দেমোইসেল্লেস দ্য’অ্যাভিগনন’ ও ‘গোয়ের্নিকা’। আজ পাবলো পিকাসোর জন্মদিন। ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর জন্ম তার, মৃত্যু ১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল।
তার চিত্রকর্ম ‘গোয়ের্নিকা’ সম্পর্কে বলা হয়- যত দিন মানুষ, স্বাধীনতার স্পৃহা, অগ্রগামী চিন্তাচেতনা বেঁচে থাকবে, তত দিন গোয়ের্নিকা বেঁচে থাকবে।
চিত্রটির পটভূমি হচ্ছে স্পেনের ব্যস্ক কান্ট্রির গোয়ের্নিকা নামক শহরটিতে স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময় জার্মান ও ইতালিয়ান যুদ্ধবিমানের বোমাবর্ষণ। স্প্যানিশ ন্যাশনালিস্টদের কমান্ডেই তারা এই বোম্বিংটা করে। গোয়ের্নিকা ছিল রিপাবলিকান চেতনা ও ব্যঙ্গ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। তাই ন্যাশনালিস্টরা এই শহর ধ্বংসের জন্য উন্মত্ত ছিল।
চিত্রটিতে রং আছে তিনটি। সাদা, কালো ও ধূসর। এই তিনটি রং ব্যবহার করার কারণ মূলত একধরনের বিবর্ণতা, বিষাদ ফুটিয়ে তোলা। ম্যুরালাকৃতির এই পেইন্টিংটি তেলরঙে করা। দৈর্ঘ্য ১১ ফুট আর প্রস্থ ২৫.৬ ফুট। এই চিত্রে দেখা যায়, একটি ঘর, যার বাঁ পাশে উন্মুক্ত অংশে একটি ষাঁড়, তার সামনে মৃত শিশু নিয়ে ক্রন্দনরত মা। মধ্যে দেখা যায় প্রচণ্ড উন্মত্ত একটি ঘোড়া, আঘাতপ্রাপ্ত। একটা মানুষের খুলি ঘোড়ার শরীরকে আগলে রাখছে আর একটি ষাঁড় ঘোড়াকে কেটে ফেলার চেষ্টা করছে। আঘাতরত ষাঁড়টির লেজ, যেটা অনেক অগ্নিরশ্মি বা চুরুটের ধোঁয়ার মতো। ঘোড়ার শরীরের নিচে একটি সৈনিক, মৃত। সৈনিকের হাতে একটি স্টিগ্মা (তলোয়ার) যেটা স্প্যানিশ সংস্কৃতিতে শাহাদাতের চিহ্ন। অশুভ চোখের আকৃতির একটি বাল্ব জ্বলছে ঘোড়ার মাথার ওপর। এইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি এলিমেন্ট। স্প্যানিশ ভাষায় বাল্বকে বলা হয়, বোম্বিলা। তাই এইখানে বাল্ব বোমাবর্ষণের দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করে। ঘোড়াটির ওপর একটি ভাসমান যুবতীকে দেখা যায়, যে খোলা জানালা দিয়ে ভেসে এসেছে বলেই বোঝা যায়। আর তার হাতে একটি আলোকবর্তিকা, যা বাল্বটির খুব কাছাকাছি। এই থেকে পতনের খুব কাছেই থাকে আশা- এমন ইঙ্গিতই পাওয়া যায়।
যুবতীর পেছনেই একটি আতঙ্কিত রমণীকে দেখা যায়, যে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ওই বাল্বের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ষাঁড়ের পেছনেই শেলফের মধ্যে একটি পাখি আতঙ্কগ্রস্ত তাকিয়ে রয়েছে ষাঁড়টির দিকে। একেবারে ডানে দুটি হাত উঁচু করা যে ধ্বংসের নিচে চাপা পড়েছে। আর তার ডানে কালো দেয়ালে চিত্রটি শেষ হয়েছে।
এই চিত্রের মাধ্যমেই পিকাসো অসাধারণ খ্যাতি লাভ করেন। এইখানে শুধু স্পেন নয়, পৃথিবীর সমগ্র স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতিরোধী সত্তাকে তুলে ধরা হয়েছে আর মানুষের ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির নিন্দা করা হয়েছে।