জুঁই জেসমিন
যাঁর হৃদয়ে দেশ ও মানুষের স্বপ্ন, স্বপ্ন সোনার বাংলার,কল্পনায় অনুমানে দু চোখ জুড়ে যাঁর মানুষের সুখ দুখের চিত্র – সেই মানচিত্রের বুকে এক বা দু’টো গুলি নয়, আঠারো রাউন্ড গুলি চলে! মেশিন গানের ভয়াল মিউজিকে কেঁপে উঠে আকাশ, প্রাসাদ বত্রিশ নম্বর সড়কের সবক’টা দালান।
যিনি দেশের জন্ম দিয়েছেন, বাঙালীকে উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধের দামামায় – জন্ম দিয়েছেন লাল সবুজের পতাকার। যাঁর জন্য সৃষ্টি বাংলার মানচিত্র। আমরা কে কতটুকু স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস জানি, কতটুকু জানি ১৫ আগস্ট রাত হতে ভোর অবধি ঠিক কী ঘটেছিল বাংলার মাটিতে? কে এবং কার পুরো পরিবারসহ তাজা রক্তের স্রোতো ধারায়, পদ্মা মেঘনা যমুনার বুকে আছড়ে পড়েছিল প্রাণ বাঁচার করুণ আর্তনাদ? এমন নির্মম গণ হত্যার ইতিহাস বিশ্বের আর কোন দেশে আছে বা ঘটেছে? শিউরে ওঠে উদিত সূর্য, ধসে পড়ে পৃথিবীর সব পাহাড়! হৃদপিন্ড থেমে যাই এ ইতিহাসে চোখ বুলালে!
কে না দেশকে ভালবাসি? ভালবাসি সবাই তবে আজ এই শোকের মহিমায় একটু চোখ বন্ধ করি, হৃদয়ের অনুভূতিতে ভাবনায় বিচরণ করি ৭১।- সবকটি গ্রাম বাংলা।
ছুঁয়ে আসি
রক্তাক্ত ইতিহাস। ঘুরে আসি টুঙ্গি পাড়া- ১৯২০-১৯৭৫।
সাত কোটি বাঙালী ছিল যাঁর প্রাণ
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া জুড়ে
যাঁর ছিলো ভাবনা।
যাঁর জন্ম ছোট্টখাট্টো এক টিনের ঘরে
পঞ্চান্ন বছর চার মাস আটাশ দিন আয়ুর আলিঙ্গনে- ।
যাঁর দৃঢ় সাধনায় স্বাধীন সার্বভৌম
এক রাষ্ট্র সৃষ্টি,বিশ্বের মানচিত্রে –
যার নাম বাংলাদেশ।
বারো বছরের বালক শিশুতোষ ভাবনা ভেলায় ভাবনার রাজ্যে ভালবাসে দেশ, মাটি, মানুষ। প্রাণের ভাষা মাতৃভাষা যাঁর জীবনেরই অলংকার, সুর ছন্দ শ্লোগান আর সাহিত্যে ছিল যাঁর কবিত্বের সমুদ্রসম নির্যাস। জাতির একটুকরো হাসি যাঁর ছিলো আনন্দ উঠোন, জীবনের স্বর্ণময় অধ্যায় কেটে যায় যাঁর কারারুদ্ধে! সেই মহকুমা জেলার টুঙ্গি পাড়ার শেখ বংশের বড় ছেলে যা ছিলেন ব্রতচারী, দুষ্টু প্রকৃতির , তবে মন ছিলো রাজার রাজা।
১৯৩৬ এ বয়স ষোলোয়, স্বপ্নিল দুচোখ তাঁর ভারী চশমার প্রচ্ছদ করে দৃষ্টির সীমানায়- আর বারোতে বিবাহবন্ধন তিনবছর বয়সী রেনুর সাথে।
আমি বলছি এক কবির কথা
যাঁর লেখা – ‘ অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘
‘কারাগারে রোজনামচা’
আরও- ‘স্মৃতি কথা’ সহ চীন ভ্রমণ, আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা’।
এক একটি ডাইরি এক একটি প্রাণ বাংলার দলিল!
যাঁর লেখার, প্রেরণা জ্যোতি ছিলেন সহধর্মিণী বেগম রেনু। ডাইরি, কলম,খাতা, প্রেরণার ঝুড়ি সহ পৌঁছে দিতেন কারাগারে দেশপ্রেমী স্বামীর হাতে। যা সাহিত্যের অনন্য শিরোনাম ও স্বাক্ষর, সব টুকু অবদান বঙ্গমাতা শেখ রেনু মুজিবের।
বাবা লুতফর রহমান যাঁর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো থেকে দেশ মাটি মানুষের মান রক্ষার্থে সর্বদায় ছায়ার মতো স্বপ্নিল সবুজ ছাতা হয়ে দেশরত্ন মুজিবের মাথার ওপরে ছিলেন, ভরসা উদ্দীপক হয়ে।
যাঁর দু’চোখ স্নান করে তেরোশত নদীর ঢেউয়ে-
কর্ণদেশে-বাজে
মৃত্তিকার কান্না
মাতৃভাষার কান্না,ডানা ঝাপটা পাখির কান্না,
আকাশের কান্না
সাত কোটি বাঙালির কান্না!
রক্তের বুদবুদে আত্মকথার সহস্র পত্র –
চাই স্বাধীনতা,
জেল- জুলুম,নিগ্রহ, নিপীড়ন সব সহনের মাঝে ছিল একটি স্বপ্ন –
দেশ বাঁচার।
উদাত্তকণ্ঠ- আকাশে বাতাসে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক
৭ ই মার্চের এক ঐতিহাসিক ভাষণ –
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”
সাহসের ভাণ্ডার হতে ছড়িয়ে পড়ে মুঠো মুঠো সাহস
অদম্য প্রেরণার ঝড়, মাত্র সাতত্রিশটি অক্ষর নয়টি শব্দের ঝংকারে জাগ্রত জনতা।
যাঁর প্রেরণা, উদ্যোগ, উচ্ছাসে জেগে উঠে বাঙালি, অদম্য শক্তি সঞ্চারে জীবনকে বাজি রেখে ছিনিয়ে আনে বিজয়। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত দেশ।
১৫ আগস্ট ইতহাস থমকে যাওয়ার কম্পিত এক দিন। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিনটিকে আঘাতহানার উত্তম দিন হিসেবে যারা বেছে নেয় জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে, পুরো পরিবার নির্বংশ করে উল্লাসে মাততে! কারা বেছে নেয়- এরা কারা?
এ দেশেরই এক খামার গ্যাং কালচার লোভাতুর নরপিশাচ যার উপাধি মেজর, ক্যাপ্টেন, কর্নেল আর পোষা কিছু সেনাবাহিনী।
নব দিনের নব সূর্যটা নব স্বপ্ন প্রভা ছড়িয়ে দিতে না দিতেই ঝরে যায় ৩২ নম্বরের রক্তের বন্ধনে সব ক’টা প্রাণ, শত সহস্র গুলির ঝাঁঝরায় মেশিন গান আর মর্টারের শব্দে! যাঁর মাঝে ছিলো অর্জিত বাংলার প্রাণ, ছিলো স্বাধীনতার মানচিত্র তাঁর বক্ষে চলে আঠারো রাউন্ড গুলি মেজর নূরের পাষণ্ড হাতে—রক্তাক্ত পিতা পরে থাকে সিঁড়িতে। রক্তে রঞ্জিত বাড়ি!
একতলা দোতলা সারা বাড়ি আপনজনের লাশ, শেখ কামালের লাশ, বেগম রেনু বঙ্গমাতার লাশ, শেখ জামাল, নববধূ রোজির লাশ , সুলতানার লাশ, শেখ নাশেরের লাশ! লাশ আর লাশ! দশ বছরের ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলকেও ছাড়েনি নরপিশাচরা – মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে এই মিথ্যে আস্বাসে নিয়ে যায় দোতলায়, আর মা ভাইয়ের লাশের ওপর ছুঁড়ে ফেলে, নিষ্পাপ রাসেলের বুকেও চালায় গুলি, কচি মগজ বেড়িয়ে পড়ে রাসেলের! পৃথিবীর সব যেন স্তব্ধ! স্তব্ধ সব ক’টা গ্রহ নক্ষত্র!বেদনার সুর ভাসে ক্ষত বিক্ষত স্বাধীনতার আকাশে। বুক ফাটা হাহাকার -প্রাণ বাঁচার আর্তনাদে সবার রক্ত এক হয়ে বুদ বুদ ধ্বনিতে কথা বলে যায় ‘ ‘বাঁচতে চাই! বাঁচাও! দয়া করো,,,,!”
কেউ শোনেনি! শোনেনি কেউ। কোথাও কেউ নেই! বঙ্গ বন্ধুর দু’ কন্যা ছাড়া, যা ছিলেন দেশের বাইরে শেখ রেহেনা, শেখ হাছিনা। প্রিয়জনের মুখ, সারিবদ্ধ লাশের সারি! যা দেখার সুযোগটুকুও ছিলোনা দু’ বোনের। পশ্চিম জার্মানীতে অসহায় শিশুর মতো কেঁদেছেন তাঁরা!
ধুলোয় আবৃত বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতা ডাইরি যা ছিলো আলমারির উপর -ইতিহাস ইতিহাসকেই খামচে ধরে, প্রাণ গেলেও -প্রাণের কথা, দেশের কথা, সব স্মৃতি কথা অক্ষরে অক্ষরে পাণ্ডুলিপির গর্ভে চির অক্ষয়, চির উজ্জ্বল। সৃষ্টি সাধনা কখনো ধ্বংস হতে পারেনা, বঙ্গবন্ধু নেই, আছে সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাছিনা। আছে থাকবে তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘কারাগারে রোজনামচা’ যতদিন দেশ থাকবে, — থাকবে পৃথিবী – থাকবে তাঁর স্মৃতি কথা– আসুন সবাই এভাবেই দেশকে ভালবাসি। ভালবাসি মা, মাটি, মানুষ।
সন্তানকে শিক্ষিত শুধু নই, গড়ে তুলি মানুষ সত্যিকারে মানুষ,যে মানুষ পরিবার সমাজ দেশকে ভালবেসে আগলে রেখে, প্রাণ দিতে প্রস্তুত! শ্রদ্ধা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের প্রতি, ভোরের প্রজন্ম জাগুক ভোরের দর্পণে জ্বলুক সদা মঙ্গল প্রদীপ ঘরে প্রান্তরে।
জুঁই জেসমিন: লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।