প্রফেসর ড. মো. মোশাররফ হোসেন
বিশ্ব মশা দিবস পালিত হয় প্রতি বছরের ২০ আগস্ট। এই মশা দিবসের কথা প্রথম বলেন স্যার ডোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালের ২০শে আগস্ট যেদিন তিনি প্রমাণ করেন স্ত্রী এনোফিলিস জাতিয় মশাই মানুষের মধ্যে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এই ম্যালেরিয়া জীবাণু আবিস্কার তাঁকে নোবেল পুরস্কার এনে দেয় ১৯০২ সালে।
তৎকালিন ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে তিনি ২৫ বছর ডাক্তারী করেন এবং পরে তিনি লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগে প্রফেসর হিসাবে গবেষণা করেন। ১৮৮১ থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন শহরে তিনি চাকরী করেন। যখন তিনি সেকেন্দারাবাদে চাকরী করতেন সেখানে অনেক মানুষ মারা যায় কলেরায় ও ম্যালেরিয়ায়। ঐ বছর তিনি বিশটি ব্রাউন মশা ধরে গবেষণাগারে ব্রিড করান এবং হুসেন খান নামক ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে আট আনা দিয়ে ভাড়া করেন এবং তাঁকে প্রতি কামড়ের জন্য এক আনা করে দিতেন। এভাবে তিনি মশাকে ম্যালেরিয়া জীবানু দ্বারা ইনফেকটেড করতে সমর্থ হন।
এটি ১৮৯৭ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশের পর পরই সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারেন শুধুমাত্র স্ত্রী এনোফিলিস মশাই ম্যালেরিয়া রোগের জন্য দায়ী। তিনি ১৯২৬ সালে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত রস ইন্স্ট্রিটিউট এন্ড হসপিটালের ডক্টরস্ ইন চীপ নির্বাচিত হন ও সেখানে কাজ করেন। তারপর থেকে দি লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিন প্রতি বছর এই দিবসটি পালন করে থাকে গুরুত্ব সহকারে বিশ্বজুড়ে। বির্বতনের ধারায় মশা প্রকৃতির এক ক্ষুদ্র প্রাণি যারা আর্থোপোডা পর্বের পতঙ্গ শ্রেণির অর্ন্তগত কিইলিসিডি পরিবারের অধিনে এদের স্থান। সারা পৃথিবীজুড়ে ১১২ জাতের প্রায় ৩৫০০ প্রজাতির মশা আছে। যাদের মধ্যে শুধুমাত্র স্ত্রী এনোফিলিস প্রজাতির মশাই ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়।
বিশ্বে ৪৫০ প্রজাতির এনোফিলিস মশা থাকলেও মাত্র ১০০ প্রজাতির মশা মানুষের মধ্যে রোগ-বালাই ছড়ানোর কাজের উপযোগী। এডিসসহ অন্য প্রজাতির মশারা বিশেষকরে ডেঙ্গু, চিকোনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ, ইয়োলো ফিভার ইত্যাদি রোগের বাহক হিসাবে কাজ করে থাকে। ২০১৮ সালেও ডব্লিউএইচও এর হিসাবে সারা বিশ্বে চার লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
বাংলাদেশে ২৯ প্রজাতির মশা থাকলেও এখন পর্যন্ত ম্যালেরিয়া (পার্বত্য অঞ্চল), ফাইলেরিয়া (উত্তর বঙ্গ) এবং ডেঙ্গু রোগ এ বছর মহামারী আকারে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই এই ডেঙ্গু জ্বরে এখন পর্যন্ত সরকারী হিসাবে ৫০ জনের অধিক মানুষ মারা গেছেন। স্বাভাবিকভাবে এ বছর বাংলাদেশে এডিস মশার দ্বারা ছড়ানো ডেঙ্গু আতঙ্ক মানুষের মাঝে বিরাজ করছে।
এডিস মশা হল ডেঙ্গু জ্বরের বাহক, তাই যদি কোন বাহক না থাকে তাহলে রোগ ছড়াবে কে? বিষয়টি খুবই সহজ কিন্তুু কাজটি কঠিণ। যদি কোন রোগবাহী এডিস মশা কোন মানুষকে কামড়ায় তাহলে তার ডেঙ্গু হবার সম্ভাবনা ১০০ভাগ। রেডিও, টিভি কিংবা পত্র-পত্রিকায় এ ব্যাপারে বাপক আলোচনা হচেছ। এমনকি বিশেষজ্ঞ না হয়েও টকশোতে অনেকে নানান কথা বলছেন ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচেছ। তাই এই এডিস ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রন সম্পর্কিত বিষয়ে জড়িত থাকবে মশার গবেষক, ডাক্তার, আর সরকার বা নগরপিতা যিনি কিনা মশা মারার জন্য বিশেষজ্ঞ মতামতের সমন্বয় করে মশার লার্ভা, ডিম কিংবা বয়স্ক মশা নিধন করবেন। তাহলে এই কঠিণ কাজটির জন্য ও মশার হিসাব নিকাশ করার জন্য থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষকদের এলাকা ভিত্তিক একাধিক দল বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
বাস্তবে ক’জন মশার গবেষক আছেন আর ক’জনকে তাঁর গবেষণার জন্য অনুদান দেওয়া হয়? কিংবা ক’টা মেট্রোপলিটন শহরে এই গবেষণা কর্ম চলছে। ঢাকা ছাড়া অন্যান্য শহরের মানুষ ভাগ্যবান যে সেখানে যেসব এডিস মশা আছে তাদের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের জিবাণু নেই। তবে যে সকল রোগী ঢাকা বা ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ এলাকার অথবা ডেঙ্গু জ্বরের রোগী তারা ঐ এলাকায় যদি অবস্থান করে তাহলে স্থানীয় যে এডিস মশা আছে তারা ঐ রোগীর মাধ্যমে ইনফেকটেড এডিস মশায় পরিণত হবে আর রোগ ছড়াবে। তাই আমাদের মশার ঘনত্ব জানা জরুরী। এটা দ্রুত করা গেলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া যাবে এবং সুফল বেশি পাওয়া যাবে।
আমরা ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এক গবেষণায় দেখেছি, রাজশাহীতে যে চারটি থানা আছে তার মধ্যে, মতিহার বাদে সকল থানা বিশেষ করে রাজপাড়া, শাহ মখদুম ও বোয়ালিয়া থানায় বেশী এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ল্যাবে এদের কালচার করার পর আমরা পূর্ণবয়স্ক মশাকে পর্যাপ্ত ব্লাড মিল দিয়েছি তারপরও ডিম পাড়ে নাই, ডিম না পাড়ার কারন এখনও আমাদের অজানা। এখন যেহেতু সারাদেশে ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়ছে তাই বাড়তি সর্তকতা হিসাবে আমাদের দ্রুত সমন্বয় কমিটি করে এগুলে ডেঙ্গু মহামারীর হাত থেকে নগরবাসিকে রক্ষা করা যাবে। আমি নিজ উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার ছাত্রদের দ্বারা এডিস মশার লার্ভার উপর ভর্দ্রা আবাসিক এলাকায় জরিপ করেছি, তাতে বেশির ভাগই কিউলেক্স ও কিছু এডিস জাতীয় মশার লার্ভা পেয়েছি। মজার বিষয় হল আমি একটা বয়স্ক এডিস মশা ধরেছি অত্র এলাকায় (চিত্রে দেওয়া হল)। এই জরিপ সিমিত আকারে হলেও প্রমাণ করে এবছরও এডিস মশার রাজশাহীতে বিস্তার আছে।
গত কয়েকদিনের প্রথম আলো পত্রিকার হিসাবে ডেঙ্গু দেশের সবগুলো জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত স্থানীয়ভাবে রাজশাহীতে ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয়নি, রামেকে ভর্তি সকল রোগী ঢাকা থেকে জীবানু বহণ করে এনেছে।। একথা সঠিক হলে খুব দ্রুত নিন্মলিখিত নাগরিক দায়িত্ব পালন করলে এডিশ মশার বংশ বিস্তার ও ডেঙ্গু মহামারী থেকে দেশবাসিকে বাঁচানো সম্ভব।
(এক)- মহানগরের প্রতিটি ঘরে দিনের বেলায় এ্যারোসল স্প্রে করে নকডাউন বয়স্ক মশাকে মেরে ফেলা, (দুই)- বাড়ীতে কিংবা অন্য কোন পরিবেশে কোন প্রকার টবে/প্লাষ্টিক জাতীয় পাত্রে পানি জমতে না দেয়া অর্থাৎ লার্ভার বিস্তার রোধ, (তিন)-লার্ভাযুক্ত পানি কোথাও না ফেলে তাতে পর্যাপ্ত পরিমান গরম পানি ঢেলে লার্ভার মৃত্যু নিশ্চিত করা (কারণ পানিতে ফেললে সেখান থেকেও লার্ভা বেঁচে যাবে, আবার যদি শুকনো মাটিতে ফেলা হয় এবং তাতে নিষিক্ত ডিম থাকে তা আবার ছয় মাসের মধ্যে অনুকুল পরিবেশে ডিম ফুটে বয়স্ক মশা হয়ে ক্ষতি করতে পারে), (চার)-মহানগরের সকল পাড়া-মহল্লায় মশার এলার্ট জারী করা, (পাঁচ)-ঢাকা থেকে সকল এলাকায় আগত ডেঙ্গু রোগীদের সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত মশারীর মধ্যে নিবিড় পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণে রাখা।
মশা সারা পৃথিবীর সমস্যা, এখন পর্যন্ত যে সকল মশা নিধনের পদ্ধতি আছে তা আর্থসামাজিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। কোন কোন দেশে বিমানে/হেলিকপ্টারে করে ওষুধ ছিটানো হয় আবার কোন দেশে ফগিং করা হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী ওক্স৫১৩এ (OX513A) নামক একটি জেনেটিক্যালি মডিফাইড পুরুষ মশার স্ট্রেইন আবিস্কার করেছেন যারা কিনা প্রকৃতির বন্য স্ত্রী মশার সঙ্গে মিলিত হলে তার দেহে একটি ক্ষতিকর জিন ঢুকে পড়ে ফলে ঐ স্ত্রী মশাটি বন্ধাত্ম্য বরণ করে এবং ডিম দেবার ক্ষমতা হারায়। ফলে একটি বয়স্ক মশা যে চার-পাঁচবার কয়েকশত ডিম দিত তা আর পারে না বিধায় মশার বংশধারা কমে যায়।
এই উন্নত প্রযুক্তি আমাদের জানা থাকলেও ল্যাবরেটরির অভাবে এ জাতীয় গবেষণা করা সম্ভবপর হয় না। তাই স্থানীয়ভাবে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে মশা নিধনই ডেঙ্গু মহামারী থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।
চিত্র: ভর্দ্রা এলাকায় পাওয়া বয়স্ক এডিস মশা (ল্যাবরেটরিতে তোলা ছবি)
প্রফেসর ড. মো. মোশাররফ হোসেন: কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।