ডা. ছায়েদুল হক
ডেঙ্গুজ্বর বাংলাদেশে বর্তমানে এক আতঙ্কের নাম। এটি এক ধরনের ভাইরাস জ্বর যা ডেঙ্গু ভাইরাস নামে এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১০০টির মতো দেশে ডেঙ্গুজ্বর ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতিবছর ১০ কোটি লোক মতান্তরে ৩৯ কোটি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবছর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয় ৫ লাখ ডেঙ্গু রোগী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক অঞ্চলে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বর্তমান বিশ্বে অর্ধেক লোক ডেঙ্গুঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৫ সালে ভারতে ডেঙ্গুজ্বর তীব্র আকার ধারণ করে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ আর মৃতের সংখ্যা ছিল ২২২ জন। বাংলাদেশেও কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চার ধরনের সেরোটাইপ আছে। ডেঙ্গু-১-৪। যাদের প্রত্যেকের আলাদা এন্টিজেন থাকে। ফলে প্রতিটি সেরোটাইপ আলাদা ভাইরাসের মতো সংক্রমণ করে। একবার এক ধরনের সেরোটাইপ দ্বারা সংক্রমিত হলে রোগী ভবিষ্যতে সেই সেরোটাইপ দ্বারা আর সংক্রমিত হয় না। ভবিষ্যতে সংক্রমিত হলেও সেটি অন্য কোনো সেরোটাইপ দ্বারা হবে। ডেঙ্গু ভাইরাসটি প্রকৃতিতে মুক্তভাবে থাকতে পারে না। ভাইরাসটি নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অন্য প্রাণীর দেহে আশ্রয় নিয়ে থাকে। ভাইরাসটি যে দুটি প্রাণীর দেহে আশ্রয় নিয়ে থাকে তার একটি হলো মানুষ এবং অন্যটি হলো স্ত্রীজাতীয় এডিস মশা। ভাইরাসটি যখন মশার দেহে থাকে তখন মশার কোনো ক্ষতি করতে পারে না অর্থাৎ মশার কোনো অসুখ এতে হয় না। কিন্তু দুঃখজনক হলো, ভাইরাসটি যখন মানুষের দেহে থাকে তখন মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ ক্ষেত্রে মশা কেবল জীবাণুটিকে বহন করে থাকে। ফলে এই বহনকারী মশাকে বলা হয় ভেক্টর বা বাহক। আর মানুষ হলো ভিক্টিম।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বুঝতে হলে ভেক্টর এডিস মশার জীবনচক্রটিকে বুঝতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে না এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। একটি স্ত্রীজাতীয় এডিস মশা যা বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে থাকতে পছন্দ করে। এডিস মশার বংশ বিস্তারে স্ত্রীজাতীয় এডিস মশা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকে। পুরুষ এডিস মশার একমাত্র কাজ হলো প্রজননে সাহায্য করা। প্রজনন কাজ সমাপ্ত হলে পুরুষ এডিস মশা মাত্র ৫-৬ দিন বেঁচে থাকে। এ সময়টিতে পুরুষ মশা গাছের বা ফলের রস খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে। ফলে এরা মানুষকে কামড়ায় না।
অন্যদিকে স্ত্রীজাতীয় এডিস মশা প্রজননের পর কয়েক মাস বেঁচে থাকে। প্রজনন-পরবর্তী সময়ে স্ত্রী মশার পেটে ডিমের সঞ্চার হয়। এই ডিম পরিস্ফুটনের জন্য তার প্রোটিন বা আমিষের প্রয়োজন হয়। আর এই আমিষের প্রয়োজন মেটাতে সে বেছে নেয় মানুষের রক্ত। তাই স্ত্রী মশা মানুষকে কামড়ে থাকে। ওই দেহে যদি ভাইরাস থেকে থাকে তবে ভাইরাসটি রক্তের সঙ্গে মশার দেহে সঞ্চারিত হয়ে যাবে। এই মশাটি এখন ভাইরাসের বাহক। বাহক মশা যখন আবার কোনো সুস্থ লোককে কামড়াবে তখন মশার দেহ থেকে ভাইরাসটি আবারও সুস্থ লোকটির দেহে সঞ্চারিত হবে এবং সুস্থ লোকটি তখন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হবে।
বিপজ্জনক হলো একটি স্ত্রী এডিস মশা ৩ ধাপে ১০০ করে প্রায় ৩০০ ডিম পাড়ে। এর অর্ধেক অর্থাৎ ১৫০টি পুরুষ এবং বাকি অর্ধেক অর্থাৎ ১৫০টি স্ত্রীজাতীয়। ডিম পাড়ার জন্য বেছে নেয় বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে ফেলে রাখা পাত্র, ফুলের টব, পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বা কাচের বোতল, পরিত্যক্ত টায়ার; গৃহনির্মাণসামগ্রী ইত্যাদি। শুকনো অবস্থায় ডিমগুলো নষ্ট হয় না এবং অনেকদিন এই অবস্থায় থেকে যায়। আবার বর্ষাকালে যখন বৃষ্টি বা বন্যার পানি অথবা বাসাবাড়ির ব্যবহৃত জমানো পানির সংস্পর্শে আসে তখন ডিম থেকে লার্ভার নির্গমন হয়। এই লার্ভা জমানো পানির উপরিভাগে ঝুলে থাকে এবং বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে বেঁচে থাকে। ময়লা বা দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমার পানিতে এটি সম্ভব নয় বিধায় এরা সব সময় পরিষ্কার পানিতে প্রজননের কাজটি সমাধা করে থাকে। লার্ভা থেকে পোপা এবং সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ এডিস মশায় রূপান্তরিত হয় এবং এই পুরো প্রক্রিয়াটি ১২ দিনে সম্পন্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ ১২ দিনে একটি থেকে ১৫০টি এবং পরবর্তী ১২ দিনে ১৫০টির প্রতিটি থেকে ১৫০ হারে মোট ২২৫০০ এবং ১২ দিন অন্তর অন্তর গুণিতক নিয়মে বংশবৃদ্ধি হতে থাকে। তাই ডেঙ্গুজ্বর নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ডেঙ্গুর বাহক এই এডিস মশাকে নির্মূল করতে হবে।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফলতা পেতে হলে কয়েকটি কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে। প্রথমত ডেঙ্গু রোগী দ্রুত শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র শনাক্ত করে তা নির্মূল করে এডিস মশার বংশ বিস্তার রুখে দিতে হবে। তৃতীয় কাজটি হলো ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী থেকে যাতে ভাইরাসটি কোনোমতেই কোনো মশার দেহে সঞ্চারিত হতে না পারে অর্থাৎ রোগীকে যেন মশা কোনোভাবেই কামড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া। জ্বর শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পর দেহে এন্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। দেহে ডেঙ্গুর এন্টিবডি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর আর ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ থাকে না। মাঝখানের এই সময়টা রোগীকে মশারির ভেতর রাখলে এবং ফুলহাতা জামাকাপড় পরে থাকলে এবং প্রটেক্টিং লোশন ব্যবহারে সুফল পাওয়া যেতে পারে। তৃতীয় কাজটি সহজ হলেও প্রথম দুটি কাজ খুব একটা সহজ নয়।
যেহেতু ডেঙ্গুজ্বরটি এবার সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাই ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও এর দ্রুত চিকিৎসার বিষয়টি সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে নিশ্চিত করতে হবে। ডেঙ্গু এন্টিজেন নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কিটস সরবরাহ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য একটি প্রটোকল ঠিক করে দিতে হবে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে টার্শিয়ারি লেভেল হাসপাতাল অবধি। সঙ্গে রেফারেলের গাইডলাইনও দিতে হবে।
সবচেয়ে কঠিন কাজ হবে প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করা। কারণ ডেঙ্গুবাহক স্ত্রী এডিস মশার প্রজননক্ষেত্রটি চার দেয়ালের ভেতর। আঙিনায় সিটি করপোরেশনের ফগার মেশিন পৌঁছাতে পারলেও বাসার ভেতরে, ছাদে, গ্যারাজে, ছাদবাগানে, বারান্দায় টবে, ঘরের ভেতর মানি প্লান্টে বা ফুলদানিতে পৌঁছাতে পারবে না। ভেতরের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে অবশ্যই নগরবাসীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নগরবাসীকে আস্থায় পেতে হলে সিটি করপোরেশনকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করা এবং লার্ভা ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় লার্ভিসাইড বা অন্যান্য কেমিক্যাল সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। মশা নির্মূল অভিযানের একটি রোডম্যাপ ঠিক করতে হবে এবং নিয়মিত এবং সমন্বিতভাবে মশা নির্মূল অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তা না হলে উত্তরের মশা দক্ষিণে এবং দক্ষিণের মশা উত্তরে যাওয়া-আসার পাশাপাশি আঙিনার মশা ঘরে এবং ঘরের মশা আঙিনায় যাওয়া-আসা করতে থাকবে। যেহেতু এডিস মশার প্রজননক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে ড্রেনেজ সিস্টেমের সংযোগ নেই তাই এই কার্যক্রমে লার্ভিসাইড ব্যবহার করা সাশ্রয়ী হবে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা আরও ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন। ধরে নিতে হবে, ডেঙ্গু আরও অনেক বছর আমাদের ভোগাবে, তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে।
ডা. ছায়েদুল হক : চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক
sayedul.hq@gmail.com