হত্যাকারীরাও তো দেশের সেরা মেধাবী!
নিয়ন মতিয়ুল
রাজনীতি নিয়ে কথা বললেই ‘ফাঁদে’ পড়তে হয়। আপনি যা-ই বলবেন, তা-ই কোনো না কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে যাবে। আর তখনই পড়তে হবে মুশকিলে। যাদের বিরুদ্ধে চলে যায় তারা আপনাকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ছাড়বে। নোংরা ঘাটতে চাই না বলেই বর্তমান ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সাধারণত কথা বলার ধৈর্য হয় না আমার।
তবে এবার জোর গলায় বলতে চাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। বন্ধ হোক মেধাবীদের নোংরা রাজনীতিতে এনে রক্তাক্ত হওয়ার পথ। মেধাবী হবু প্রকৌশলী, চিকিৎসক, গবেষকদের রাজনীতিতে টেনে আনার কোনো মানে হয় না। রক্তাক্ত রাজনীতিতে তাদের ঢুকিয়ে দিয়ে কার কী স্বার্থ উদ্ধার হচ্ছে- সেটা জানা জরুরি।
ছাত্ররাজনীতির সোনালি অতীত নিয়ে আমরা প্রায়ই ফ্যান্টাসিতে ডুবে যাই। এখনও ভাবি সেই ফেলে আসা বায়ান্ন, বাষট্টি, একাত্তর কিংবা নব্বইয়ের কথা। কিন্তু আমাদের সেই স্মৃতিকাতরময় অতীতের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিলই খুঁজে পাই না। এটা যারা বুঝেও বোঝেন না তারা অতীতেই পড়ে আছেন। বলা যায়, তারা ফ্যান্টাসির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। যারা নোংরা রাজনীতির কালো থাবা থেকে আজও রক্ষা করতে পারেননি ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যকে।
নষ্ট রাজনীতিকদের নষ্ট মানসিকতার ছোবলে হিংসা, লোভ, আধিপত্যবাদে আজ নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এ কারণেই শিক্ষিত আর অশিক্ষিতদের সীমারেখা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। আদর্শ আর মূল্যবোধহীন পরিমÐলে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ছে আজকের মেধাবী তরুণরা। অনেকে বেছে নিচ্ছে চরমপন্থা। যেখান থেকে নিশ্চিতভাবেই ফিরতে হবে, ফেরাতে হবে।
বিদগ্ধজনেরা বলেন, দেশ বা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে রাজনীতির বাস্তব জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সেজন্যই ছাত্ররাজনীতির চর্চাটা বেশি প্রয়োজন। অতি উৎসাহীরা বলেন, যারা ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসবেন তারাই শুধু রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। এসব কথাবার্তা আমার কাছে নিতান্তই সেকেলে মনে হয়। কখনও আধুনিকতাবিরুদ্ধ বলেও মেনে নিতে কষ্ট হয়।
ছাত্ররাজনীতির এমন নোংরা চেহারা আপনি কতটা দেশে দেখেছেন? কোন কোন দেশে দেখেছেন? ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে এমন নৃশংসভাবে হত্যার রীতি কোন কোন দেশে আছে, আমার জানা নেই। তবে এটা জানি, যারা রাজনীতিকে ব্যবহার করে এমন হত্যাকাÐ ঘটাতে পারে তারা কখনও কোনো জাতির ভবিষ্যতের ধারক, বাহক হতে পারেন না।
ভিন্নমতের কারণে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠেছে দেশজুড়েই। শিক্ষার্থী আর শিক্ষকরা মিলে তাদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত করছেন। পারলে এক্ষুণি তাদের ফাঁসি দিয়ে দিলে তারা শান্ত হন, জাতির মনেও শান্তি আসে। বিচার ব্যবস্থাকে বাহাবা দেয়া যায়, যেন ফাহাদের আত্মাও শান্তি পায়।
কিন্তু একবারের জন্যও কি ভাবছি, হত্যাকারীরাও বুয়েটের শিক্ষার্থী। তারাও প্রচÐ মেধাবী। সারাদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তারাও ভর্তি হয়েছিলেন স্বপ্নের বুয়েটে। তাদেরও রয়েছে পরিবার, মা, ভাই, বোন, আত্মীয় পরিজন। তাদের চোখ-মুখের দিকে একবার তাকান। তারা তো ভিনগ্রহ থেকে আসেনি। তাদের কথা কি একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না কারো? তাদের জীবনও তো হারিয়ে যাচ্ছে বø্যাকহোলে। যারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অগ্রসৈনিক হতে পারতো, দেশকে বিশ্বের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে অবদান রাখতে পারতো।
শৈশব-কৈশোরে বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন দেখেননি এমন শিক্ষিত মেধাবী আমাদের সমাজে খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। বুয়েটকে আমরা দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের ক্যাম্পাস হিসেবে দেখি। যেকোনো মেধাবী আর তার অভিভাবকদের প্রধান লক্ষ্যই থাকে এ প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর গবেষণা নিয়ে রাতদিন ব্যস্ত থাকতে হয়। আগামীর পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেদের তৈরি করতে হয় তিল তিল করে। যেখানে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে অভিভাবকরাও থাকেন নিশ্চিত নির্ভাবনায়। অথচ সেই স্বপ্নসম্ভাবনার প্রতিষ্ঠানের একঝাঁক উজ্জ্বল তারকার ভয়ঙ্কর পতন ঘটছে আমাদের চোখের সামনেই।
প্রশ্ন হলো, জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহাবিপ্লবের যে পৃথিবীতে প্রতি ২৫ বছরে জ্ঞান দ্বিগুণ হচ্ছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে প্রতিমুহূর্তে কোটি কোটি তরুণকে লড়াই করতে হচ্ছে, সেখানে একজন বিজ্ঞান প্রযুক্তির ছাত্রকে দিয়ে রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের যৌক্তিকতা কতটুকু? যারা জ্ঞানের দিগন্তে আলো ফেলে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তিময় সভ্যতার জন্য নতুন পথ রচনা করবে তাদের হাত কেন রক্তাক্ত হবে ভিন্নমত দমনে? যেখানে ভিন্নমতই তাদের প্রতিদিনের জ্ঞান স¤প্রসারণের হাতিয়ার?
বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা যখন আমরা জানতে পেরেছি, তখন নিশ্চিতভাবেই আঁতকে উঠেছি। ভেতর থেকে কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছি, ইস! আবারো? আর কতদিন এভাবে? এমন প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত প্রচলিত রাজনীতির অন্ধকারের প্রতি প্রবল ঘৃণা, প্রবল অসহায়ত্ব। খবর শোনার পর থেকেই সন্তানদের ভবিষ্যতের ভাবনা নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। যে মেধাবী সন্তানটি সবকিছুতেই প্রশ্ন করছে, সমাজের অনিয়ম নিয়ে কথা বলছে, কৌতুহলী হচ্ছে, তাদের জন্যই এখন আমাদের ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বেশি। এর শেষ কোথায়? কবে? তা নিয়ে অনিশ্চিত ভাবনায় বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি আমরা।
দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ মেধাবীদের নৃশংস হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে টিভির টকশোর অতিথি টকাররা নষ্ট রাজনীতির দিকে ইঙ্গিত করছেন। স্বাধীনতার পর মূলধারার রাজনীতির চেহারা পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে যার যোগসূত্র রয়েছে বলে দাবি করছেন। তাদের উপলব্ধি, একদা রাজনীতিতে ছিল আদর্শ, নীতি, প্রবল মানবতা। যা গোটা সমাজকেই দিত শান্তির সুবার্তা। তবে কালের অভিঘাতে ধীরে ধীরে যেমন রাজনীতি থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে প্রচলিত নীতি-আদর্শ, তেমনি বিভ্রান্তিতে পথ হারাচ্ছে ছাত্ররাজনীতিও।
অপ্রীতিকর হলেও সত্য, আজ ছাত্ররাজনীতির প্রধান আদর্শ হয়ে উঠেছে অর্থ, ক্ষমতা, আধিপত্য, দমন-পীড়ন। যার দৃষ্টান্ত দেখতে পাচ্ছি প্রতিনিয়তই। মূলধারার রাজনৈতিক দলের আন্দোলন সংগ্রামের ফ্রন্টফাইটার খ্যাত ‘পথহারা’ ছাত্ররাজনীতিকে সুপথে আনতে কম গলদঘর্ম হচ্ছেন না কেউ কেউ। তবে কোনোভাবেই বাগে আনা সম্ভব হচ্ছে না ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যবাহী চরিত্রকে।
একদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনের চরম নৃশংসতায় বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে সেনাশাসকদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে। একই সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনকেও নৃশংসতার চরম দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করতে দেখা যেতো।
ছাত্ররাজনীতির বদলে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেও। ‘সোনালি অতীতের সুগন্ধ মাখা’ ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার পরেও নানা অঘটন ঘটেই চলেছে। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার ভয়ে তাদের নিয়ে কেউ কথা বলেন না। তবে ‘অন্ধ হলে যে প্রলয় বন্ধ থাকে না’ সেটা নতুন করে বুঝে নিতে হচ্ছে আমাদের।
দুয়েকটি ছাড়া আমাদের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকরা রাজনীতি নিয়ে পঞ্চাশ দশকের ফ্যান্টাসিতে ভোগেন। কখনও কখনও দিবাস্বপ্নও দেখেন। সামনের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে ভাবতেই পারেন না। হয়তো চানও না। পঞ্চাশ দশকের ‘অস্ত্র’ দিয়ে একবিংশ শতকের শত্রæ নিধন করতে চান তারা। নতুন ‘অস্ত্র’ তৈরির উদ্যোগ নেই। টকশোর অতিথিরা অতীতের মধুর স্মৃতি রোমন্থন আর নীতিকথা আওড়ানো ছাড়া আর কিছুই করেন না। বেশিরভাগ রাজনীতিকের কথা শুনলে মনে হয়, ধ্যান-ধারণায়, চিন্তা-চেতনায় তারা বৃটিশ আমলেই পড়ে আছেন।
এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ছাত্ররাজনীতির একবিংশ শতকের কাঠামো তৈরি সত্যিই চ্যালেঞ্জিং। সেই সঙ্গে আজকের ছাত্রনেতাদেরও একবিংশ শতকের জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষ হয়ে বিগত শতকের নীতি আদর্শের দীক্ষা নেয়া মোটেই সম্ভব নয়। আর বিশ্বজুড়েই রাজনীতির মূল সুরে যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি আর বিশ্ববাণিজ্যের নানা সমীকরণ। অত্যাধুনিক এ সভ্যতায় রাজনীতি ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে গেøাবার হিউম্যান টেকনোলজিতে। যেখানে প্রচলিত নীতি আদর্শ কোনো কাজেই আসবে না। ঠিক তেমনি এক সময়ে এসে পেশাশক্তির মাথামোটা, প্রযুক্তি জ্ঞানহীন, অর্থ, ক্ষমতা, আধিপত্য, দমন-পীড়নে মত্ত অমানবিক হিংস্র হতে দীক্ষা দেয় এমন ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন আছে কি?
আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা বলছি, তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তিজ্ঞানে বিশ্বমানের দক্ষ করে তোলার কথা বলছি, কারিগরি শিক্ষার প্রসারের কথা বলছি, প্রযুক্তিখাতে লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের কথা বলে চলছি। আবার আমরা অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলছি, প্রবৃদ্ধির কথা বলছি, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার বার্তা দিচ্ছি। কিন্তু বিজ্ঞান প্রযুক্তির গবেষণা, উদ্ভাবনী খাতে বিনিয়োগ কি সে মাত্রায় বাড়িয়েছি? শিক্ষার মান উন্নয়নে বাজেটে কি খুব বেশি মনোযোগ দিয়েছি?
এসব প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আমরা নতুন প্রজন্মকে ‘খুনি-হিংস্র নেতা’ হিসেবে গড়ে তুলবো নাকি আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সভ্যতার দক্ষ কারিগর বানাবো সে উত্তরটাও এর মধ্যেই নিহিত। তাছাড়া আমাদের কোনটা আগে প্রয়োজন- নীতি আদর্শহীন নেতা না মানবিক গুণসম্পন্ন উন্নত মেধা মননের মানুষ?
লেখক: সাংবাদিক।
mineon71@gmail.com