মুহাম্মদ মূসা
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ‘উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ কেলেঙ্কারীরর অভিযোগ’ নিয়ে চলছে আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের ধারাবাহিক কর্মসূচী। উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ আন্দোলন এখন দেশব্যাপী সবার মুখে। সব মিলিয়ে বলা যায়- একরকম অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হতে যাচ্ছে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাস হওয়া ১৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পই কী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাল হয়ে দাড়িয়েছে? কী আছে এই আন্দোলনে? কেন হচ্ছে এই আন্দোলন? আন্দোলনকারীদের ‘প্রকৃত চাওয়া’ কী? অনেকের মনেই এ প্রশ্ন। উত্তরটা সবার জানা দরকার। আন্দোলনের গতিবিধি লক্ষ্য করলেই পেয়ে যাবেন প্রশ্নগুলোর উত্তর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার প্রকল্প পাস করে। গত বছরের ২৩ অক্টেবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পটির অনুমোদন দেন। প্রকল্পটি পাস করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আবাসিক সুবিধা সহ অন্যান্য সুবিধাসমূহ সম্প্রসারণের জন্য। থাকছে শিক্ষা ও গবেষণা উপকরণ সরবরাহ সহ প্রযুক্তিগত শিক্ষার মান উন্নয়নের দিকও।
প্রকল্পের আওতায় থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ছয়টি ১০তলা বিশিষ্ট আবাসিক হল, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট পাঁচটি এবং কর্মচারীদের জন্য তিনটি আবাসিক ভবন, ১ টি লেকচার থিয়েটার ও পরীক্ষার হল, একটি প্রশাসনিক ভবন, সাত তলা বিশিষ্ট একটি নতুন লাইব্রেরি ভবন ও একটি স্পোর্টস কমপ্লেক্স। এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি পিক আপ, একটি মিনিবাস ও দুইটি অ্যাম্বুলেন্স কেনার কথা রয়েছে।
এখন আসি আন্দোলনের প্রসঙ্গে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্পের অনুমোদনের পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বর্তমানে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেই সেদিন উপাচার্যকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পই কাল হয়ে দাড়ায় বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য। শুরু হয় নানামূখী আন্দোলন। জাকসু দাবিতে আন্দোলন, সেশনজট নিরসন দাবিতে আন্দোলন, উন্নয়ন ফি কমানোর দাবিতে আন্দোলন, হলে সিটের দাবিতে আন্দোলন সহ অনেক ইস্যু। এগুলো শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এছাড়াও রয়েছে শিক্ষকদের আন্দোলন। উপাচার্য পদের জন্য ভিসি প্যানেল নির্বাচন, শিক্ষক সমিতির নির্বাচন, সিনেট-সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল সহ কয়েকটি দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন। একের পর এক আন্দোলন চলছেই।
একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে। অন্যদিকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে একনেক। ২৩ অক্টোবর ২০১৮ তে অনুমোদন হওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে ২০২২ সালের মধ্যে। কাজ শুরু করতে হবে ২০১৯ এর জুনের মধ্যেই। এতোকিছুর মধ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। প্রকল্পের কাজের প্রথম ধাপ মাস্টারপ্ল্যান।
২০১৫ সালে অধিকতর উন্নয়নের জন্য বর্তমান প্রশাসন ৩১৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকার একটি প্রাথমিক প্রকল্প একনেকে জমা দেয়। তখনই আলোচনায় আসে মাস্টারপ্ল্যান। একনেক থেকে বলা হয়, প্রকল্প অনুমোদনের জন্য একটি ত্রিমাত্রিক (থ্রি-ডি) মাস্টারপ্ল্যান এ প্রস্তাবিত প্রকল্পের সাথে জমা দিতে হবে। এর পর থেকে শুরু হয় নিয়ে কাজ। সামনে আসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থপতি মাজহারুল ইসলামের ১৯৭০ সালে তৈরি একটি মাস্টারপ্ল্যান। পরবর্তীতে ওই মাস্টারপ্ল্যানের মূল কাঠামো ঠিক রেখে বুয়েটের স্থপতি ও প্ল্যানারদের সহযোগীতায় তৈরি হয় সংশোধিত মাস্টারপ্ল্যান। এ সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য গঠিত কমিটিতেও বর্তমানে আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন। তখন তাদের অসম্মতি না থাকলেও পরবর্তীতে এর বিপক্ষে অবস্থান নেন তাঁরা। শুরু হয় বিতর্ক।
মাস্টারপ্ল্যানে জিওলজিক্যাল সার্ভে, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর স্টাডি, ভবিষ্যৎ প্রাক্কলন, স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ, উন্মুক্ত আলোচনা সহ কয়েকটি বিষয় অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও মাস্টারপ্ল্যানে ফিজিবিলিটি স্টাডি, ড্রেনেজ সিস্টেম, ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম সহ কয়েকটি বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে বলে প্রশ্ন ওঠে। এর প্রেক্ষিতে শুরু হয় আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের আহবানে সাড়া দিয়ে উপাচার্য মাস্টারপ্ল্যান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। দুইটি আবাসিক হল স্থানান্তর সহ কয়েকটি বিষয় সংশোধনীর প্রস্তাব দেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এসব প্রস্তাব বিবেচনাধীন রেখে মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন উপাচার্য।
কয়েকদিন পরে শুরু হয় কার্যক্রম। গত ৩০ জুন উপাচার্য পাঁচটি হলের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। এরপরই আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। দুইটি হল স্থানান্তর না করে কাজ বন্ধ রাখার দাবি করে শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে নির্ধারিত স্থানের গাছ কাটায় শুরু হয় বিক্ষোভ শুরু করে। কাঁটা গাছে কাফন জড়িয়ে মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্যমঞ্চ’র ব্যানারে শুরু হয় আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা তিনদফা দাবি জানান উপাচার্যের কাছে। উপাচার্যও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় তাদের প্রধান দুটি দাবি অর্থাৎ ছাত্র হল তৈরির জায়গা পুনর্র্নিধারণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম রিভিউ কমিটি পুনর্গঠনে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
এদিকে সমান্তরালভাবে সূত্রপাত হয় আরেক ইস্যুর। অভিযোগ ওঠে অর্থ কেলেঙ্কারীর। একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদে মধ্যে ২ কোটি টাকা ভাগ-বটোয়ারা করার খবর ছড়িয়ে পরে চারদিকে। তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও বায়বীয় এ খবরে দানাবাঁধে আন্দোলন। এ আন্দোলনে ঘি ঢালে বিএনপির একাধিক কেন্দ্রিয় নেতা। তাদের বক্তব্যের পরপরই বেশ তোড় জোর নিয়ে মাঠে নামেন শিক্ষকরা। যদিও আন্দোলনের শুরু থেকেই কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে থেকেছেন; বিএনপির হস্তক্ষেপের পর এ সংখ্যাটা রাতারাতি বেড়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীন ইস্যু হয়ে ওঠে জাতীয় –ইস্যু। একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও চলে যায় এ সংবাদ। বড় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয় একাধিক স্বার্থান্বেষী মহল।
মাস্টারপ্ল্যান সংশোধন সহ তিনটি দাবি নিয়ে প্রশাসনের সাথে দ্বিতীয়দফা বৈঠক করে আন্দোলনকারীরা। উপাচার্য সহনশীল আলোচনায় যেতে চাইলেও হঠাৎ গতি পরিবর্তন করে আন্দোলনকারীরা। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করে আন্দোলনকারীরা। বিএনপিপন্থী ও বামপন্থী শিক্ষকদের কয়েকজনও এতে যোগ দেন। আন্দোলন চাঙ্গা করতে অব্যহত রাখা হয় ধারাবাহিক কর্মসূচী। টানা তিন দিন প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করে তারা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মধ্যেও আন্দোলনকারীদের কর্র্মসূচী অব্যাহত থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ না থাকলেও চলছে আন্দোলন। কখনও বা আন্দোরনের নামে ঝুলছে শুধু ব্যানার।
আন্দোলনের সর্বশেষ ইস্যু হচ্ছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ। অভিযোগ ওঠে দুই কোটি টাকা লেনদেনের। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের বক্তব্য ধরেই চলছে আন্দোলন। তারা কখনও বলছেন প্রকল্প থেকে টাকা দিয়েছে; কখনও বলছেন অর্থ লেনদেন হয়নি। এমন বায়বীয় এক সংবাদ, ফোনালাপ ভিত্তি করেই চলছে আন্দোলন। এদিকে প্রথম দিকে অর্থ কেলেঙ্কারীরর অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে চুপচাপ থাকলেও প্রতিবাদ করতে অনেকটা বাধ্য হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রশাসন বলছে, যেখানে প্রকল্পের জন্য অর্থ ছাড়ই হয়নি সেখানে ঘুষ প্রদানের প্রশ্নই ওঠে না।
এদিকে আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা ও উপাচার্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক আন্দোলনের প্রতিবাদে মুখ খুলেছে শিক্ষকরা। আন্দোলন প্রতিহত করতে মাঠে নেমেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- কর্মকর্তা- কর্মচারীরা। তৈরি হয়েছে ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং উন্নয়নের পক্ষে জাহাঙ্গীরনগর’ নামে নতুন প্লাটফর্ম। মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রমূলক আন্দোলন বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সহযোগীতার আহবান জানান তারা। এ ব্যানারের আওতায় অন্তত ৩০০ শিক্ষক-কর্মকর্তার অংশগ্রহণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচী পালন করেন। আন্দোলনের প্রতিবাদে শিক্ষকদের এতো বড় উপস্থিতি আন্দোলনকে নিঃসন্দেহে অযৌক্তিক বলে প্রমাণ করে।
যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও মাঠ ছাড়ছে না আন্দোলনকারীরা। কোনো না কোনো কর্মসূচী দিয়ে আলোচনায় থাকতে চান তারা। যে কোনো ইস্যুতেই উঠে আসে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি। সময়ের পরিক্রমায় মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনের দাবি পরিণত হয়েছে উপাচার্যের পতদ্যাগ দাবিতে। আর এ দাবি শুধু জাহাঙ্গীরনগরের আন্দোলনকারীদেরই নয়। দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে আন্দোলন। আর সম্প্রতি যেকোনো ইস্যুতে আন্দোলন শুরু হলেই দাবি ওঠে ‘উপাচার্যের পদত্যাগ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও চলছে আন্দোলন। আর দেখা যায় দাবি পূরণের পরেও চলতে থাকে এসব আন্দোলন। যেন আন্দোলনেই প্রশান্তি। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে একত্রে চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয় যে আন্দোলন কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নয়। বরং এটা সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কেই অস্থিতিশীল করার পায়তারা। যেখানেই ষড়যন্ত্র যথেষ্ট সক্ষমতা পায় সেখানেই গড়ে ওঠে আন্দোলন। আর এসব আন্দোলনে বিশেষ মহলের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলেরও বিশেষ কৌশল বলা যায়। সব শেষে প্রশ্ন ওঠে ‘ চলমান আন্দোলন সরকারের সাথে চ্যালেঞ্জ নয়তো?’
মুহাম্মদ মূসা: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
md.musaju@gmail.com