প্রেম নিরন্তর, প্রেম ঐশ্বরিক। লাইলী মজনু, ইউসুফ জোলেখা, শিরি ফরহাদ এসব ইতিহাস সিদ্ধ প্রেম ভালবাসার সঙ্গে ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রেম দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল জানিনা। ছোট বেলার লাইলী মজনু যাত্রা, রাত জেগে থেকে শুনা, আঙ্গুলও কাটিলিরে লাইলী কলম তুলাইতে…। প্রেম একবার এসেছিল নিরবে… ভালবাসা কাকে বলে আমিত না জানি… আবার ইউসুফের অপরূপ সৌন্দর্যে জোলেখা ফল কাটতে আঙ্গুল কেটে ফেলা এসব যাত্রা, গান কথা যখন স্মরণে আসে তখন মনের অজান্তেই ভেসে আসে ইলিয়াস কাঞ্চন’র নিরাপদ সড়ক প্রেম।
মরে গিয়ে সড়ক প্রেম দিয়ে গেল জাহানারা ? এ এক অবিস্মরণীয় প্রেম-সংস্কার। তাজমহলকেও হার মানায়। বেঁচে থেকে কাঞ্চন প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছে শুধু জাহানারার প্রেমকে নয়, সারা দেশ দুনিয়া জাহানের মানবিক ভালবাসাকে। তাই জানান দেয়া হয় এ প্রেম সংস্করণ সামাজিক আন্দোলনের সফলতায় বড় বাণী হলো, পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়।
জাহানারার মৃত্যুতে যে বীজ ইলিয়াসকে নাড়া দিল সে উপাখ্যানের ২৬ বছরের আন্দোলন আজ সার্বজনীন। বলা যায় An Idea becomes a Movement, the movement becomes an Organisation, the organisation becomes an Institution & there lies the Death of the idea’.
তবে দেখা যায় এই উদ্বৃতিকে এখানে অসত্য প্রমাণ করেছে। আইডিয়ার মৃত্যু না হয়ে সরকার এবং অসরকার মিলে আরো শক্তিশালী হয়ে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের দিকে যাচ্ছে। সরকার বিশেষ করে লেখক অকৃপণ ও পরশ্রীকাতরহীন মানবদরদী মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নাম শিরোনামকে শুধু নয় বরং দিনটিকে (২২ অক্টোবর) পর্যন্ত রাষ্ট্রিয় দিবস ঘোষণা করেছেন। যা সরকার-অসরকার একাকার হওয়ার এক মন দান ঘোষণা ও দলিল। বাস্তবায়নে ঘাত প্রতিঘাত বাঁধা বিপত্তি থাকবেই। মসৃন কিছুই হয় না। তাই এগিয়ে নেয়ার জন্য ১ অক্টোবর প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে আন্দোলন প্রধান শুধু ২২ অক্টোবর দিবস নয় তা ঠেলে ৩০ পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো মাস ব্যাপি নিরাপদ সড়ক’র আওয়াজও জানান দেয়া হচ্ছে- আমরাও আছি সতর্ক প্রহরায়।
২০১৭ সালে ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতী একটি ইতিহাস। আমরা সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন হচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট, সৌদি আরবসহ বিদেশে। ইতোমধ্যে ইলিয়াস কাঞ্চন ‘নিরাপদ সড়ক রাজ’ হিসাবেও অনেকের কাছে পরিচিত।
প্রেস কনফারেন্স ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ২৬ বছর আগে কেন এবং কি প্রেক্ষাপটে আমি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন শুরু করেছিলাম তা আপনাদের অজানা নয়। আমার স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর আমি যখন চলচ্চিত্র জগৎ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম তখন আমার কিছু শুভাকাংখীসহ ঠিক করলাম, স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার জন্য নয় বরং এদেশের জনগণকে সড়কের মড়ক থেকে রক্ষার জন্য এই আন্দোলন গড়ে তোলা। ‘নিরাপদ’ এখন সকলের চাহিদা ত্যাগও শ্রমের বিনিময়ের ফসল। কথা নয় কাজ। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে দেশের সর্বত্র সভা, সমাবেশ ও র্যালী, চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ, কর্মশালা পরিচালনা, বাস টার্মিনালসমূহে চালক ও যাত্রীদের মাঝে ক্যাম্পেইন, শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ, অভিভাবক সম্পৃক্ত করা, আগামী প্রজন্মের জন্য শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, সর্বোপরি মিডিয়া সমস্বরে আওয়াজ ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আজকের অবস্থানে আসার সংগ্রামের অর্জন। আনরেজিস্টার্ড গাড়ী তথা নসিমন, করিমন, ইজিবাইক, ভটভটি, মোটরসাইকেল মিলিয়ে এসংখ্যা হবে প্রায় ৬০ লাখ। সড়কের পরিধি বৃদ্ধি সচেতনতা সৃষ্টি হলেও এখনও সড়ক দুর্ঘটনা তুলনামূলক কমেনি। হয়নি উন্নয়ন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে সমস্যার গভীরে গিয়ে যোগ্যচালক তৈরি, প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স বিহীনদেরকে লাইসেন্সের আওতায় আনা, যোগ্যতা সাপেক্ষে ভারী যান চালানোর লাইসেন্স প্রদান, সড়ক-মহাসড়কের ত্রুটি নিরসনে নির্দেশ প্রদান করেছেন। এত্তসব সম্মিলিত উদ্যোগের পরেও কি কারণে প্রতিনিয়ত ধ্বংসস্তুপ দেখার পরেও সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ছে না ? সড়ক-জনপথ অব্যবস্থাপনায় মন ভারাক্রান্ত। এ জন্য মানসিকতা পরিবর্তনের লক্ষ্যে আরও কাজ আছে। প্রতীক্ষিত ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এর বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা সকলেই শংকিত, উদ্বিগ্ন। প্রায় ২ বছর হয়ে গেল এই আইন পাশ হলো। কোন বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। আমরা জানিয়েছি আইনটির শিরোনাম ‘সড়ক পরিবহন ও সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৮, সড়ক দুর্ঘটনায় শাস্তির মেয়াদ দশ বছর করা, অবৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং লাইসেন্সবিহীন ও ফিটনেসবিহীন গাড়ী চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটালে এবং তাতে কারো মৃত্যু হলে মামলা ৩০২ ধারায় হবে উল্লেখযোগ্য।
২০১২ সাল থেকে এই আইনটি পাশ করার উদ্যোগ ছিল। জনগণের পাশাপাশি গত ২০১৮ সালে রোষে-ক্ষোভে কোমলমতী শিক্ষার্থীদের রাজপথে নেমে আসা, প্রজন্ম ভিত ছেলে মেয়েরা অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত রেখে গেল। পুরো দেশের মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। প্রতীক্ষিত নিরাপদ সড়ক চাই গণমানুষের আশা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একইসঙ্গে, সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নের দাবী চলমান থাকে। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ-গরজ এত ধীরে কেন ? কোন গোষ্টির স্বার্থে ?
সরকার কর্তৃক ঘোষিত ও পালনকৃত ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০১৯ কে কেন্দ্র করে এবং জাহানারা কাঞ্চনের ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষে অক্টোবর মাস জুড়ে নিরাপদ সড়ক চাই পক্ষ বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জীবনের আগে জীবিকা নয়, সড়ক দুর্ঘটনা আর নয়’।
মাস ব্যাপি সারাদেশ তথা ঢাকা থেকে শুরু করা আন্দোলন কর্মসূচি পোর্ট সিটি চট্টগ্রামে সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে। ঐদিন কাজের মালাকার ‘নিরাপদ সড়ক রাজ’ ইলিয়াস, কাজ দিয়েই পিটিআইতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা মধ্যে দিয়ে ইতি টানবেন। ২২ অক্টোবর একদিনের দিবস নয়। প্রতিদিন। সারা বছর কার্যক্রম ছড়িয়ে দেশকে এগিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার মহামারী থেকে মুক্তির আশাবাদ সকলের।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শহীদ জনণী ‘জাহানারা’ ইমাম আর আমাদের সড়ক দুর্ঘটনায় জীবন দিয়ে পথ প্রদর্শক ‘জাহানারা’ উভয়ের মধ্যে মুক্তির চেতনার বীজ গ্রথীত। একটি ‘সম্প্রীতির’ মুক্তি। আপরটি দুর্ঘটনার মড়ক রোধে মুক্তি। আন্দোলন প্রতিচ্ছবিতে প্রেম প্রীতি উত্থান পতন, নায়ক, ভিলেন, দ্বন্ধ বিচ্ছেদ খুব একটা ছিলনা বলা যায়না। কিন্তু ছিল এক প্রাপ্তির তাড়নার দীর্ঘ সড়ক পথ ২৬ বছর অতিক্রম।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শুধু সড়ক বিষয়ক চিন্তা করলে হবে না। এটা উন্নয়নের সামগ্রীকতায়ও আনতে হবে। নতুবা ক্যাসিনো সম্রাট নায়ক মহা নায়কদের মত দূর্নীতির আখড়ার ভিলেন হিসাবেই তারা থেকে যাবে। দূর্নীতির মূল নায়করা ফাঁক ফোকড় বের করে কোণায় কাণায় পলায়ন পর থেকে তছবিহ টিপবেন। সুযোগ বুঝে আবার যায়গা মত বসে যাবে।
তাই সামগ্রীকতা নিয়ে এসডিজির ১নং এজেন্ডা দারিদ্র বিমোচনকে লক্ষ্যে এনেই এগুতে হবে। Poverty and Peace can not walk together. ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে গরীবি হটান ও সম্পদ বৈষম্য দূরীকরন এজেন্ডাও থাকতে হবে। সড়কে যেমন শৃঙ্খলা প্রয়োজন, তার চেয়ে অধিক প্রয়োজন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। সরকার পরিচালিত মাতৃত্বকালীন ভাতা ও স্বপ্ন প্যাকেজ কার্যক্রমই এর নিরাপদ করতে পারে। তাহলেই দেশ ও জাতি টেকসইভাবে নিরাপদ থাকবে। মালিক শ্রমিক তথা চালক সড়ক মান স-ব নিয়েই শোষন ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় সোনার ফসল ফলবে। নিরাপদ জাহান গড়বে।
প্রসঙ্গত: আমার পিতা ডাঃ মফিজুর রহমান ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ইং সনে কানাডার টরেন্টোর অনাতিদূর হেমিলটনে তাবলীগি দাওয়াত পথে বরফ ঝড়ে বৃষ্টিতে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন, ২ জন তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরন করেন। তিনি মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ সময়, পঙ্গুত্ব ও কর্মহীন-জ্ঞানহীন হয়ে অপরপারে চলে যান। কাজেই দেশ বিদেশেও এই মড়ক আছে। এটাও একটা মন-রশি যে, আমি নিসচাইর সঙ্গে সেই প্রথম থেকে অদ্যাবধি আছি ও থাকব। একই সঙ্গে ‘দখলমুক্ত ফুটপাত চাই’ ব্যানার ও অনেকের হাতে ছিল মানববন্ধন ও মিছিলে। আমাদের প্রিয় বাংলা মাতৃ ভাষা যেমন আজ মাতৃভাষা দিবস আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে। তেমনি নিরাপদ সড়ক চাই দিবস ও সারা জাহান-এ পালিত হোক এ দাবীও রাখছি। তাহলেই সড়কে মৃত্যুর মিছিলের হাজারো জাহানারার আত্মা শান্তি পাবে। ধন-সম্পদ লোভী মালিকদের শোষণ শাসন মানসিকতা থেকে, শোষিত সম্পদহীন করে রাখা চালক, শ্রমিক মেকানিকদের আর বৈষম্য ও শ্রম ঘন্টার অধিকার সংরক্ষনে সুষ্ঠু আয় বন্টন অধিকার থাকতে হবে।
ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রবেশ করলেন, জাহানারাকে জাহানবাসীর কাছে জানান দেয়া, যাতে এভাবে আর কাউর প্রাণ দিতে না হয়। রোগের চিকিৎসার জন্য আপাত ব্যবস্থা হতে পারে, কিন্তু রোগ যাতে না হয় সে ব্যবস্থা অবিশ্যি দীর্ঘ মেয়াদিভাবেই গ্রহণ করতে হবে। তা এসডিজি ১নং এজেন্ডাই সাব্যস্ত করা আছে ‘দারিদ্র বিমোচন’। সাম্যতা ও ন্যায্যতার মধ্যেই তা অন্তর্নিহীত। যা move করে তা-ই Movement। ছাত্র-ছাত্রীদের সৃষ্ট আন্দোলন move করার দৃষ্টান্ত। সরকার অসরকার ছাত্র-জনতা একাকার হয়েই আইন তৈরী হয়েছে। কাজেই তার উপর ছুরিকাটা বা পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়। যা দেখলাম গত ৩ অক্টোবর ২০১৯ শহীদ আবুতালেব হাই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা জানান দিল, আইনে কোন অবস্থাতেই কোন শিথিল গ্রহণযোগ্য হবেনা, প্রয়োজনে আবার সড়কে নামবে। ইলিয়াস কাঞ্চন মাস পালন দিনে প্রজেক্টরের মাধ্যমে তন্ন তন্ন করে সেশান নিলেন নিরাপদ সড়ক সৃষ্টি কল্পে দূর্ঘটনার কারণ। যত যন্ত্র-মন্ত্র-কলা কৌশল। সঙ্গে থেকে অবাক নয়নেই দেখলাম। কত ধৈর্য ত্যাগ। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানর আরেক গল্প সত্য।
এএইচএম নোমান: উপদেষ্টা সদস্য, নিরাপদ সড়ক চাই ও গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী-২০১৩
email: nouman@dorpbd.org