আমরা কিছু জীবন ঘনিষ্ঠ প্রত্যয় মাঝে-মাঝে গুলিয়ে ফেলি। তন্মধ্যে থোড়াই উপলব্ধি করি যে, শিক্ষা, সাক্ষরতা ও স্বাক্ষর ভিন্ন প্রত্যয়। এ প্রত্যয় গুলোর একটু চুল-চেড়া বিশ্লেষণ দরকার। শিক্ষা শব্দটি এসেছে ‘শাস’ ধাতু হতে। যার অর্থ ‘শাসন করা’ বা ‘উপদেশ দান করা’। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ Education এসেছে Latin শব্দ Educare/educatum হতে যার অর্থ To lead out অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।
সক্রেটিসের ভাষায়, “শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ” এরিস্টটল এর ভাষায় “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করা হল শিক্ষা”। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “শিক্ষা হল তাই যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না- বিশ্ব সত্ত্বার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তুলে”। শিক্ষার ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিকে আলোকপাত করলে আমরা বলতে পারি, মানুষের আচরণের কাঙ্ক্ষিত, বাঞ্ছিত এবং ইতিবাচক সংস্কারই হল শিক্ষা। স্বাক্ষর এর ইংরেজি প্রত্যয় সহজেই বোধগম্য Signature অর্থাৎ স্ব+অক্ষর (স্বীয় অক্ষর)। নিজের নাম লিখতে যে কটি বর্ণের দরকার তা জানাই স্বাক্ষর। স্বাক্ষর ও সাক্ষরতা শুধুই বানান পার্থ্যকে সীমাবদ্ধ নেই- সাক্ষরতা কিন্তু স্বাক্ষরের তুলনায় ব্যাপক অর্থবোধক ও বৃহৎপরিসর জ্ঞাপক শব্দ। স্বাক্ষরকে যদি বিন্দুর সাথে তুলনা করা হয়- তবে সাক্ষরতা হল আলবৎ সিন্ধু। সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর স্বাদ আস্বাদন করা যায়- কিন্তু বিন্দুর মাঝে সিন্ধুকে কল্পনা করা যায় না। যাকগে, মোদ্দা কথা হল, জ্ঞানের সিন্ধু পাড়ি দিতে হলে সাক্ষরতার বৈতরণী দরকার- স্বাক্ষরের ডিঙ্গিখানা যথেষ্ট নয়।
আমরা এও পর্যবেক্ষণ করি যে, সময়, প্রেক্ষাপট ও চাহিদা কিভাবে একটি প্রত্যয়ের সংজ্ঞা অবিরত পরিবর্তন করে দেয়। ১৯০১ সালে বাংলাদেশের লোক গণনার Official Document এ “সাক্ষরতা” শব্দটির সর্বপ্রথম ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। সেই ডকুমেন্ট মোতাবেক স্ব-অক্ষরে লিখতে পারাই, স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের স্বীকৃতির জন্য যথেষ্ট ধরা হয়। অর্থাৎ এখানে স্বাক্ষরতাকে সাক্ষরতার সমার্থক ধরা হয়- যা শব্দের অর্থ সংকোচক হিসাবে পরিগণিত হয়। পঞ্চাশের দশকে সাক্ষরতার সংজ্ঞা ছিল, যিনি যেকোন ভাষায় মুদ্রিত উপকরণ পড়তে পারবেন-তিনিই স্বাক্ষর।
আবার ষাটের দশকে এসে এর অর্থ ব্যাপ্তি হল ‘একজন যিনি বোধগম্যতার সাথে পড়তে পারবেন তিনিই সাক্ষর। সময়ের বিবর্তনে আরো একধাপ এগিয়ে সত্তরের দশকে এর সংজ্ঞা দাঁড়ালো, সাক্ষরতা এমন একটি ক্ষমতা- যাতে লিখার ও পড়ার উভয় ক্ষমতাই বলবৎ থাকে। এ সংজ্ঞা আবার আশির দশকে এসে পুষ্টি সাধন করে, গায়ে-গতরে বেশ বেড়ে ওঠে। সাক্ষরতা এমন একটি সমার্থক নির্দেশ করে-যার মাধ্যমে মাতৃভাষা বুঝতে পারবে, মৌখিক ও লিখিত ভাবে প্রকাশ করতে পারবে এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় হিসাব, মৌখিক ও লিখিত ভাবে সাধন করতে পারবে। আবার আর্ন্তজাতিক বাতাবরণে সাক্ষরতার সংজ্ঞাতেও রয়েছে ব্যাপক ধারণা।
UNESCO সাক্ষরতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে যা বলেছে তার মোদ্দা কথা হল :
In fact, the meaning of literacy can only be defined in a specific contest and will involve as societal and individul needs change
সাক্ষরতার সংজ্ঞায় UNESCO সবচেয়ে 3R এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে।
R-for Reading
R-for wRiting
R-for aRithmatics
আবার ১৯৭৫ সালে উপরিউক্ত 3R এর সাথে যুক্ত হয়, “মানুষের মুক্তি আর তার পূর্ণ বিকাশে অবদান রাখার শিক্ষাই সাক্ষরতা”। জাতিসংঘ ২০০৩-২০১২ সাল পর্যন্ত একদশককে “সাক্ষরতা দশক” হিসাবে ঘোষণা করে-যেখানে motto ছিল Literacy as freedom অর্থাৎ সাক্ষরতায় গণতান্ত্রিক মুক্ত চর্চার রূপ পরিগ্রহ করণ। এখানে এখন প্রশ্ন হচ্ছে সাক্ষরতায় সিন্দাবাদের ভূতের মত স্বাধীনতা চেপে বসল কেন? অর্থাৎ এই বিপুল পৃথিবীর অসীম জ্ঞান ভান্ডারে অবগাহন করার স্বাধীনতা, তথ্য পাবার স্বাধীনতা তথা লিখিত ভাষার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার স্বাধীনতা আবার আরো একটি অর্থবাচকতা দেখালে, অজ্ঞাত কু-সংস্কার ও ভ্রান্তধারণা থেকে মুক্তি লাভই সাক্ষরতা।
তাহলে এটা প্রকাশ্য দিবালোকের মত স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান যে, সাক্ষরতার সংজ্ঞা একটি চলক, ধ্রুবক (Constant) নয়। তাহলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা যদি সাক্ষরতার সংজ্ঞা নিরুপণ করতে চাই তাহলে তা কি হবে? কিংবা কোন যুৎসই সংজ্ঞা কি আদৌ দাঁড় করানো সম্ভব? তবুও একটা সংজ্ঞা দেয়ার অপ-প্রয়াস করা হল, জীবন নির্বাহ, ক্ষমতায়ন, যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা ও সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়ানো, সর্বোপরি মানবিক গুণে বিকশিত হবার শিক্ষাই সাক্ষরতা। অথবা আমরা এভাবেও বলতে পারি যে, পার্থিব ও পারলৌকিক সার্বিক কল্যাণ সাধনের নিমিত্তে যথার্থ শিক্ষাই সাক্ষরতা- যা দেশ-কাল, পাত্র তথা ভৌগলিক পরিমন্ডলের উর্ধ্বে।
আমরা যদি ইতিহাসের দ্বারস্থ হই তাহলে দেখতে পাই যে, ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে এদেশে গণ সাক্ষরতার প্রয়োজন অনুভূত হয়। ১৯৩৯-৪০ সালের দিকে একটি প্রতিপাদ্য বেশ আলোচিত হয়েছিল “শিখি একজনে, শেখাই অন্যজনে”। পূর্ব বাংলার নিরক্ষরতা দূর করার জন্য তদান্তীন I.C.S এর অবসর প্রাপ্ত অফিসার H.G.S বিভার আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বয়স্ক শিক্ষা চালু করার জন্য ১৯৫৬ সালে আব্দুল হাসনাত, ইসমাঈল প্রমুখদের সহায়তায় ‘সাক্ষরতার কেন্দ্র’ গঠন করেন। তাই শ্রদ্ধেয় বিভারই বাংলার জ্ঞানের পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ভোর এনেছিল।
পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় উদ্যোগে “পল্লীকৃষি ও শিল্প উন্নয়ন” প্রকল্পের আওতায় বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয়- যা ১৯৫৯ সালে কুমিল্লা BARD কে এ দায়িত্ব ন্যাস্ত করা হয়। পরিশেষে ১৯৬৩ সালে এ প্রকল্প ‘শিক্ষা পরিচালক দপ্তরে অধিভুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের প্রণীত সংবিধানে সাক্ষরতা আন্দোলন জোরদার হয়। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি নীতি রচনার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে ৩টি মৌলিক উপাদানের কথা বলা হয়।
ক) বৈষম্যহীন, গণমুখী সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা।
খ) সব শিশুর জন্য অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা সম্প্রসারণ।
গ) নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও শিক্ষাকে সমাজের প্রয়োজনে ব্যবহার উপযোগি করা।
উপরিউক্ত তিনটি মৌলিক নীতির আলোকে সাক্ষরতার অভিযান সত্যিকার অর্থে বেগবান হয় এবং দেশের সাক্ষরতার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বিশ্ব সাক্ষরতার হার জরিপ র্যাংকিং এ বাংলাদেশের বর্তমান সাক্ষরতার হার ৬২.৬৬- যা ১৬৪ তম অবস্থান।
শিক্ষায় বর্তমান সরকারের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষর করতে সরকারি নানা-মুখী কর্মসূচী বলবৎ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে। ১. গণশিক্ষা কার্যক্রম, ২. বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম, ৩. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর, ৪, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করণ, ৫. নানা-মুখী প্রচার অভিযান। সরকারের পাশাপাশি NGO সাক্ষরতা কার্যক্রমে ভূমিকা রাখছে। তন্মধ্যে Plan Bangladesh, BRAC, ইউসেপ, ঢাকা আহসানিয়া মিশন, T.M.S.S উল্লেখযোগ্য।
একটি মুদ্রার যেমন দুুটি পিঠ থাকে তেমন এদেশের সাক্ষরতা অভিযানের দুুটি পিঠ আছে- এক পিঠে সরকারি উদ্যোগ অন্য পিঠে বেসরকারি উদ্যোগ। শিক্ষাকে, দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার বিবেচনায় নিয়ে একটি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ সালে প্রণীত হয়। প্রথম হতে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, আধুনিক ও সময়োপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম স্থাপন, ২৬,২০০ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, প্রাক-প্রাথমিক চালুকরণ, শুন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি সরকারের উল্লেখযোগ্য অবদান। উভয় উদ্যোগ আর সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে একদিন এদেশের সাক্ষরতা হার শতভাগে পৌঁছে যাবে বলে- আমরা আশাবাদীরা বিশ্বাস করি।
ইদানিং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হওয়ায় সাক্ষরতা এখন আঞ্চলিক কিংবা দেশীয় প্রত্যয় নয়- এটি এখন বৈশ্বিক প্রত্যয়। সঙ্গত কারণেই শিক্ষাবিদ পাওলি ফ্রেইরি শব্দকে না পড়ে- বিশ্বকে পড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। শান্তিতে নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফ জায়ীর একটি উক্তি প্রণিধান যোগ্য, One pen, one book and one teacher can change the world.
তাঁর এ উক্তির সারবত্তা প্রতিপন্ন করলে যা পাওয়া যায়, তা হল সাক্ষরতার কেন্দ্রে রয়েছে শিক্ষক, যার একনিষ্ঠ সহায়তায়, হাজার-হাজার শিশুমনে জ্ঞানের প্রভা প্রজ্জলিত হয়ে অনুসন্ধিৎসু মনে, স্বাধীনভাবে জ্ঞান চর্চায় উব্দুব্ধ হয়ে- লেখনীর মাধ্যমে স্বীয় প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত ও সমৃদ্ধিশালী করবে।
পরিশেষে আকাশ সংস্কৃতি ও বিশ্বায়নের যুগে সাক্ষরতা আর্ন্তজাতিক বহু মাত্রিকতায় বিভক্ত। তাই একজন সু-শিক্ষিত, স্ব-শিক্ষিত, আধুনিক বিশ্ব নাগরিক হয়ে উঠাই হোক প্রতিটি সাক্ষরতা দিবসের প্রত্যয়।
হাবিব ফয়সাল : শিক্ষক ও লেখক