বায়ুদূষণ অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার

বাপ্পি সরদার

বায়ু দূষণ বলতে বোঝায় যখন বায়ুতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থের কণা ও ক্ষুদ্র অণু অধিক অনুপাতে বায়ুতে মিশে যায়। রাজধানী ঢাকা দূষিত বাতাসের শহরের র‌্যাংকিংয়ে বর্তমানে নিয়মিতই উপরের স্থানে থাকছে।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) গত এক সপ্তাহ ধরেই বায়ু দূষণে ঢাকা প্রথম থেকে সপ্তম স্থান অধিকার করছে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার বিষয়। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানায়।

একিউআই সূচকে ৫০ এর নিচে স্কোর পাওয়ার মানে হলো বাতাসের মান ভালো। একিউআইতে ৫১ থেকে ১০০ স্কোর পাওয়ার মানে হলো বাতাসের মান গ্রহণযোগ্য। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর পাওয়ার অর্থ হচ্ছে বাতাসের মান দূষিত। তবে ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা এখন নিয়মিত ১৭৫ থেকে ২৫০ স্কোর থাকছে।

‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। আর এই দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ।

বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। এত দিন এই উপাদান সবচেয়ে বেশি নির্গত করত চীন। গত দুই বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। চীন ও ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান।

প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। আর বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। শীর্ষ বায়ুদূষণকারী দেশ হিসেবে চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও পাকিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান।

শীতের শুষ্ক হাওয়ায় ধুলার কারণে এই দূষণের মাত্রা এখন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মাত্রাতিরিক্ত ইটভাটা, যানবাহন, নির্মাণকাজ ও কলকারখানার ধোঁয়ার কারণে আমরা ঢাকা শহরের বাসিন্দারা আসলে এক বিষাক্ত গ্যাসের বলয়ের মাঝে বাস করছি।

ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা গত ১০ বছরে ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। জনসংখ্যা দিয়ে বায়ুদূষণ বিবেচনা করলে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত বায়ুর দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।

বর্তমান সময়ের ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রাকে চিহ্নিত করা হয়েছে “ভেরী আনহেলদি”- অর্থাৎ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে। এ রকম বায়ূ দুষণে ঢাকাবাসী চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের অবস্থা খুবই খারাপ। এ অবস্থায় আমরা ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা কমানোর জন্য জরুরী ভিত্তিতে সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

ঢাকার চারপাশের ইটের ভাটায় নিম্নমানের কয়লা পোড়ানো এবং ঢাকা নগরীর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা-ঘাট খোঁড়াখুঁড়ি; রাস্তার পাশে আবর্জনার স্তুপ; মেরামতহীন ভাংগাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে অতি মাত্রায় বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার নির্গমন, ভবন নির্মাণ ও ভাঙ্গার সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী বাইরে রাস্তা-ফুটপাতে যত্রতত্র ফেলে রাখা, মেশিনে ইট-পাথর ভাঙ্গা এবং শিল্প-কারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও ধুলা-বালি বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত ক্ষতিকারক গ্যাস, ভারীধাতব কণা ও ধুলাবালি বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

গত বছরে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের বাসিন্দারা বায়ুদূষণের প্রধান শিকার।

বিশ্বে প্রতিবছর ৫৫ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে বায়ু দূষণের কারণে। বাতাসে ভাসমান বস্তু কণার পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘন মিটারে মাইক্রোগ্রাম হিসেবে। অতি সা¤প্রতিকালে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ২.৫ মাইক্রোমিটার আকৃতির ভাসমান বস্তু কণা যথাক্রমে- ফার্মগেট, দারুস সালাম, সংসদ ভবন, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী ও আগ্রাবাদে ৮৪.৫৩, ৮০.৪৪, ৬৩.৯০, ৯৪.০৫, ৬১.৬৭ ও ৭৮.৭৮। যার সহনীয় পরিমাণ হচ্ছে ৫০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনফুট। উপরন্তু ঢাকার বাতাসে ক্যাডমিয়াম প্রায় ২০০ গুণ বেশি, নিকেল ও সিসার মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ ও ক্রোমিয়াম প্রায় ৩ গুণের বেশি। সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে বাতাসে দূষণের পরিমাণ কত ভয়াবহ।

ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮%, ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮%, যানবাহন ১০%, বায়োমাস পোড়ানো ৮% এবং অন্যান্য উত্স ৬% দায়ী। একজন সুস্থ স্বাভাবিক লোক গড়ে ২,০০,০০০ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এ থেকে ক্যান্সার হতে পারে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ইটভাটা থেকে নাইট্রোজেন, অক্সাইড ও সালফার-ডাই অক্সাইড অ্যাজমা, হাঁপানি, অ্যালার্জি সমস্যা, নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। ধূলিকণার মাধ্যমে ফুসফুসের স্লিকোসিস নামে রোগ সৃষ্টি হয়, যা ফুসফুসকে শক্ত করে দেয়। কার্বন-মনো-অক্সাইড রক্তের সঙ্গে মিশে অক্সিজেন পরিবহনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সর্বোপরি বহু মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে পড়ে এই বায়ু দূষণ।

বায়ুদূষণ রোধে সবুজ আন্দোলনের প্রস্তাব:

১) প্রতিদিন দুই বার রাজধানীর রাস্তা ঝাড়– দিতে হবে এবং সপ্তাহে একদিন রাস্তা পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।

২) সারাদেশের রাস্তা ধোঁয়ার জন্য ১০০টি গাড়ী আমদানি করতে হবে। রাস্তা পরিষ্কার করার ট্রাক প্রস্তুতকারী কোম্পানীসমূহ যেমন মান-জার্মানি, মারসিডেস-জার্মানি, ডুভেলো-ইতালি, বেমা-জার্মানি, থোমে-বোরমান। প্রতিটি নতুন গাড়ির মূল্য দেড় কোটি থেকে তিন কোটি টাকা এবং পুরাতন গাড়ির মূল্য বিশ লক্ষ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা।

৩) রাস্তা পরিস্কারের জন্য সিটি কর্পোরেশন যেভাবে নাগরিকদের কাছে বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে ঠিক তেমন ভাবে প্রতি পরিবার থেকে ৫ বছর ২০ টাকা সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করা যেতে পারে।

৪) বায়ু দূষণ রোধের পুরো কার্যক্রম তদারকি করার জন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করতে হবে এবং সমসময় কার্যক্রম তদারকি করতে হবে।

৫) ঢাকা নগরী ও তার আশেপাশে গাছপালার পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে গেছে। অনতি বিলম্বে নদীর পাড়, রাস্তার পাশে, বিভিন্ন সরকারি জায়গায় পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপন করতে হবে ও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ভবন ও বাসা-বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় ও ছাদে মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে বাগান গড়ে তুলতে হবে।

৬) বায়ুদুষণের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য সরকার, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা আবশ্যক।

৭) নগরবাসীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই বায়ু দূষণের উৎসসমূহ বন্ধ করতে হবে। বায়ু দূষণের সকল উৎস বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বায়ু দূষণে জড়িত দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

৮) রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে হবে এবং জনদুর্ভোগ লাঘবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা এবং তা নিয়মিত মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে।

৯) সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা গেলে ৭০-৮০% দূষণ কমানো সম্ভব। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধকরণ, রাস্তা নিয়মিত পরিষ্কারকরণ, পানি ছিটানো, নির্মাণ কাজ চলাকালে পানি ছিটানো এবং নির্মাণ সামগ্রী আচ্ছাদন দ্বারা আবৃতকরণ, কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে।

১০) অভ্যন্তরীণ কক্ষের অর্থাৎ সাধারণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বায়ু দূষণের পরিমাণ বাইরের বায়ু দূষণের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ গুণ বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের শতকারা ৯০-৯৫ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহের রোগীদের বায়ু দূষণের মাধ্যমে সংক্রমিত না হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি অস্ত্রোপচার কক্ষ ও আইসোলেশন কক্ষসমূহের মত স্পর্শকাতর কক্ষসমূহের বায়ু দূষণমুক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। যাতে কোনো জীবাণু ধ্বংস করার কোনো ফিল্টারেশন, বাতাসের চাপ ও বেগ রক্ষাকরণ, ভেন্টিলেশন, বাতাস পরিবর্তন ও ফ্রেশ বাতাস আনয়নের কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ বহিরঙ্গের বায়ু দূষণের চেয়ে অধিকমাত্রায় বেশি। রোগীদের মাধ্যমে বাতাসে মিশে থাকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস প্রভৃতি জীবাণু।

তাই বায়ু দূষণের কারণে রোগাক্রান্তদের সুচিকিৎসার জন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বাপ্পি সরদার: চেয়ারম্যান, সবুজ আন্দোলন পরিচালনা পরিষদ

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts