(উদয় হোসেন প্রেরিত)
এক রাজা তার পোষা কুকুরটিকে নিয়ে নৌ-বিহারে বেরিয়েছিলেন। নৌকার অন্য যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন একজন পন্ডিত ব্যক্তি। কুকুরটি জীবনে কখনো নৌকায় চড়েনি।তাই সে কেবলই ছটফট করছিল। আর তিড়িং বিড়িং করে লাফালাফি করে বাকি যাত্রীদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছিল।
কুকুরের লাফালাফি নিয়ে যাত্রীদের আতঙ্ক লক্ষ্য করে মাঝিরাও ভয় পেয়ে গেলেন যে, এই বুঝি নৌকো ডুবল। কুকুরটা যদি লম্ফঝম্প বন্ধ না করে তাহলে নিজেও ডুববে আর বাকিদেরও ডোবাবে। কিন্তু কুকুরের স্বভাবই যদি অশান্ত হয়, তবে তাকে শান্ত করবে কে? পরিস্থিতি দেখে রাজাও চিন্তায় পড়ে গেলেন।তবে এই অবস্থার কোন সমাধান তাঁরও মাথায় এল না।
পন্ডিত ব্যক্তি দূর থেকে গোটা ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলেন এবং একটা কুকুরকে নিয়ে এতজনের দূরবস্থা দেখে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তিনি রাজাকে বললেন- “মহারাজ, যদি আজ্ঞা দেন, এই অস্থির কুকুরটিকে আমি ভিজে বেড়ালের মত শান্ত করে দেব।” রাজাও সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিয়ে দিলেন।
এরপরে পন্ডিত এবং মাঝিরা মিলে কুকুরটিকে ধরে তুললেন এবং সোজা নদীর পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। পানিতে ভেসে থাকার জন্য কুকুরটি পাগলের মতন হাত-পা নেড়ে সাঁতার কাটতে লাগল। সত্যিকারের মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে বাঁচার জন্য আপ্রাণ সংগ্রাম করতে হচ্ছিল তাকে। এভাবে কিছুক্ষন চলার পর পন্ডিত আবার কুকুরটিকে পানি থেকে টেনে তুলে নৌকোর উপর বসিয়ে দিলেন। কুকুরটি গা থেকে পানি ঝেড়ে চুপচাপ এক কোনায় গিয়ে বসে রইল। নৌকোর দুলুনি, যাত্রীদের কোলাহল, কোন কিছুতেই আর কুকুরটির মধ্যে কোন রকম ছটফটানি দেখা গেল না।
যাত্রীরা অবাক, মাঝি অবাক, এমনকি রাজা নিজেও অবাক। রাজা তখন পন্ডিত কে প্রশ্ন করলেন- “মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কুকুরের স্বভাবে আমূল পরিবর্তন! এটা কিভাবে সম্ভব?” তান্ত্রিক জানালেন- “প্রতিটি প্রাণীই একরকম। যতক্ষণ না কেউ নিজে বিপদে পড়ছে, ততক্ষণ সে বিপদের গুরুত্বটা বোঝে না। যেই আমি কুকুরটাকে পানিতে ফেলে দিলাম, অমনি সে উপলব্ধি করল আসল বিপদ পানিতে আর নৌকোটা হল বাঁচার উপায়।”
ওই কুকুরটার মতই যারা ভাবছেন, করোনা হয়েছে সামান্য কয়েকজনের। এতে আমার কী!
ওদেরকে একবার চীন , ইতালি, ইরানের মতো দেশে ফেলে দেওয়া হোক। তাহলেই ঘরে থাকার কারণ সহজে বুঝতে পারবে।
ঘরের মধ্যে ভেজা বেড়াল হয়ে বসে থাকবে।
ভাইরাসের পাসপোর্ট ভিসা লাগে না, সীমান্তরেখা মিথ্যা : #বিল_গেটস
.
১.
আমি খুবই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি —- এই জগতে যাই ঘটে তার পেছনে একটা পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক কারণ রয়েছে।
.
২.
আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, পেশা, আর্থিক অবস্থা, খ্যাতি ইত্যাদির পরও প্রকৃতগত ভাবে আমরা একই সমান। যে যত বড় খ্যাতিবান কিংবা ক্ষমতাবান হোন না কেন — যেকোনো সময় আপনি কঠিন সংকটে পড়ে যেতে পারেন। ভাইরাস এই জিনিসটিই আমাদের খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে। যদি আপনি বিশ্বাস না করেন- তবে টম হ্যাংকস অথবা প্রিন্স চার্লসকে দেখেই তা বুঝতে পারবেন।
.
৩.
আমরা সবাই একে অপরের সাথে দারুনভাবে সম্পৃক্ত। জগতের সব কিছুই একটি অনুবন্ধনে আবদ্ধ। সীমান্তরেখা গুলো আসলেই মিথ্যা। এগুলোর মূল্য কত কম তা এই ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে। আপনারা ভালো করেই দেখেছেন- সীমান্ত পাড়ি দিতে ভাইরাসের ভিসা, পাসপোর্ট কোনো কিছুই লাগেনা।
.
৪.
গৃহের স্বল্প সময়ের এই বন্দিত্বকে যদি আপনার নিপীড়ন মনে হয়- তবে একটু ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করুন- যারা সারা জীবন ধরে এমন নিপীড়নের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে-তাদের জীবনটা কেমন!
.
৫.
নিজের স্বাস্থ্যের কি যে মূল্য —– এটা এই ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে। অথচ এই স্বাস্থ্যটাকে আমরা কত অবহেলা করি। নানা রকমের ক্যামিকেলজাত খাদ্য না খেলে + পানীয় পান না করলে আমাদের চলেনা। আমরা যদি আমাদের শরীরের যত্ন না নেই —- তবে অবশ্যই আমরা অসুস্থ হবো।
.
৬.
ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে- জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। যেকোনো সময় জীবনের ইতি হয়ে যেতে পারে।
এই সংক্ষিপ্ত জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বয়ষ্ক আর শিশুদের বেশী করে যত্ন নেয়া। এদের এক দল পৃথিবী দেখার জন্য —– আরেক দল পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। তাই, এদেরকে বেশী করে সময় দিতে হবে । জীবন বাঁচাতে টয়লেট রোল কিনে ঘরে ভর্তি করে ফেলাটাই জীবনের উদ্দেশ্য নয়।
.
৭.
ভাইরাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে- কত স্বার্থপর আমরা ?? জড়বাদী, ভোগবাদি আর বিলাসের সমাজই আমরা তৈরি করেছি। সংকটময় মুহুর্তে বোঝা যায়- জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হচ্ছে- খাদ্য, পানি আর ঔষধ।
.
৮.
দামী বাড়ি, গাড়ি আর লাক্সারিয়াস রিসোর্ট নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বাড়ি, গাড়ী একজন মানুষকে বাঁচাতে পারেনা। যেমন পারে- ঔষধ, খাবার আর পানি।
.
৯.
ভাইরাস দেখালো —- নিজের পরিবার আর আপনজনকে আমরা কত অবহেলা করি। আমরা নিজ থেকে ঘরে ফিরিনি। আপনজনদের সময় দেইনি। ভাইরাস জোর করেই আমাদের প্রিয়জনদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। প্রিয়জনদের সাথে নতুন করে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
.
১০.
আমাদের আসল কাজ কারো না কারো চাকর হয়ে শুধু চাকুরি করাই নয়। এই জন্যই আমাদেরকে সৃষ্ট করা হয়নি।
.
১১.
মানব সৃষ্টির আসল কাজ হলো- মানুষ মানুষের পাশে থাকবে, মানুষ মানুষকে রক্ষা করবে, মানুষ মানুষের কাছ থেকে উপকৃত হবে।
.
১২.
ক্ষমতার দম্ভ + খ্যাতির দম্ভ + বিত্তের দম্ভ এসব কিছুই নিমিষেই যে কোনো সময় চুপসে যেতে পারে। বড় কোনো শক্তির কাছে নয় — অতি ক্ষুদ্র এক আণুবীক্ষণিক ভাইরাসের কাছে। পুরো দুনিয়াটাকে অচলাবস্থায় নিয়ে যেতে পারে খালি চোখে অদেখা এক ভাইরাস।
তাই আমাদের সব রকমের অহংকার ও দম্ভকে যেনো সবসময় নিয়ন্ত্রণের মাঝেই রাখি।
.
১৩.
আমাদের ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। আমরা ভালো হবো না মন্দ হবো / স্বার্থপর হবো না পরার্থপর হবো / ভালোবাসবো না ঘৃণা করবো / সাহায্য করবো না ছিনিয়ে নিবো / দান করবো না গ্রহণ করবো/ সাহায্য করবো না নিপীড়ন করবো- এসব কিছু করার পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের সবার আছে।
সংকট আমাদের আসল চেহারা বের করে দেয়।
.
১৪.
আমরা সাবধান হবো নাকি শুধুই শংকিত হবো-এটাও ভাইরাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়। এরকম অবস্থা অতীতেও হয়েছে।
সুতরাং —- মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কোনো সংকটই দীর্ঘস্থায়ী নয়। জীবন আবর্তিত হতে থাকবেই। প্রতিটি সংকটের পর সুসময় আসবেই। এই সংকটও কেটে যাবে। পৃথিবীর এখানেই শেষ নয়। কাজেই অতিরিক্ত আতঙকগ্রস্থ হয়ে আমরা যেন নিজেদের আরো বেশী ক্ষতি করে না ফেলি।
.
১৫.
আমরা নিজেদের শুধরাতে পারি। শিক্ষা নিতে পারি। এটা পৃথিবীর শেষ নয়। এক নতুন পৃথিবী গড়ার সূচনা।
.
১৬.
যে হারে দ্রব্য রাখার সেলভস থেকে টয়লেট রোল ফুরিয়ে গেলো। ঠিক একইভাবে আমাদের অক্সিজেন দান করা অরন্য ফুরিয়ে যাচ্ছে।
এই অরণ্যকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতিকে অসুস্থ করে আমরা কোনোদিনই সুস্থ হতে পারবোনা। প্রকৃতিকে নিজের গৃহ মনে করতে হবে। আর ঘর অসুস্হ হলে আমরাও অসুস্থ হবো।
.
১৭
এই ভাইরাস আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে – আমরা যেন ভুলে না যাই। শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের সংশোধন করি। অনেকেই করোনা ভাইরাসকে গ্রেট ডিজাস্টার হিসাবে দেখছেন। আমরা ক্যানো তাকে একটি গ্রেট কারেক্টর হিসাবে দেখবো না?
আমরা আমাদের এই পৃথিবীকে ভালোবাসি।
চলুন — আবার তাকে সুন্দর করে তুলি।।
.
#কৃতজ্ঞতাঃ
ড: আব্দুল্লাহ খান + ড: শফিকুর রহমান
( অধ্যাপক: অর্থনীতি বিভাগ, ক্লাফলিন এবং গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, সাউথ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়)