প্রকৌশলী সরদার আমিন ।। পেশোয়ারে আজগর আলী বলছিল, তার বাবা হাঁটছিল রাস্তা দিয়ে। হঠাত্ সকল ভবন ও রাস্তা কাঁপছে। দেখলো ভবনগুলো থেকে ইট ছিটকে রাস্তায় পড়ছে। তিনি আহত হলেন। তাকে হসপিটালে নিচ্ছিল কিছু মানুষ। কিছুদূর গিয়ে রাস্তা ব্লক থাকায় হসপিটালে নিতে পারলো না। তার বাবা রাস্তায় মারা গেলেন। একজন বলছিল, উঁচু ভবনগুলো যেভাবে দুলছিল, মনে হচ্ছিল যে কোনো সময় হেলে পড়বে, যদিও একটিও হেলে পড়েনি।
পাকিস্তানের কারাকোরাম হাইওয়ে ব্লক হয়ে গেয়েছিল পাহাড় ধসে পড়ে। খাইবার পাখতুন খাওয়া প্রদেশের পাহাড়ি শহর সাংলাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। গত ২৬ অক্টোবর সোমবার দুপুর ১:৩৯টা স্থানীয় সময়ে ভূমিকম্পটি হয় প্রধানত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে। হিন্দুকোষ পর্বতমালা অঞ্চলে এটা ঘটে। যদিও ভারত, তাজিকিস্তান, চীনও এফেক্টেড হয়েছে। আফগানিস্তানের কাবুল থেকে ১৭০ কিলোমিটার উত্তরে তথা বাদাখাস্তান প্রদেশের রাজধানী ফায়জাবাদ থেকে ৭৩ কিলোমিটার দক্ষিণে এ ভূমিকম্পের ইপিসেন্টার। এ পর্যন্ত পাকিস্তানে ৩১১ জন ও আফগানিস্তানে ২৬০ জন নিহত হয়েছে। পাহাড়ী এসব অঞ্চলে লোকবসতি কম, তারপরও পাকিস্তানে এ পর্যন্ত ৮৪৫৩টি বাড়ি ধ্বংস হয়, কয়েকশ’ স্কুল ধ্বংস হয়েছে, আফগানিস্তানে ৭৬০০ বাড়ি ও স্কুল ধ্বংস হয়েছে। আফগানিস্তানের ১৪টি প্রদেশের ১০৩টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৫, স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় দুই মিনিট। এটার গভীরতা ছিল ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে এর তথ্যমতে ১৩২ মাইল বা ২১৩ কিলোমিটার। ২০০৫ সালে পাকিস্তানে কাশ্মির এলাকায় যে ভূমিকম্প হয়েছিল তার মাত্রা ছিল ৭.৬, সেটার গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার। কিন্তু প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার লোক তখন নিহত হয়েছিল। এ বছরের এপ্রিলে নেপালে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, তার মাত্রা ছিল ৭.৮, গভীরতা ৮.২ কিলোমিটার, নিহত হয়েছিল প্রায় ৯ হাজার লোক। কাশ্মিরের ভূমিকম্প সে হিসেবে অতি ভয়াবহ ছিল। তখন শীতকাল ছিল, ঠাণ্ডায় উদ্ধার অভিযান পাহাড়ী এলাকায় সময়মত করা যায়নি। নেপালের ভূমিকম্পে হিমালয়ের এভারেস্টে কিছু উচ্চতার পরিবর্তন হয়। ইউরেশিয়ান ও এশিয়ান প্লেটের ঘর্ষণে ১০ ফুট পর্যন্ত ডিসপ্লেসমেন্ট হয়েছে বলে গবেষকরা জানান।
বার বার এ অঞ্চলগুলোতে ভূমিকম্পের আঘাত কেন হচ্ছে? পাকিস্তানে ইসলামি স্টাডি গ্রুপ বলে একটি গ্রুপ বলেছে, এটা নাকি ঈশ্বরের ওয়ার্নিং। তারা এটা বলে বসে থাকে আর আমাদের ভূমিকম্পের আসল কারণ ও বিবরণ সংগ্রহ করতে হয় আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভে প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রকৃতপক্ষে ভূমিকম্প কখনো প্রতিরোধ সম্ভব না, কিন্তু তার ক্ষতি একেবারে কমিয়ে আনা সম্ভব। সেটা কেবল ঈশ্বরের আরাধনা করলেই কমবে না, সর্বোচ্চ মাত্রার কম্পন সহ্য করার মত অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে ও সতর্ক হতে হবে।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে বিকেল ৪টা ৫৩ মি.এ হাইতিতে ৭.০ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয়েছিল ৩ লাখ লোক, একই বছরে ফেব্রুয়ারিতে রাত ৩টা ৩৪ মি.এ সিলিতে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয়েছিল মাত্র ৫২৫ জন। এর কারণ হাইতিতে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, চিলিতে বিল্ডিং কোড মানা হয়েছে। চিলিতে কেবল ভূমিকম্প নয়, টিসুনামীতে রূপ নিয়ে সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলোতে বিশাল উচ্চতায় পানি উঠে আসে এবং সুদূর ক্যালিফোর্নিয়াতে এবং জাপানেও কিছু ক্ষতি হয়েছিল। ৫৩টি দেশ সেই ভূ-কম্পন অনুভব করেছিল। চিলিতে বিংশ শতকে (১৯০০ থেকে ১৯৯৯) ৭.০ থেকে ৮.৩ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ৭৭টি। সেজন্য তারা প্রটেকটিভ ব্যবস্থা নিতে সিরিয়াস হতে বাধ্য ছিল। ২০০০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত চিলিতে ৬.৩ থেকে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ১৬টি যা-তে মোট নিহত হয়েছিল মাত্র ৫৪৬ জন। এসব তথ্য সবই ইন্টারনেটে আছে।
ভারতীয় অঞ্চল তথা ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হয় (৬ থেকে ৮.২ মাত্রার) ১৯০০ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত বছরগুলোতে ১১টি, নিহত হয়েছিল এক লাখের মত। কিন্তু কাশ্মির ভূমিকম্প একটিতেই তার চেয়ে বেশি নিহত হয়।
গত শতাব্দীতে চিলিতে ৭৭টি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, ভারতীয় অঞ্চলে ১১টি ৬.৭ থেকে ৮.২ মাত্রার। এ শতাব্দীর ১৫ বছরে চিলিতে ১৬টি, ভারতীয় অঞ্চলে ১০টি ৬.২ থেকে ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে গেছে। ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করা হয় গত ২০০ বছরে, ১৫০ বছরে, ১০০ বছরে ও গত ৫০ বছরের রেকর্ড থেকে। জাপানে গত শতাব্দীতে ৬.৩ থেকে ৮.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ২৩টি। এ শতাব্দীর ১৫ বছরে ৬.৬ থেকে ৯.০ মাত্রার ভূমিকম্প হয় ২২টি। তার মধ্যে ২০১১ সালের সুনামীর চিত্রে আমরা দেখেছি জাহাজ তুলে ফেলেছে দোতলা ভবনের ছাদে। ৩৩ ফুট উঁচুতে পানির ঢেউ তুলেছিল ভূমিতে।
উপরোক্ত তথ্যমতে ভূমিকম্পের তীব্রতা ও সংখ্যা বিশেষ কোনো নিয়ম মানে না। কিন্তু কোনো অঞ্চলে গত দুইশ’ বছরের উপর অন্তত একটি ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়।
১৯৬০ সালে ডোমিনিকান দেশ ভালদিভিয়াতে ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্প এর ক্ষমতা ছিল ১৭৮ গিগাটনের সমান তথা হিরোসীমায় বিস্ফোরিত ১০০০টি এটম বোমার সমান। এর কম্পন ৪৩৫ মাইল দূরের হাওয়াই দ্বিপেও অনুভূত হয়েছিল। এর ক্ষয়ক্ষতি ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের এবং ৬০০০ লোক নিহত হয়েছিল। উল্লেখ্য, ২০০৪ টিসুনামীর ক্ষমতা ছিল ৯৬০০ গিগাটন টিএনটির সমান বা ৫৫০ মিলিয়ন হিরোসীমার এটম বোমার শক্তির সমান।
জানা ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ছিল ১৫৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারি চীনের শাঞ্জী এলাকায় হয় ৮.০ মাত্রার। এর ধ্বংস ক্ষমতা ছিল ৫২০ মাইলব্যাপী। ৯৭টি দেশে সেটা অনুভূত হয়েছিল। ২০ মিটারের গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল মাটি ফেটে। বিশাল সব ভূমিধ্বস হয়েছিল। এর ক্ষমতা ছিল মাত্র ১ গিগাটনের সমান। কিন্তু লোক মারা গিয়েছিল ৮,৩০,০০০ জন। কোনো কোনো এলাকায় ৬০% লোকই নিহত হয়েছিল।
জাপানের মানুষের মাথাপিছু আয় ৩৩,২২৩ মার্কিন ডলার। নেপাল দরিদ্র দেশ, তার মাথাপিছু আয় মাত্র ৭৪৩ মার্কিন ডলার। কিন্তু চিলির জনগণের মাথাপিছু আয় ১৪,৯১১ মার্কিন ডলার। সেজন্য চিলি যেভাবে সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নিয়েছে, নেপাল জানা সত্ত্বেও সেভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যদিও নেপালে চিলির মত এতটা ভূমিকম্প হয় না, এ জিনিস সংখ্যার উপর নির্ভর করে না, একটি বড় ভূমিকম্পের প্রস্তুতি না থাকলেই সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার যেমন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা দ্বীপরাষ্ট্র হাইতির মাথাপিছু আয় ৮৫২ মার্কিন ডলার মাত্র। তারা ভূমিকম্পের ঝুঁকি জানা থাকা সত্ত্বেও বড় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আবার ধনী রাষ্ট্র না হওয়া সত্ত্বেও কিউবা বা ভিয়েতনামের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক সুশৃঙ্খল। সুতরাং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলো সুশাসনের উপরই নির্ভর করে। যেমন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলেই পুরো লস এঞ্জেলেস শহরে বিশেষ ডিজাইনে নির্মাণ করা হয় অল্প কয়েকটি উঁচুতলা ভবন। আর ১ কোটি ৩১ লাখ জনবসতির লস এঞ্জেলেসের প্রায় সকল ভবনই এক দুই বা তিন তলা কাঠের বাড়ি। তার পাশের রাজ্য এরিজোনার ১৩ লাখ বসতির ফিনিক্স শহরটিও সেরকম। তিনতলার উপর কোনো বাড়ি আমি দেখিনি। এই দুটি শহরেই আমি ভ্রমণ করেছি। এই ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমিকম্প গবেষণা করতে গিয়েই আমেরিকান জিওলজিস্ট চার্লস রিকটার ১৯৩৫ সালে উদ্ভাবন করেন লগারিদমিক রিকটার স্কেল।
তারপরও জাপান দুনিয়ার অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ২০১১ সালের যে ভয়াবহ ডিজাস্টার হয়েছে তাতে ১৬ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়নি, তবে জাপানের পক্ষে সেই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবিলা সম্ভব হয়েছে। নেপাল ও বাংলাদেশ এর পক্ষেও সেরকম ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবিলা এক প্রকার অসম্ভব এবং ভারতের পক্ষেও কঠিন। ঘটনা নতুন শিক্ষার তত্ত্ব হাজির করে। নিশ্চয়ই এ শতাব্দীতে চিলি ও ইন্দোনেশিয়াতে যে হারে ভূমিকম্প বেড়েছে সেটা সবখানেই বাড়তে পারে। সুতরাং এ খাতে বড় বাজেট বরাদ্দই মূল কাজ।
সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণা বলছে, সূর্য থেকে ছিটকে আসা গ্যাসীয় অগ্নিকুণ্ডলীর পৃথিবী এক সময় শত শত কোটি বছরে শীতল হয়। তার গ্যাসীয় অংশ পানিতে পরিণত হয়। উপরিভাগ নানা রাসায়নিক ক্রিয়ায় মাটি ও নানা শিলায় পরিণত হয়। কোনো স্তরে গ্যাসও থেকে যায়। ভূ-গর্ভে থেকে যায় অতি উত্তপ্ত তরল পদার্থ। Solid mass settle হওয়ার সময় পৃথিবী পৃষ্ঠ ও গর্ভে নানা চড়াই-উত্ড়াই হয়ে যায় কোটি কোটি বছরে (এখন থেকে ৪৩০ কোটি বছর আগে পৃথিবী গঠনের শুরু বলে ধারণা করা হয়), যার কিছুটা এখনো ঘটছে। ভূ-ভাগ এক সময় একসাথে ছিল। যেমন পৃথিবীর মহাদেশগুলোর আকার পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় আফ্রিকা মহাদেশের খাপ থেকে কিভাবে সরে গেছে উত্তর আমেরিকা মহাদেশ। অষ্ট্রেলিয়া কিভাবে সরে গেছে এশিয়ার নিম্নভাগের খাপ থেকে। অষ্ট্রেলিয়ার উপরিভাগের ভাজ এশিয়ার নিম্নভাগের ভাজের মধ্যে এখনো যেন ঢুকিয়ে দেয়া যাবে। এভাবে ভূ-গভীরে পৃথিবী আন্তমহাদেশীয় কতগুলো প্লেটে ভাগ হয়ে গেছে। এগুলোকে বলে টেকটোনিক প্লেট। এগুলোর গঠন হয় ৯০ মিলিয়ন বছর আগে। এর আগে তৈরি হয় ১৪০ মিলিয়ন বছর আগে সুপার কন্টিনেন্টাল টেকটোনিক প্লেট। এর মধ্যে আবার সাব-কন্টিনেন্টাল প্লেট আছে যেগুলোর গঠন ৫৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর আগে।
হিমালয় থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিশাল এলাকা মিলে আছে ইউরেশিয়া টেকটোনিক প্লেট। এভাবে সারা দুনিয়ায় ভাগ করা আছে ৭টি প্রাইমারি ও ৮টি সেক্রেন্ডারি টেকটোনিক প্লেট এবং আরো আছে ডজনের উপর টরেশিয়ারি প্লেট। এই প্লেটগুলো এখনো সঞ্চারণ হয় বা সংকুচিত হয় বা মুভ করে। যেমন ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে এখনো বছরে ৫ সেন্টিমিটার মুভ করে। ইউরেশিয়ান প্লেট উত্তর দিকে ২ সেন্টিমিটার মুভ করে। ইউরেশিয়ান প্লেট সম্প্রসারণে আছে, ইন্ডিয়ান প্লেট সংকোচনে। এতে প্লেটগুলোর পরস্পরের মধ্যে চাপ বৃদ্ধি হতে থাকে। এর বাউন্ডারি লাইনে কলিশন ঘটে এবং চাপ বা স্ট্রেজ ডেভেলপ হয়। এই বাউন্ডারি লাইনে কোনো পয়েন্টে ফ্রেকচার হয় যেটাকে ফল্ট লাইন বলে। ইপিসেন্টার বেশিরভাগ এই ফল্ট লাইনে হয়। প্রচণ্ড চাপে স্ট্রেজ যখন রিলিজ হয় তখনই প্লেট কেঁপে উঠে। যে পয়েন্টে বিশাল পরিমাণের কোনো শিলার পরিবর্তন ঘটে সেটাকেই ফল্ট লাইন বলে। যেমন এক স্থানে পরস্পর ঘর্ষণে একদিকের প্লেট উপরে ও একদিকের নিচে নেমে যেতে পারে। হিমালয় সেভাবেই সৃষ্টি হয়েছে।
নেপালের ২৫ এপ্রিল ভূমিকম্প নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে গবেষণা করেছেন ভূমিকম্প বিশারদরা। অষ্ট্রেলিয়া ও ব্রিটিশ গবেষকরা (স্যান্ডি স্টিসি ও মার্ক আলেন) বলেছেন, ভূমিকম্পটি হিমালয়ের থ্রাস্ট ফল্টে ঘটেছে যেখানে ইউরেশিয়া প্লেট ইন্ডিয়া প্লেটকে পৃথক করেছে এবং কাঠমান্ডুর তলদেশ দিয়ে শিলাখণ্ড ১০ ফুট সরে গেছে, মানে ফল্টের উপরের পাথরগুলোর নিচের অংশ দক্ষিণে সরে গেছে। বিশাল ইউরেশিয়া প্লেটটি ২ সেন্টিমিটার সরে গেছে। তারা বলেছেন, এভারেস্ট যেহেতু ফল্টের নিচে না, তাই এভারেস্টের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ ইয়ান মেইন বলছেন, এভারেস্টের উচ্চতায় সামান্য পরিবর্তন আসতে পারে।
উপরোক্ত বিবরণ মত বাংলাদেশ চিলি বা জাপান বা ইন্দোনেশিয়ার মত ভূমিকম্প প্রবণ এরিয়া না। তবে পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলেই মৃদু ভূ-কম্পন সব সময় হয়েই চলছে। বাংলাদেশেও হচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় শহর ঢাকা, চিটাগাং, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ অতীতে বড় ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল। ছোট ছোট ভূমিকম্প সারা বছরই হচ্ছে বলে এ অঞ্চলকে ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা বলা যায়। ছোট ভূমিকম্প মানে হতে পারে কোনো ফল্টে এনার্জি রিলিজ হয়ে তা আরো বেশি চাপে নিপতিত হচ্ছে যা এক সময় বড় ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটাতে পারে বা হতে পারে সেটা সেখানেই শেষ। ১৮৯৭ সালের পর সেরকম বড় ভূমিকম্প এ অঞ্চলে হয়নি। সেজন্য একটি বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা সব সময় বিরাজ করছে।
আবার ১৯৭৬ সালে চীনের ট্যাংশান হেবেই অঞ্চলে ৮.২ মাত্রার ভূ-কম্পন হয়ে ৬ লাখ ৫৫ হাজার লোক নিহত হয়। সে অঞ্চলটি ভূমিকম্প প্রবণ এরিয়া ছিল না। তারপরও হঠাত্ ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশে ভেবে রাখতে হবে যেকোন সময় একটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে। সেটা বিবেচনা করলে ব্যবস্থা নেয়ার কাজে এক মিনিট দেরি করার সুযোগ নেই।
ভূমিকম্প কখনো রোধ করা যাবে না। দরকার হলো— ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাওয়ার আগাম উপায় এবং ভূমিকম্প হওয়ার পর পরই ব্যবস্থা নেয়ার শক্ত উপায়। এখনো গ্রামগঞ্জে রাজমিস্ত্রিরা যেসব ভবন নির্মাণ করে, তার মান খুবই খারাপ। সঠিক ডিজাইন ছাড়াই ফ্লাট স্লাবে ভবন এখনো নির্মাণ হচ্ছে। পুরান ঢাকার পুরনো ভবনগুলো এখনো ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিরাজ করছে। রাজউকের চেয়ারম্যান বলেন, এ শহরের মানুষ না-কি সচেতন না বলে আইনে মানতে চায় না। তিনি কি জানেন, সবচেয়ে উন্নত শহরের মানুষ যত বেশি সচেতন সেখানে আইনের প্রয়োগ তত বেশি কড়া। সুতরাং এসব বলে পাবলিককে রাষ্ট্র দোষারোপ করে দায় সারার কোনো উপায় নেই। দরকার হলো আইনের সঠিক প্রয়োগ। সেজন্য এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, এখন দরকার কোনো বড় ভূমিকম্পের খবরে সরগরম হয়ে আবার নেতিয়ে পড়া নয়, এখনই ব্যাপক কাজের একটি ডিপার্টমেন্ট খুলে দিয়ে কাজ শুরু করা। নির্মিত কোনো ভবনে যেন ভূমিকম্প বিবেচনা করতে ভুল না হয় ও নির্মিত বা পুরনো সকল ভবনকে সার্টিফাই করার কাজ বা শক্তি বৃদ্ধি করা বা ভেঙ্গে ফেলা।
লেখক :কনসালটেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ফিনান্স, রিহ্যাব