আতাতুর্ক পাশা
বিভাগোত্তর বৃহত্তর বাংলায় সাবির আহমেদ চৌধুরী এক পরিচিত নাম ছিল। সে সময় তাঁর জাত-বর্ণবাদহীন কবিতা ও মানবতাবাদী গানগুলো অনেকের কাছেই সুপরিচিত হয়ে ওঠে। এগুলো গান সে সময়ের অনেক indigenous সুরে সুরারোপিত হয়ে সে সময়ের লোকজ শিল্পীদের কণ্ঠে ধারণ হয়ে প্রচার হতো। এভাবেই কবি বৃহত্তর বাংলায় পরিচিত হয়ে ওঠেন।
সাবির আহমেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯২৪ সালের ১৫ জুলাই (১৩৩১ সালের ৩১ আষাঢ়) নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার (বর্তমনে বেলাব) হাড়িসাংগান গ্রামে। পিতা হানীফ মোহাম্মদ ও মাতা আছিয়া খাতুন। দীর্ঘজীবনে তিনি লেখালেখির পাশাপাশি অনেক মানবসেবামুলক এবং সমাজসেবার কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে দেশের ভেতর থেকে অনেক মানুষকে বাঁচিয়েছেন। প্রখ্যাত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আলমগীর গীতিকার সাবির আহমেদ চৌধুরীর মন মানসিকতার পূর্ব-উন্মেষকে এভাবে পাঠ করেছেন, In born mystic qualities.
হাড়িসাংগান গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর প্রথম পাঠ শুরু হয়। এর পর নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে তিনি ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে সাব ও ওভারশিয়ার ডিগ্রি লাভ করেন এবং দেশবিভাগের পর স্কুলটি কলেজে রূপান্তরিত হলে ওই কলেজ থেকেই ১৯৪৮ সালে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা কোর্স সফলভাবে শেষ করেন।
তারপর তিনি একই সালে সি এন্ড বি বিভাগে উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
একসময় তাঁর খামখেয়ালীপূর্ণ আচরণ এবং রাজনৈতিক স্রোতধারায় অত্যন্ত মনযোগ থাকার জন্য বিনা নোটিসে চাকরিচ্যূত হন। তখন তিনি প্রায় দুই বছর ভবঘুরে জীবন যাপন করেন। ১৯৫০ সালে সিলেটের সুনামগঞ্জে আবারো উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। এখানে তাঁর একইসাথে দর্শনবিদ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং মরমী কবি হাসান রাজার পুত্র একলিমুর রাজার সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৯৫৪ সালে তিনি চাকরি ত্যাগ করে ‘সাবির আহমেদ এন্ড কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের বিভিন্ন বড় বড় নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। এমনকি বিভিন্ন জেলায় অনেক বড় বড় স্থাপনাসহ ঢাকার এমপি হোস্টেল, লেক, সেকেন্ড ক্যাপিটালের মতো বড় বড় স্থাপনাতেও তিনি কাজ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি বিয়ে করেন মেহেরুন্নেসা চৌধুরীকে যিনি হাসান রাজার পুত্র হাসিনুর রাজার চৌধুরীর কন্যা।
নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজ করতে করতে তিনি দেশের সে সময়ের বড় বড় পত্রিকাগুলোর সাথেও সম্পর্ক গড়ে তোলেন। গড়ে ওঠে সম্পর্ক দেশের বরেণ্য কবি ও গুনী ব্যক্তিত্বের সাথে।
ত্রিকালদর্শী গীতিকবি ও সাহিত্যিক সাবির আহমেদ চৌধুরীর সাহিত্যিক জীবনের চেয়েও যেন তাঁর সমাজসেবামুলক কার্যাবলীর জীবন অনেক বড়। হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ প্রতিষ্ঠায় ‘বাহার মেমোরিয়াল কমিটি’র তিনি অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে তিনি কিছু আর্থিক সাহায্যও দিয়েছিলেন। ঢাকায় নজরুল সঙ্গীত চর্চার জন্য ‘নজরুল একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা হয় তাঁর অর্থানুকূল্যে। তিনি একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে। আজো তিনি এ একাডেমীর আজীবন সদস্য। তিনি ‘বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠা-পর্ব থেকে এর সাথে জড়িত ছিলেন এখনো তিনি এ প্রতিষ্ঠানটির আজীবন সদস্য। তিনি গীতিকবি সাহিত্য সংসদের আজীবন সদস্য, কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিসের পৃষ্ঠপোষক, লালন পরিষদ কেন্দ্রীয় সংসদের উপদেষ্টা, বাংলাদেশ লেখক সমিতির উপদেষ্টা, ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্রের উপদেষ্টাসহ আরো অনেক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত এবং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাজ করেছেন।
তিনি একসময় ‘জলসিঁড়ি’ পত্রিকা বের করেন। এ পত্রিকায় সে সময় অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, মোফাখ্খারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, নয়ীম গহর, জাহানারা আরজু, আবদুস সাত্তার, কাজী রোজীসহ সে সময়ের প্রতিনিধিত্বকারী অনেক লেখক লিখতেন। ঢাকায় যখন ‘মুকুল ফৌজ’ গঠন হয় তখন তিনি এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে যুক্ত হন। কবি বেগম সুফিয়া কামালের ‘সাঁঝের মায়া’ বাড়ির নকশা এবং প্রথম তলা নির্মাণ হয় কবি সাবিরের সহযোগিতায়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত কণ্ঠস্বর, কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত খেলাঘর, চট্টগ্রামের বেগম মুশতারী শফি সম্পাদিত বান্ধবী, শশাঙ্ক পাল কর্তৃক সম্পাদিত শ্রাবস্তী পত্রিকাসহ অনেক পত্রিকায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনকর্ম বলেও শেষ করা যায় না। তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকায় আসেন। ১৯৪৬ সালে সিরাজুদ্দৌলা পার্কে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের আহবায়ক আবুল হাশেমের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি তাতে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। তিনি এ মাঠে ব্রিটিশবিরোধী কবিতাও পড়েন। তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এবং পাঞ্জাবের শাহনাওয়াজ প্রমুখের উদ্যোগে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজে একসময় যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ যেদিন রেসকোর্স ময়দানে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ঘোষণা দেন তখন ছাত্রনেতা নূরুল হুদাসহ তিনি ঐ সভায় উপস্থিত থেকে প্রতিবাদ জানান।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি বাংলাদেশে থেকেও মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেন। এম আর মাহবুব-এর লেখা বইতে পাওয়া যায়, “বিশাল পরিবার নিয়ে তখন ঢাকা ছেড়ে যাবার মতো পরিস্থিতি তাঁর ছিল না। ফলে, তিনি ঢাকাতেই রইলেন। ভাষা আন্দোলনের গর্বিত সৈনিক, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সপক্ষ ব্যক্তিত্ব কবি সাবির আহমেদ ঢাকাতে অবস্থান করেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।” (সাবির আহমেদ চৌধুরী : সংগ্রাম ও সাধনা)।
তিনি তাঁর নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে আর্মির বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে রত ছিলেন বলে তাঁর ধারণা হয়েছিল, আর্মিরা যে কোনো সময় তাঁকে ডাক দিয়ে পাঠাতে পারে। একাত্তরের ১৪ এপ্রিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তাঁকে যশোহর ক্যান্টনমেন্টে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। সেখানে তাঁর কিছু কাজ বাকি ছিল। তিনি যেতে অস্বীকার করলেও অবস্থার প্রেক্ষিতে আর্মিদের নিজস্ব ব্যবস্থায় যশোহর গেলেন। সেখানকার এমইএস-এর গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়র মেজর শামসাদ আহমেদ রিসিভ করে আর্মি পাহারায় ব্যারাকে নিয়ে আসে। সেখানে তিনি শামসাদের নিজস্ব আর্মিদের কড়া পাহারায় থাকেন এবং অন্য আর্মিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। পরদিন মেজর শামসাদ তাঁকে শহরে নির্মাণাধীন মিলিটারী হাসপাতালে বাঙালি ডাক্তার কর্নেল আবদুল হাই ও ক্যাপ্টেন শেখ-এর হত্যা করবার পর তাদের রক্ত দেখান। এরপর পালপাড়া নিয়ে গিয়ে বিদ্রোহী ইপিআরদের সাথে পাকিস্তান বাহিনীর যে যুদ্ধ হয়েছে সে স্থানগুলো দেখান। তিনি বলেন, তরুণ পাকিস্তানী আর্মিরা শহরের যুবতী ও যুবকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে, তোমার কোন আত্মীয় থাকলে সরে যেতে বলো। সাথে সাথেই সাবির আহমেদ সেখানে তাদের সাথে যোগাযোগ করে শহর থেকে সরে যেতে বলেন।
তিনি সেখানে তাঁর কাজ করার ২/৩ দিন পর মেজর শামসাদকে বেশ পীড়াপীড়ি করলে তিনিই সাবির সাহেবের সেখানকার আত্মীয়সহ তাঁকে প্লেনে উঠিয়ে দেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।
যশোহরে ১০০ শয্যার হাসপাতাল ৩০ জুন ১৯৭১ সালে তাদের বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। নির্মাণের জন্য মে মাসে সাবির আহমেদ চৌধুরী আবারো সেখানে যান। তিনি ক্যান্টমেন্টের ভেতরই একটি বাসায় থাকা সত্বেও মুক্তিযোদ্ধদের সহযোগিতা করার বুদ্ধি বের করতে থাকেন। অনেক চেষ্টার পর যশোহর ক্যন্টনমেন্টের একটি লে আউট যোগার করতে পারেন এবং সেটি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সরবরাহ করতে পারেন। তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে শ্রমিক পরিচয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দু’একজন সদস্যকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের অবস্থান ও স্থাপনাগুলো দেখান। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে বরিশাল থেকে একজন হিন্দুকে ধরে আনা হলে তিনি বিশেষ কায়দায় তাকে পাকিস্তান আর্মিদের হাত থেকে বাঁচিয়ে তাকে আবারো বরিশালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
১৯৮০ সালে তাঁর পত্নিবিয়োগ হলে বিশাল সংসার সামলানো তাঁর খুব কঠিন হয়ে পড়ে। অবশেষে তিনি ১৯৮৪ সালের ১৭ অক্টোবর নার্গিস চৌধুরীকে বিয়ে করেন। আজো তিনি এই সুবিশাল মানুষটিকে আর পরিবারটিকে আগলে রেখেছেন।
মহৎ মানুষ সব সময়ই মহৎ চিন্তা করেন নিজের জীবনের অবস্থান উপেক্ষা করেও। সেদিন মানবতাবাদী ও গীতিকবি সাবির আহমেদ চৌধুরী যা করেছেন, ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবে।
লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক