শাহ মতিন টিপু
ভোলার কিংবদন্তি ফুটবলার গজনবীর পুরো নাম মো. আমীর জাং গজনবী।
তার বাবা মরহুম রহীম বক্স জাং চৌধুরী, মা মরহুমা আলফাতুন নেসা চৌধূরী। তার দাদা মরহুম তোফায়েল আহমেদ জাং চৌধুরী ছিলেন বরিশাল পৌরসভার প্রথম মুসলিম কাউন্সিলর। যিনি তার স্ত্রী মিসেস নিহার বেগম চৌধুরীর নামে বরিশালের বিবির পুকুর খনন করে অনন্য সমাজসেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তার বড় ভাই মরহুম ফতে জাং চৌধুরী কোলকাতা মোহামেডান এর সার্বক্ষনিক ফুটবলার ছিলেন। ফতে জাং চৌধুরীর বড় ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা কুতুবুদ্দিন চৌধুরী স্বাধীনতার পরের ঢাকা মোহামেডান এর নামকরা ফুটবলার ছিলেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর গজনবী ঢাকা লীগে জয়েন করে ওরিয়েন্টাল ক্লাবের হয়ে খেলেন। তার অসম নৈপুণ্যে ওরিয়েন্টাল ক্লাব পূর্বপাকিস্তান লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল তাকে সংবর্ধিত করেন। ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেই তিনি দৌলতখানের মাঠটি চেয়ে নেন। তিনি দৌলতখানে এসে কয়েকজন ফুটবলারকে নিয়ে দৌলতখান ফুটবল টিম গঠন করেন। যেখানে ছিলেন মোহাম্মদ আলী চেয়ারম্যান, আব্দুর রশীদ চেয়ারম্যান, আব্দুল্লা মিয়া সহ একঝাক তরুণ ফুটবলার। তার গঠিত দৌলতখান উচ্চ বিদ্যালয় নামের ওই টিমটি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে রানার আপ হয়ে বিশেষ সম্মান অর্জন করেছিল।
১৯৫৭ সালের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ৩য় এশিয়ান গেমসে খেলার মাঠে পাকিস্তান দলের ডিফেন্সে বিশেষ দুর্বলতা দেখা দিলে একটি বিশেষ বিমানে করে গজনবীকে টোকিওতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হয়। সাথে গজনবী বেস্ট প্লেয়ার হিসেবে এওয়ার্ডেড হন। ওই ঘটনার পর তার নাম সমগ্র পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অত্যন্ত সঠিকভাবে ফুটবল প্লেসিং করতে পারতেন।
১৯৬২-৬৩ সালের রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মইনুল ইসলাম মোহামেডান এর দায়িত্ব নিয়েই গজনবীকে ক্লাবটি পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেন। মোহামেডান এর আজকের এ ঐতিহ্যের জন্য ক্লাবটিতে গজনবীর অবদান রয়েছে।
ফুটবলের বাইরেও গজনবীর নিজ এলাকার মানুষের প্রতি ছিল গভীর টান।এলাকার যে কেউ তার পর্যন্ত পৌঁছতে পারলে কখনো খালি হাতে ফেরাননি। ভোলা-চরফ্যাশন আঞ্চলিক মহাসড়কটির গোড়াপত্তন করেছিলেন এ মহান ব্যক্তি। এছাড়াও ভোলা-তজুমুদ্দিন ভায়া দৌলতখান সড়কটিতেও তার বিশেষ অবদান রয়েছে বলে জানান তার ভাইয়ের ছেলে কুতুবুদ্দিন চৌধুরী।
ভোলা জেলা স্টেডিয়ামটির নামও তারই নামে নামকরণ করা হয়েছে। ২২ আগস্ট ছিল তার ২৪তম মৃত্যু দিবস।
ভোলার আরেক ফুটবলার হাফিজ। যাকে আমরা মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন আহমদ নামে জানি। বরিশালে বালক বেলা থেকেই ফুটবলে নাম করেছিলেন হাফিজ। ১৯৬১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন হাফিজ। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব খেলাধুলা হতো। আন্তঃবিভাগ ফুটবলে তিনি প্রথম দুটো ম্যাচে হ্যাট্রিক করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে বরিশাল থেকে একটা ছেলে এসেছে যে শুধু গোল করে! ঢাকা লিগের কর্মকর্তাদের কানেও কথাটা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচ ছিলেন সাহেব আলী। তিনি তাকে ফায়ারসার্ভিসে নিয়ে গেলেন। ’৬২ সালে ফায়ারসার্ভিস দিয়ে তার খেলা শুরু। ওয়ান্ডারার্সে খেলেন ’৬৬ সালে। এরপর স্বপ্নের ক্লাব মোহামেডানে। গজনবী তখন মোহামেডানের কর্মকর্তা। তিনিই তাকে নিয়ে আসেন মোহামেডানে। ’৬৭ সালে মোহামেডানে ঢোকেন। ১৯৭৮ সালে এই ক্লাব থেকে অবসর নেন।
১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলেও খেলেছেন হাফিজ। ’৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় দলের অধিনায়কও ছিলেন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান দলে দু’জন বাঙ্গালী হাফিজ এবং প্রতাপ (প্রতাপ শংকর হাজরা) সুযোগ পান। সৌদি আরব ফুটবল দলের বিপক্ষে ঢাকায় খেলেন। একই বছর নভেম্বরে একমাত্র বাঙ্গালী হিসেবে এশিয়ান কাপ খেলতে যান রেঙ্গুনে। ইরানে (তিনবার) এবং তুরস্কেও খেলেছেন। মোহামেডানের এই স্ট্রাইকার লিগে প্রথম ডাবল হ্যাট্রিক করেন। ১৯৭৩ সালে ফায়ারসার্ভিসের বিপক্ষে ৬-০ গোলে জিতেছিল মোহামেডান। সবগুলো গোলই করেছিলেন তিনি।
অ্যাথলেট হিসেবেও হাফিজের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ১৯৬৪, ’৬৫ এবং ’৬৬ এই তিন মৌসুম পূর্ব পাকিস্তানের দ্রুততম মানব ছিলেন। ১০০ ও ২০০ মিটারে রেকর্ড টাইমিংয়ে স্বর্ণ পদক জেতেন।
’৫০ এবং ’৬০ এর দশকে বরিশালের বিখ্যাত খেলোয়াড় গজনবী (আমির জং চৌধুরী) ছিলেন ফুটবলে হাফিজের আদর্শ। বাঙ্গালীর পাঠানখ্যাত এই ডিফেন্ডারকে দেখেই বড় হয়েছেন। একসময় বরিশালের হয়ে গজনবীর সাথে ফুটবলও খেলেছেন। স্বপ্নের নায়কের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন বড় হওয়ার।
এক সাক্ষাৎকারে হাফিজ বলেন, গজনবী নামে মোহামেডানের একজন ফুটবলার ছিলেন। তিনি বরিশালের মানুষ। জেলা লিগে তাঁকে খেলতে দেখতাম। তাঁকে পত্রিকায় এবং বাস্তবে দেখে খেলার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। স্বপ্ন দেখতে থাকি আমিও একদিন তাদের মতো খেলোয়াড় হবো।
শাহ মতিন টিপু: স্থায়ী সদস্য, জাতীয় প্রেস ক্লাব। সহ সভাপতি, ভোলা জার্নালিস্ট ফোরাম, ঢাকা।