মিহির কান্তি রাউত
বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখকদের অনেকের হস্তাক্ষরের সাথে আমি পরিচিত। যাদের হস্তাক্ষর দেখতে অসুন্দর ( শ্রদ্ধা রেখেই বলছি ) মনে হয়েছে আমার কাছে ; তারা দুজন হলেন সাংবাদিক ও লেখক রাহাত খান এবং শিক্ষক ও ঔপন্যাসিক হূমায়ুন আহমেদ।
অপরদিকে,অসম্ভব সুন্দর হস্তাক্ষর যাদের তারা হলেন কবি শামসুর রাহমান ( আমার কাছে সেটা রাবীন্দ্রিক স্টাইল) , ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ( রিটনীয় স্টাইল) , আমীরুল ইসলাম ( আমীরুলীয় স্টাইল) , ওবায়দুল গনি চন্দনসহ বেশ কিছু লেখক।
আপনারা হয়তো বলবেন ,আপনি কি করে জানেন? হা , আমি জানি । কারণ, আমি অনেকের হাতের লেখা পাঠ করেছি ,দেখেছি বহুবার ।
॥১॥
একটি ঘটনা বলি ।আমি তখন ইত্তেফাকে ফিচার সম্পাদকের সহকারী । ইত্তফাকের বিশেষ সংখ্যাগুলোর জন্য নির্বাচিত লেখকদের লেখা সংগ্রহ, তারপর সেগুলো ফিচার সম্পাদক দাদাভাইকে পড়ে শোনানো, আবার নিজে পড়ে দেখা , তারপর কম্পোজ বিভাগে পাঠানো – এ কাজগুলো নিয়মিত করতে হতো।
উল্লেখ্য, কোন লেখকের ( যে যতো প্রতিষ্ঠিত লেখকই হোন না কেন ) লেখা না পড়ে দাদাভাই সহজে কম্পোজে দিতেন না । অনেক সময় জ্যেষ্ঠ লেখকদের সাথেও কথা বলে নিয়ে লেখা সম্পাদনা করার হলে তা করে তারপর কম্পোজে দিতেন।
দাদাভাই একবার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রাহাত খানের একটা গল্প চাইলেন এক বিশেষ সংখ্যার জন্য। রাহাত খান এতো ব্যস্ত মানুষ যে ফরমায়েশি লেখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তবুও তিনি অফিসে বসেই দাদাভাইয়ের অনুরোধের লেখাটি লিখছিলেন । মনোনীত বাকী সব লেখার কম্পোজ শেষ । পেজ সেট আপের কাজও প্রায় শেষ। শুধু গল্পটার জন্য একটা জায়গা বরাদ্দ রেখে ডামিও তৈরি করেছেন শিল্পী আইনুল হক মুন্না । কিন্তু রাহাত খানের লেখা শেষ হয়নি তখনো । তিনি লেটারপ্যাডের সাইজে নিউজপ্রিন্ট কাগজে চার কি পাঁচ পাতা মাত্র লিখেছেন । দাদাভাইয়ের তাগাদায় রাহাত খান সেটাই পাঠিয়ে দিলেন ।দাদাভাই সেটা পড়তে চাইলেন । দু লাইন পড়েই আমাকে বললেন, ’পড়ো’। আমিও ব্যর্থ । তারপর বললেন, ‘পাঠিয়ে দাও কম্পোজে ‘। কম্পোজ হলে পর পড়ে দেখবো । তাই করা হলো ।কম্পিউটার কম্পোজ বিভাগের একজন ( নাম ভুলে গেছি ) আছেন যিনি রাহাত খানের হাতের লেখা খুব ভালো করে চেনেন এবং নির্ভুল কম্পোজ করেন।
রাহাত খানের লেখার বৈশিষ্ট্য ছিল- লেখার প্রথম লাইন শুরু হয় সোজা হয়ে, ক্রমান্বয়ে তা নিম্নমুখী বাঁক নিয়ে শেষ হয় । এতো ছোট ও প্যাচানো অক্ষর তা বাংলা বলে ভাবা কঠিন । পুরো পাতার লেখাটা স্বরলিপি লেখার মতো। অদ্ভুত রকমের দেখতে। তার সহকারী কবি সৌরভ জাহাঙ্গীরও তার লেখা দেখে দেখে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন দীর্ঘদিন পর। হস্তাক্ষর যেমনই হোক, রাহাত খানের গদ্য ! পাঠকরা জানেন। অনবদ্য। অপূর্ব। তাঁর ‘দিলুর গল্প’ আমাকে কেন, তাবৎ সাহিত্যপ্রেমীদের আকর্ষন করেছিল। সেই গল্প পাঠের মুগ্ধতা আছে আজ অব্দি।যাহোক, সেই চার পাতার কম্পোজ দাদাভাইয়ের হাতে আসার পর পরই গল্পের বাকী অংশটুকুও তিনি সৌরভ ভাইকে দিয়ে পাঠালেন । আগের মতোই সেটাও কম্পোজ হয়ে এলো । ছাপা হবার পর গল্পটা পাঠ করছিলাম আর তাঁর অদ্ভুত হাতের লেখাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো।
এই হলেন কথাশিল্পী রাহাত খান।
॥২॥
একবার সম্পাদক রাহাত খানের কাছে আমি একটা লেখা নিয়ে গেলাম । লেখাটি লিখেছিলাম অর্পিত সম্পত্তি আইনের সমস্যা নিয়ে ।এ রকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে একটা লেখা লিখবো আমি ! সম্পাদক রাহাত খান বিশ্বাস করতে পারছিলেন না । শিরোনাম দেখে আমাকে শুধু বললেন, ’এটা তোমার লেখা ? তিনি ভেবেছিলেন , মিহির শিশুসাহিত্য করে , সে আবার এতো গুরুগম্ভীর লেখা লিখবে ? ‘আমি বল্লাম, হা। তিন কি চার দিন পর আমার লেখাটির কোন অংশ এডিট না করে তিনি ছেপেছিলেন। লেখাটি ছাপা হবার পর অনেক বিজ্ঞজনের প্রশংসা পেয়েছিলাম আমি। এই হচ্ছেন সম্পাদক রাহাত খান ।
আমার ও ইত্তেফাকের প্রায় ৫০০ এর অধিক কর্মীর সম্পাদক ছিলেন তিনি ।
তিনি রাহাত খান :
রাহাত খান ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পূর্ব জাওয়ার গ্রামের খান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমাদৃত হলেও কর্মসূত্রে রাহাত খান আপাদমস্তক সাংবাদিক ( তথ্যসূত্র: চ্যানেলআই অনলাইন)
তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।শিক্ষা জীবন শেষ করে রাহাত খান ময়মনসিংহ জেলার নাসিরাবাদ কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক বর্তমান।( তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)
বিদায় রাহাত খান:
২৮ আগষ্ট ,২০২০ , আমার সম্পাদক রাহাত খান বিদায় নিলেন ।
আশিতে পা রেখেছিলেন তিনি ।
একজন লেখক , শিক্ষক, সাংবাদিক- সম্পাদক , টেলিভিশন উপস্থাপকের প্রস্থান হলো ।
ধীরলয়ে , অসম্ভব সুন্দর শব্দচয়নে কথা বলা এক গুণীজনের প্রস্থান হলো ।
বেদনার সংবাদ ।
কস্টের সংবাদ।
আমার কেবলি মনে হয় , সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কথাশিল্পী রাহাত খানের সৃষ্টি আশি বছরে যা হবার কথা ছিল তার চাইতে নিতান্তই কম হয়েছে।
পাঠকদেরও তাই মনে হয়?