রাবিতে ফের অধ্যাপক খুন, ঘাতক ‍এল মোটরসাইকেলে

শহিদুল ইসলাম, রাবি  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজশাহী মহানগরীর শালবাগানের বটতলা এলাকায় ওই শিক্ষকের বাসা থেকে ৫০ গজ দূরে তাকে হত্যা করা হয়। নিহত শিক্ষকের নাম এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর।

প্রফেসর সিদ্দিকীর নির্মম হত্যাকান্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মুহম্মদ মিজানউদ্দিন ও উপ-উপাচার্য প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহান গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তাঁরা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যাকান্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃৃপক্ষের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যও আহ্বান জানান।

উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকান্ডে প্রফেসর সিদ্দিকীর অবদান গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। তাঁরা মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনাও জ্ঞাপন করেন।

এদিকে শিক্ষক হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, প্রগতিশীল ছাত্রজোট এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এ ছাড়াও শিক্ষক হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিভিন্ন সংগঠন নিন্দা জানিয়েছে।

বোয়ালিয়া থানার ওসি শাহদাত হোসেন বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ৫০ গজ দূরে প্রফেসর রেজাউলের বাড়ি। তাকে হত্যার কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। কোনো জঙ্গি সংগঠন এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, হত্যাকান্ডের পরই প্রতিবেশীরা মোটরসাইকেলের শব্দ শুনেছেন। ওই মোটরসাইকেলে ২ থেকে ৩ জন যুবক ছিলো বলে ধারণা করছেন তারা। খুনিরা প্রফেসর  সিদ্দিককে হত্যার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়।

রেজাউল করিম সিদ্দিকীর গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়। তার স্ত্রী হোসনে আরা শিলা গৃহবধূ। তার দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র এবং মেয়ে রেজোয়ানা হাসিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী।

নিহত রেজাউল করিমের ভাই ও নাটোরের সিংড়া থানার শিক্ষা কর্মকর্তা সাজিদুল করিম সিদ্দিকী বলেন, সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টা ৪০ মিনিটের বাস ধরতে রেজাউল করিম বাসা থেকে বের হন। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই বাসা থেকে একটু দূরে আরেকটি বাসার মেইন গেটের সামনে তার গলা কাটা লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ভাই রেজাউল করিমসহ তারা ২৬১ শালবাগান (সপুরা) এলাকায় পৈতৃক বাড়িতে একসঙ্গে বাস করতেন বলেও জানান সাজিদুল করিম। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার দরগাবাড়ি এলাকায়। তার ভাইকে কেউ কখনও কোনো ধরনের হুমকি দিয়েছিল কি না, তা জানাতে পারেনি সাজিদুল করিম।

প্রফেসর রেজাউল করিমের স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ‘ভালো মানুষ বাসা থেকে বের হয়ে গেল। এরপর রাস্তার মধ্যে খুন হলো। তাকে কে বা কারা খুন করলো? তার তো কোনো শক্র ছিল না। কারো সঙ্গে তার কোনো ঝামেলাও ছিল না।’

প্রফেসর রেজাউল করিম ‘কোমলগান্ধ্যা’ নামে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা সম্পাদন করতেন। তিনি ভালো সেতার বাদক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘সুন্দরম’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্ঠা ছিলেন।

‘সুন্দরম’ সংগঠনের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন শাখার সেকশন অফিসার হাসান রাজা বলেন,‘ তিনি একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। তিনি যে ধরনের লেখালেখি করতেন তা খুবই সাধারণ। আমরা যতটুকু জানি তার গ্রামের বাড়িতে জমিজমা নিয়ে সেখানকার কিছু লোকের সঙ্গে ঝামেলা ছিল। এ ঘটনার জেরে এ হত্যাকা- ঘটে থাকতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও একই বিভাগের সহকর্মী ড. মো. শহীদুল্লাহ্ বলেন, ‘প্রফেসর রেজাউল সিদ্দিকীর মতো একজন নিরীহ মানুষ এভাবে হত্যার শিকার হতে পারে তা ভাবা যায় না। একের পর এক শিক্ষক হত্যার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যেন বদ্ধভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমরা আর কোনো শিক্ষকের লাশ দেখতে চাই না। এসময় তিনি দ্রুত এ হত্যাকান্ডের বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

তিনি আরও বলেন, যতদিন এ হত্যাকা-ের বিচার না হবে ততদিন আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আমরা শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে  রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় র‌্যালি ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবো। সেই সঙ্গে আজ রোববার ক্লাশ বর্জন করা হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।

এ হত্যাকান্ডের বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে একের পর এক হত্যা করা হচ্ছে। ড. ইউনূস, ড. তাহের, ড. শফিউলের পর সর্বশেষ ড. সিদ্দিকীকে হত্যা করা হলো। এর মাধ্যমে একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন মেধাবী শিক্ষকদের হারাচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষকদের এই নিরাপত্তাহীনতা দূর করা দরকার। এজন্য সরকাররের বিভিন্ন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজ করে এর পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করতে হবে।’

স্থানীয় একজন জানান, সকাল ৯টার দিকে তিনি হত্যাকা-স্থলে গিয়ে দেখতে পান রাজশাহী মহানগরীর শালবাগানের বটতলা এলাকায় রেজাউল সিদ্দিকীর বাড়ি থেকে ৫০ গজ দূরে একটি গলির মধ্যে দুর্বৃত্তরা তাকে গলা কেটে হত্যা করে ফেলে রেখেছে। মরদেহের আশেপাশে রক্ত ছিটিয়ে পড়ে আছে।

আশেপাশের লোকজন জানান, ওই শিক্ষক সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে হেলমেট পরা দুইজন মোটরসাইকেল আরোহী তার ঘাড়ে চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ, গোয়েন্দা, র‌্যাব ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

উল্লেখ্য, প্রফেসর এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৩ সালে ইংরেজী বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন ও ২০০৬ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক কন্যা ও এক পুত্র রেখে গেছেন।

এর আগে ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর বিকালে খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর কে এম শফিউল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় নিজ বাসার সামনে দুর্বৃত্তদের হামলা খুন হন তিনি। এরও বেশ আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুজন শিক্ষক খুন হন।

২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় প্রাতর্ভ্রমণের সময় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসকে। ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর এস তাহের। দুই দিন পর ক্যাম্পাসের বাসার পাশের ম্যানহোলের ভিতরে তার লাশ পাওয়া যায়।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts