ঢাকায় পাক সেনাদের গণহত্যা ও কয়েকজন ডোমের বর্ণনা

মুসা সাদিক

আজ থেকে ৫০ বছর আগে ৭১ সালে আমি ছিলাম রণাঙ্গনে। স্বাধীন বাংলা বেতারের “রণাঙ্গন সংবাদদাতা” হিসেবে ১১টি সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সঙ্গে আমি উল্কার বেগে ছুটতাম। আজ এক রণাঙ্গনে ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে সকাল কেটেছে, পরদিন আবার সন্ধ্যায় অন্য রণাঙ্গনে দুপক্ষের কামানের গোলা বারুদে ভারী বাতাসের মধ্যে নিঃশ্বাস টানতে হয়েছে। কখনো রণাঙ্গনের বাতাস হিমালয়ের মতো ভারী হয়ে উঠেছে বিউগিল এর অন্তিম সুরে, যখন কোন বীর মুক্তিযোদ্ধার ছিন্ন ভিন্ন দেহ অশ্রুজলে বিদায় দিয়ে তার সহযোদ্ধারা চির নিদ্রায় শায়িত করে দিয়েছেন রণাঙ্গনেরই মাটিতে।

মনে পড়ছে ৯ নম্বর ক্যা. সেক্টরে শাজাহান মাষ্টারের নেতৃত্বে পাক সেনাদের সঙ্গে মুখোমুখি সমরে সাতক্ষীরা হাবলু-এনামুলদের প্রিয় সহযোদ্ধা খোকনের আত্মদানের কথা। সে শহীদ বীর খোকনের পবিত্র লাশটুকু দেয়নি বর্বর পশু পাক সেনারা।

মনে পড়ছে, তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে বীর তরুণ দুলুমিয়ার আত্মদানের কথা। সেক্টর কমান্ডার শফিউল্লাহ সাহেবের হাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় বীর দুলু মিয়া বলে যান “স্যার বঙ্গবন্ধুকে আমার রক্ত ভেজা শার্ট দেখিয়ে বলবেন, তিনি বলেছিলেন “তোমরা রক্ত দেয়ার জন্য তৈরী হয়ে যাও। আমি রক্ত দিয়েছি। আমি এখন মৃত্যুর পথে। আমার মৃত্যু হলে আমাকে বাংলাদেশের মাটিতে কবর দেবেন।”

মনে পড়ছে রাধানগরের যুদ্ধের মহান বীর শহীদ সুবেদার সদরুদ্দীনের কথা। তার বাড়ি থেকে যখন যুদ্ধের মধ্যে খবর আসে যে, তার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। কিন্তু মাতৃভূমির ডাক ফেলে, যুদ্ধ ফেলে, তিনি তার প্রথম প্রিয় সন্তানকে দেখতে যেতে পারেননি। সেই জাতীয় বীর ১৬ অক্টোবরে তিতিদাহের যুদ্ধে পাক সেনাদের কামানের গোলায় পাজরে শেলের মারাত্মক আঘাত পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মুহূর্তে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে শেষ কটি কথা খুব কষ্টে বলেছিলেন: “খুব কষ্ট নিয়ে মারা যাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে গেলাম না। আমার প্রথম পুত্রের মুখও দেখে গেলাম না। আমার বাবাও আমার মুখ দেখতে পেলো না।”

আজ মহান বিজয় লগ্নে মুক্তিযুদ্ধের শত সহস্র রণাঙ্গনে অজানা হাজার হাজার বীর শহীদের শেষ কথা কানে বাজছে। শেষ অশ্রু আমার চোখে ভাসছে।

রণাঙ্গনে সেদিন যারা বীর বিক্রমে লড়েছিলেন, তাদের বীরত্ব গাঁথা হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ” ১৫ খন্ডে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৭৭ সালের আগষ্টের শেষে একদিন তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আকবর কবিরের তদানিন্তন একান্ত সচিব খান আমির আলীর কক্ষে আমাকে বললেন, “মুক্তিযুদ্ধের ওপর তুমি অনেক মর্মস্পর্শী লেখা লিখেছো। আমি “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ” ইতিহাস প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে ঢাকা পৌরসভার ডোম ও সুইপার এবং সুপার ভাইজারদের থেকে এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের তৃতীয়/ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ও পুলিশ অফিসারদের থেকে ২৬ মার্চের গণহত্যা বিষয়ে লোমহর্ষক অনেক তথ্য পাচ্ছি। তুমি তাদের সাক্ষাৎকারগুলো নিয়ে রাখো। বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিও যে, পাক সেনারা নরপশু ছিল। তারা মানুষ ছিল না। তারা হিটলারের চেয়েও বড় যুদ্ধাপরাধী ছিল।”

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা খান আমির আলীও (সরকারের সাবেক সচিব) অনুরূপ উৎসাহ দিলেন। তাদের দুজনের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে পরদিন থেকে পর পর কয়েকদিনে আমি ঢাকা পৌরসভার যে সব ডোম ও সুপারভাইজার ২৬ মার্চ থেকে ঢাকায় লাশ তোলার কাজ করেছে এবং পরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ৩য় এবং ৪র্থ শ্রেণীর যেসব কর্মচারী ও পুলিশ অফিসার কাজ করেছেন, তাদের সকলের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করি।

ঢাকা রেলওয়ে সুইপার কলোনীতে ৭১ সালে বসবাসকারী ঢাকা পৌরসভার সুইপার চুন্নু ডোম ২৬ মার্চের গণহত্যার এক সাক্ষী। ২৬ মার্চ থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত নর-নারীর লাশ তিনি অন্যান্য সুইপারদের সঙ্গে মিলে নিজ হাতে তুলেছেন। ঢাকা পৌরসভার চুন্নু ডোমকে আমি জিজ্ঞেস করলাম: ২৬ মার্চ ঢাকার কোথায় আপনি কি ডিউটি করেছিলেন?

চুন্নু ডোম: ১৯৭১ সনের ২৮ মার্চ সকালে ঢাকার পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ উঠাবার জন্য আমাকে ডেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখি, বদলু ডোম, রঞ্জিত ডোম (লাল বাহাদুর), গণেশ ডোম ও কানাই ডোম আগে থেকে সেখানে আছে। আমাদের একটি ট্রাকে করে প্রথমে শাখারী বাজারের কোর্টের প্রবেশপথের সামনে নামিয়ে দেয়। ঢাকা জজ কোর্টের দক্ষিণ দিকে ঢোকার মুখে যে পথ শাখারী বাজারের দিকে চলে গেছে সেখানে গিয়ে পথের দু’ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, শিশু-কিশোর বহু পচা লাশ দেখতে পেলাম। তার মধ্যে বহু লাশ পচে, ফুলে বীভৎস হয়ে গেছে। দেখলাম শাখারী বাজারের দুদিকের ঘরবাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। অনেক লোকের আধপোড়া লাশ চারিদিকে পড়ে আছে দেখলাম। কাছাকাছি সব সশস্ত্র পাঞ্জাবী সৈন্যরা পাহারায়। প্রত্যেক ঘরে দেখলাম মৃত নর-নারী-শিশু জ্বলছে, আসবাবপত্র জ্বলছে। একটি ঘরে প্রবেশ করে একজন মেয়ে, একজন শিশুসহ বার জন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছি। সেই অবস্থার মধ্যে আমরা সবাই মিলে শাখারী বাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ তুলেছি। পাঞ্জাবী সৈনিকেরা সেখানে থাকা অবস্থায় সেই সব মানুষের অসংখ্য লাশের উপর বিহারীদের আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম। প্রতিটি ঘর থেকে বিহারীরা মূল্যবান সমগ্রী, সোনাদানা সবকিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে দেখলাম।

চুন্নু ডোম এখানে এক মর্মস্পর্শী ঘটনার মুখোমুখি হয়। সে কথা উল্লেখ করে চুন্নু ডোম বলেন, শাখারী বাজারে সারাদিন ধরে অসংখ্য লাশ উঠাতে, উঠাতে হঠাৎ এক ঘরে প্রবেশ করে এক আহত অহসায় বৃদ্ধাকে দেখলাম। বৃদ্ধা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করছিল। তাকে আমি পানি দিতে চেয়েও পানি দিতে পারিনি। আমি পানি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের পিছনে সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনা পাহারায় থাকায় আমি সেই বৃদ্ধাকে পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারিনি।

এই সব লাশ নিয়ে তারা কি করেছে জানতে চাইলে চুন্নু ডোম বলেন, আমরা নির্দেশ মতো, ২৮ মার্চ শাখারী বাজার থেকে প্রতিবার এক/দেড় শত লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাক বোঝাই করে তিন শত লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ১৯৭১ সনের ২৯ মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘর ও প্রবেশ পথের দু পাশে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা কালীবাড়ি, শিববাড়ি, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল, থেকে শত শত লাশ উঠিয়েছি।

মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে লাশ তোলার লোমহর্ষক ও হৃদয় বিদারক চিত্র তুলে ধরে চুন্নু ডোম বলেন, ২৯ মার্চ আমাদের ট্রাক প্রথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে যায়। আমরা পাঁচ জন ডোম মিলে হাসপাতালের প্রবেশ পথে নেমে কয়েকজন বাঙালি যুবক ও যুবতীর পচা, ফোলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাটার সাথে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলতে হয়েছে। ইন্সপেক্টর পঞ্চম আমাদের সাথে ছিলেন। সেখান থেকে আমরা লাশ ঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ বৃদ্ধা, কিশোর ও শিশুর স্তূপীকৃত লাশ দেখলাম। সে যেন লাশের পাহাড়। আমি এবং বদলু ডোম লাশ ঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি। আর রঞ্জিত (লাল বাহাদুর), কানাই ও গণেশ ডোম কাঁটা দিয়ে বিধিয়ে বিধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। সেখানকার প্রতিটি লাশ শত শত গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া অবস্থায় পেয়েছি। মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাইনি। মেয়েদের লাশের যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পাছার মাংস কেটে নেয়া অবস্থায় দেখেছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, তাদের হত্যা করার পূর্বে তাদের স্তন ধারালো ছোরা দিয়ে কেটে তুলে নেয়া হয়েছে। মেয়েদের যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং পিছনের মাংস যেন ধারালো চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি যুবতী মেয়ের মাথায় খোপা খোপা চুল দেখলাম। তাদের সুন্দর মুখগুলো দেখে খুব কষ্ট পেলাম বুকে। এই সুন্দর সুন্দর মেয়েদের বাবা-মা কোন দিন এদের মুখ আর দেখতে পাবে না মনে করে খুব কষ্ট হলো। মিডফোর্ট থেকে আমরা প্রতিবার এক/দেড় শত লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। এভাবে দিনে ও রাতে কয়েকবার ফেলেছি।

পরের দিন ৩০ মার্চ তারা কোথায় কোথায় ডিউটি করে সে প্রসঙ্গে চুন্ন ডোম বলেন, ৩০ মার্চ দক্ষিণা ডোম আমাদের পাঁচ জনের সাথে কাজে যোগ দেয়। আমাদের ট্রাক নিয়ে ৩০ মার্চ আমরা সেদিন সাত মসজিদ রোড যাই। আমি সাত মসজিদের সামনে থেকে যখন বাঙালির লাশ উঠাচ্ছিলাম, তখন অসংখ্য বিহারী লোকজন আমাদের চারদিকে দাঁড়িয়ে হাসছিল আর শেখ মুজিব সাহেবের নামে গালি দিচ্ছিল। আমরা সাত মসজিদের সামনে থেকে আটটি বাঙালী যুবকের লাশ তুলেছি। অনেক লাশ দেখলাম উপুড় হয়ে আছে। সবার বুক ও পিঠ গুলির অসংখ্য আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। আমরা তাদের পচা, ফোলা লাশ তুলতে গিয়ে দেখলাম, লাশের কারও লুঙ্গি পরা, কারও পাজামা পাঞ্জাবী পরা। অনেকের আবার হাওয়াই শার্ট এবং টেট্রনের দামী প্যান্ট পরা দেখলাম। পানি থেকে বারটি লাশ তুলেছি। লাশগুলো চোখ এবং হাত পিছন দিকে বাঁধা ছিল। নদীর পাড় থেকে বারটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা অবস্থায় পেয়েছি। লাশ দেখে মনে হলো, অভিজাত বাঙালী পরিবারের যুবকদের লাশ। সাত মসজিদের সকল লাশ তুলে ধলপুরের ময়লা ডিপোতে আমরা ফেলেছি।

চুন্নু ডোম বর্তমানে মন্ত্রীদের বিখ্যাত পাড়া নামে খ্যাত মিন্টু রোডেও সেদিন লাশ তোলার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে বলেন, আমরা ঐ দিন ওখান থেকে ফিরে মিন্টু রোডে লাশ তুলতে যাই। মিন্টু রোডের পাশ থেকে প্যান্ট পরা অবস্থায় দুই যুবকের দুটি পচা লাশ তুলেছি। সে লাশ নিয়ে ধলপুর যাবার পথে ঢাকা স্টেডিয়ামের সামনে থেকে এক বৃদ্ধ ফকিরের সদ্য গুলিবিদ্ধ লাশ তুললাম। দেখলাম লাশের পাশেই তার ভিক্ষার ঝুলি, শূন্য টিনের ডিব্বা ও লাঠি পড়ে আছে। সে লাশ তোলার সময় দেখলাম তার টিনের ডিব্বায় কোন পয়সা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের কোন লাশ তারা তুলেছে কিনা? সে প্রশ্ন করলে চুন্নু ডোম বলেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ির সামনে থেকে দুজন রূপসী ছাত্রীর এবং তিন ছাত্রের লাশ তুলেছি। লম্বা, ফরসা, মাথা ভর্তি চুল রূপসী মেয়েদের স্তন সব কাটা পেয়েছি। তাদের ঠোঁট দুটি কাটা পেয়েছি এবং যোনিপথে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব ছাত্রীর লাশ তুলে আর কোন ছাত্রীর লাশ পড়ে আছে কিনা দেখার জন্য আমরা রোকেয়া হলে যাই। সেখানে একটি অর্ধ যুবতীর লাশ তুলেছি। তারও স্তন ছোরা দিয়ে কেটে নেয়া অবস্থায় পেয়েছি। মুসলিম হলে প্রবেশ করে একটি লাশ পেয়েছি, হলের ভিতর থেকে চারজন ছাত্রের লাশ তুলেছি। তাদের একজন উত্তম কুমারের মতো দেখতে। তার মুখে চাঁদের হাসি ছিল। দেখে আমার খুব মায়া ও কষ্ট হয়। পরের দিন ৩১ মার্চ বাসাবোর খাল থেকে তিনটি পচা লাশ তুলেছি। এ কয় দিন একসাথে শত শত লাশ তুলে এবং শিশু নির্যাতন দেখে, আমার হাঁটা চলার ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেলি। সময় সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ফলে, লাশ তোলার কাজ আমি আর করিনি। অন্যরা করতে থাকে।

চুন্নু ডোমের ন্যায় ২৬ মার্চ থেকে শত শত লাশ তোলার দায়িত্ব পালন করেছে ঢাকার অন্যান্য ডোমরা।

২৬ মার্চ থেকে ঢাকার কোথায়, কার নির্দেশে তিনি কি ডিউটি পালন করেছেন, জানতে চাইলে পরদেশী ডোম বলেন, ১৯৭১ সনের ২৭ মার্চ সকালে রাজধানী ঢাকায় সেনাদের গণহত্যাকান্ডের পর ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলি খান প্রশাসনিক অফিসার ইদ্রিস আরও কয়েকজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে পশু হাসপাতালে এসে চিৎকার আমার নাম “পরদেশী, পরদেশী” বলে ডাকাডাকি করতে থাকে। আমি ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে আমার পশু হাসপাতাল কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসি। ইদ্রিস সাহেব ক্ষ্যাপা স্বরে বলতে থাকেন, তোমরা সব ডোম ও সুইপার বের হও। যদি বাঁচতে চাও বেরিয়ে এসো। পালিয়ে থেকে পাক আর্মির হাত থেকে বাঁচতে পারবেনা।

পৌরসভার ঐ লোক গুলো ছিল আর্মির লোক’ একথা বলে পরদেশী ডোম বলেন, পৌরসভার সেই ট্রাকে আগে সুইপার লাড্ডু, কিষন ভরত বসা। তার নির্দেশ অমান্য করার কোন উপায় নেই দেখে উঠে বসলাম। সেই ট্রাকে করে ঢাকা পৌরসভা অফিসে গিয়ে আমাদের আঠার জন সুইপার ডোমকে একত্রিত করা হলো। সেখানে ছয়জনের সাথে রাজারবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রেরণ হয়। আমি মিটফোর্ডগামী ট্রাকে ছিলাম।

মিডফোর্টে হাসপাতালে আপনারা কাদের লাশ তুললেন প্রশ্নের উত্তরে পরদেশী ডোম বলেন, আমাদের ট্রাক সকালে মিডফোর্ট হাসপাতালের লাশ ঘরের সামনে উপস্থিত হলে আমরা ট্রাক থেকে নেমে লাশ ঘরে ঢুকি। লাশ ঘরে লাশের উপর লাশের পাহাড় দেখে ভড়কে যাই। সব লাশের বুক এবং পিঠ শত শত গুলিতে ঝাঁঝরা। প্রায় এক/দেড় শত যুবক যুবতী ও ছাত্র-ছাত্রীর বীভৎস লাশ দেখে গা ছমছম করে উঠলো। আমার সুপারভাইজারের নির্দেশে আমি লাশ ঘরের ভিতরে গিয়ে প্রতি লাশের পা ধরে টেনে বের করে আনতে থাকলাম। বাইরে দাঁড়ানো অন্যান্য সুইপাররা লাশগুলো দাঁড়ানো ট্রাকে উঠিয়েছে। আমি ও আমার সঙ্গীরা দেখলাম যে, প্রতি লাশের বুক ও পিঠ শত শত গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। বহু মা, বোন ও শিশুর লাশ এভাবে তোলার পর একটি উলঙ্গ লাশ তুলতে গিয়ে কেঁদে ফেললাম।

আমি কিছুক্ষণ তাঁকে শান্ত থাকতে বললাম। অন্যদিন কথা হবে বললাম। কিন্তু সে বললো “আমি স্যার আপনাকে সেদিনের সব ঘটনা বলতে চাই।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “লাশটি কি আপনার কোন আত্মীয় বা আপন জনের লাশ?”

সুইপার পরদেশী বললেন: না স্যার। সব লাশ তোলা শেষে একপাশে একটা লম্বা টেবিলের উপর চাঁদর দিয়ে ঢেকে রাখা একটি লাশের উপর থেকে চাঁদর টানতেই দেখলাম একটি রূপসী যুবতীর উলঙ্গ লাশ। লাশের বুক, যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত। কোমরের উরুর ও পিছনের মাংস ধারালো ছোরা দিয়ে কেটে তুলে নেয়া হয়েছে। মেয়েটির ফুলের মতো শরীরের বুক থেকে স্তন দুটি কেটে তুলে নেয়া। তার কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো ঘন চুল। হরিনের মত মায়াময় চোখ দুটি দেখে, স্যার, আমার চোখ বেয়ে দরদর করে পানি পড়তে লাগলো। আমি কিছুতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। আমি আমার সুপারভাইজারের ভয়ঙ্কর গর্জন ও গালাগালির মুখে সেই সুন্দরীর পবিত্র দেহ অত্যন্ত যত্ন ও সম্ভ্রমের সাথে ট্রাকে উঠিয়ে দিলাম। সেখানে সবাই দেখলো, আমি কাঁদছিলাম আর চোখ মুছছিলাম। তা দেখে আমার সুপারভাইজার আমাকে গালিগালাজ করলেন। কাঁদলে পাক আর্মি আমাকে মেরে ফেলবে বলে ধমকালেন। মিটফোর্ডের লাশঘরের সকল লাশ ট্রাকে উঠিয়ে আমরা ধলপুরে ময়লা ডিপোতে নিয়ে গিয়ে বিরাট গর্তের মধ্যে ঢেলে দিলাম। সেখানে দেখলাম বিরাট বিরাট গর্তের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সুইপার ও ডোমেরা রাজধানী ও ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা শত শত মা, বোন, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও শিশু-কিশোরের লাশ ট্রাক থেকে গর্তের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

পাক সেনারা কি প্রত্যেক বাঙালি মা বোনের ওপর পাশবিক নির্যাতন করে বলে দেখেছেন কিনা’- এই প্রশ্নের উত্তরে পরদেশী ডোম তার সেদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন: পুরুষ-রমনী অধিকাংশ লাশের দেহে কোন কাপড় দেখিনি আমরা। যে সমস্ত যুবতী মেয়ে ও রমনীদের লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলা হয়, তাদের কোন লাশের দেহেই আমরা কোন আবরণ দেখিনি। দুপুর প্রায় দুটার সময় আমরা সেখান থেকে ট্রাক নিয়ে রমনা কালীবাড়িতে আসি। সেখানে দুজন ট্রাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা চারজন কালীবাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখি সব কিছু পুড়ে গেছে। কালিবাড়ির ভিতরে ৪১টি পোড়া ও আধা পোড়া লাশ বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় দেখতে পাই। তাদের মধ্যে একজন মায়ের বুকের ভিতর জড়িয়ে রাখা একটি পোড়া শিশুর লাশ দেখলাম। আমরা ঐ মা ও শিশুর পোড়া লাশসহ ৪১টি পোড়া লাশ ট্রাকে তুলেছি। কালিবাড়ির এসকল লাশ আমরা ধলপুরের ময়লা ডিপোতে গর্তের মধ্যে ফেলেছি। লাশ তুলে তুলে মানুষের পচা চর্বির গন্ধে আমার পাকস্থলী বের হয়ে যাচ্ছিল। পরের দিন অসুস্থ হয়ে আমি আর লাশ তুলতে যাইনি, যেতেও পারিনি, সারাদিন ভাতও খেতে পারিনি।পাকিস্তানী জানোয়ারদের উপর ঘৃণায় কোন কিছু স্পর্শ করতে পারিনি। বারবার সেই পোড়া মায়ের বুকে জড়িয়ে ধরে রাখা পোড়া শিশুর ছবি চোখের উপর উঠে আসে।

অসুস্থ হবার পরে কবে আবার কোন ডিউটিতে গেলেন জানতে চাইলে পরদেশী ডোম বললেন: পরের দিন ২৯ মার্চ সকালে আবার পৌরসভা অফিসে ডিউটিতে গেলাম। আমাকে ট্রাক দিয়ে লাশ তোলার জন্য আরও কয়েকজন সুইপারের সাথে যেতে বলা হলো শাখারী বাজারে। জর্জ কোর্টের সামনে আগুনের লেলিহান শিখা তখনও দাউ দাউ করে জ্বলছিল। তার চারদিকে পাক সেনারা টহলে মোতায়েন ছিল। সে জন্য ট্রাক নিয়ে সে পথ দিয়ে শাখারী বাজারে যেতে পারিনি। পাটুয়াটুলী ঘুরে আমরা শাখারী বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে পাটুয়াটুলি পুলিশ ফাড়ি পার হয়ে আমরা শাখারী বাজারের ভিতরে যেতে পারি। সেখানে ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাখারী বাজারের ঘরে ঘরে গেলাম। প্রতিটি ঘরে দেখলাম মানুষের লাশ। নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক-বালিকা, শিশু-কিশোরের গুলিবিদ্ধ বীভৎস পচা লাশ। মেয়েদের অধিকাংশ লাশ সম্পুর্ন উলঙ্গ পড়ে আছে দেখলাম। বাইরে সড়কে পাঞ্জাবী সেনারা পাগলা কুকুরের মতো লাফাতে লাফাতে গুলি বর্ষণ করছিল। বিহারীরা দলে দলে শাখারী বাজারের ঘরে ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান আসবাবপত্র, সোনাদানা লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। অবিরাম গুলিবর্ষনের মুখে আমরা সকলে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তোলার পর আর লাশ তোলার জন্য সেদিন আর শাখারী বাজারে যেতে সাহস পাইনি।

আমি প্রশ্ন করলাম: কতক্ষণ পরে গুলি বন্ধ হলো এবং কখন আবার আপনারা লাশ তুলতে গেলেন?

পরদেশী ডোম বললেন, ৩০শে মার্চ সকালে মিল ব্যারাক থেকে লাশ তোলার জন্য যে দল সেখানে যায়, তাদের সাথে আমাকেও লাশ তুলতে বলা হয়। মিলব্যারাক ঘাটে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে গিয়ে আমরা দেখলাম নদীর ঘাটে অসংখ্য মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বহু লাশ রশি দিয়ে বাঁধা দেখলাম। প্রতিটি রশির বাঁধন খুলে প্রতি দলে দশ জন / পনের জনের লাশ আমরা বের করলাম। লাশগুলো সব যুবক ও স্বাস্থ্যবান, বালকদের ও তরুনদের লাশও ছিল। সে সব লাশ তোলার সময় আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে, প্রতিটি লাশের পিছন দিক দিয়ে শক্ত দিয়ে হাত বাঁধা ও চোখ বাঁধা। এই লাশ গুলোর চেহারা সুরত দেখে আমরা সবাই বুঝলাম এরা ঢাকা ইউনিভার্সিটি বা কলেজের ছাত্র। হল থেকে চোখ হাত-পা বেঁধে নদীর ঘাটে এনে গুলি করে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে পাক সেনারা। প্রতিটি লাশের মুখমণ্ডল কালো দেখলাম। এসিডে জ্বালিয়ে বিকৃত ও বিকট করে দিয়েছে। লাশের সামনে গিয়ে ঔষধের অসহ্য গন্ধ পেলাম। লাশের কোন দলকে দেখলাম মেশিনগানের শত শত গুলিতে বুক ও পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে আছে। কারো মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে আছে। কারো কাটা হৃদপিণ্ড বের হয়ে আছে। নদীর পাড়ে ছয়জনের যুবতীর ক্ষত-বিক্ষত, বীভৎস উলঙ্গ লাশ দেখলাম আমরা। তাদের পাঁচজনের স্তন কাটা। পাছার মাংস কাটা। চোখ বাঁধা, হাত ও পা শক্ত করে বাঁধা প্রতিটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঝরা। তাদের মুখমন্ডল, বুক ও যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত ও বীভৎস দেখলাম। আমরা দুইবারে দুই ট্রাকে সত্তরটি লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে নিয়ে ফেলেছি। এরপর আমাদেরকে সদরঘাট, বাদামতলী ও শ্যামবাজার থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমরা সেসব এলাকার নদীর ঘাট থেকে ষাটটি পচা লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।

সুইপার পরদেশী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে লাশ তোলার বিষয়ে তার বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বললেন: আমি যেদিন (সম্ভবতঃ ২৭ মার্চ) কালিবাড়ি থেকে লাশ তুলেছি, সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে এবং রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে জনৈক প্রফেসারের বাসা থেকে আমি কয়েকটি লাশ তুলেছি। আমার মনে আছে যে, রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টারের ভিতর দিয়ে গিয়ে পুরুষ, নারী ও শিশুর মোট নয়টি লাশ তুলেছি। আর প্রফেসারের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভিতর পেচানো অবস্থায় এক প্রফেসারের দুই হাত কব্জি থেকে কাটা লাশ আমি তুলে নিয়ে গেছি।

লাশটি কোন প্রফেসারের ছিল। তার নাম জানো কি না? এবং তার লাশ কোথায় নিয়ে যাও”-এ প্রশ্ন করলে সুইপার পরদেশী ভয়ে ভয়ে বলেন যে, তার নাম আমি জানবার চেষ্টা করলে আমাদের সুপারভাইজার আমাকে “হারামী, তেরা বাপ লাগতা হ্যায়” বলে গালি দেয়। আমি মাথা নিচু করে মনে মনে বলি যে, সারে প্রফেসার লোগোনে সারা জাহান কি বাপ লাগে, অউর তু কৌন!

আমি তাকে শেষ প্রশ্ন করি- সেই প্রফেসারের লাশ কোথায় নিয়ে গেলে?

পরদেশী : তার ছাত্রদের লাশ যেখানে ফেলি, তাকেও সেখানে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ছাত্র-প্রফেসার এক সাথে আছে। অন্য কোথাও লাশ নিয়ে যাবার তাকদ আমার ছিল না, স্যার।

(আমাকে দেয়া তার এই সাক্ষাৎকার “বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ৮ম খন্ডে সরকারী দলিলেও পৃথকভাবে প্রকাশিত হয়েছে।)

২৬ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন পাক সেনারা ট্যাঙ্কের কামান দিয়ে গোলা মেরে বাঙালি পুলিশদের কাবু করে দখল করে নেয়। তার পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ থেকে রাজধানীর রাজপথ থেকে পলায়নরত পরিবারদের থেকে বন্দুকের মুখে কেড়ে নিয়ে সুন্দরী মেয়েদের এবং স্কুল, কলেজের ছাত্রীদের এনে পাক সেনারা এখানে বন্দী করে। তাদের জীবনে ৯ মাস কি কিয়ামত এখানে নেমে এসেছিল, তার সাক্ষী রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সে সময়ের সুইপার মিসেস রাবেয়া খাতুন। তার সাথে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে সাক্ষাৎ করি।

তার কাছে আমি প্রশ্ন করলাম : ৭১ এর ২৭ মার্চ থেকে পাক সেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যে সব সুন্দরী বাঙালি তরুনী ও স্কুল, কলেজের ছাত্রীদের ও অন্যান্য মেয়েদের ধরে আনে, সে বিষয়ে আপনি কি জানেন? এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশদের ওপরে এখানে যে নির্যাতন করা হয় সে বিষয়ে কি দেখেছেন?

রাবেয়া খাতুন: ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার পাঞ্জাবী সেনারা যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উপর হামলা করে তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এস, এফ ক্যান্টিনে আমি ছিলাম। ২৫ মার্চের রাতে কামান, গোলা, লাইটবোম আর ট্যাঙ্কের অবিরাম কানফাটা আওয়াজে আমি ভয়ে ব্যারাকের মধ্যে কাত হয়ে পড়ে কাঁপছিলাম। ২৬ মার্চ সকালে ওরা পুলিশ লাইনের এস, এফ ব্যারাকের চারিদিকে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ব্যারাকের মধ্যে প্রবেশ করে বাঙালি পুলিশদের নাকে, মুখে ও সারা দেহে বেয়নেট চার্জ করতে করতে ও বুটের লাথি মারতে মারতে বের করে আনছিল। ক্যান্টিনের কামরা থেকে বন্দুকের নলের মুখে আমাকেও বের করে আনে। পাক সেনাদের নির্যার্তানে অনেক বাঙালি পুলিশ সেখানেই মারা যায়। অনেককে বেয়নেট চার্জ করে ও যাদেরকে তাদের সন্দেহ হয়েছে তখন গুলি করে মারে। আমকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয় এবং কয়েকজন পাঞ্জাবী সেনা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করে। আর অন্যান্যরা কুকুরের মতো হাসিতে ফেটে পড়ছিল। তাদের উপর্যুপরি ধর্ষণে যখন আমার জান বের হয়ে যাচ্ছিল, তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্য ওদের নিকট কাতর মিনতি জানাচ্ছিলাম। হাউ মাউ করে কাঁদছিলাম, আর বলছিলাম আমাকে মেরোনা। আমি সুইপার, আমাকে মেরে ফেললে তোমাদের পায়খানা ও নর্দমা পরিস্কার করার আর কেউ থাকবেনা। তখনও আমার উপর এক পাঞ্জাবী কুকুর, কুকুরের মতই আমার কোমরের উপর চড়াও হয়ে, আমাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করছিল। আমাকে এভাবে ধর্ষণ করতে করতে মেরে ফেললে রাজারবাগ পুলিশ লাইন পরিষ্কার করার জন্য আর কাউকে পাওয়া যাবেনা ভেবে, ওরা আমাকে ছেড়ে দেয়। আমাকে এক পাঞ্জাবী সেনা ধমক দিয়ে বলে, “ঠিক হ্যায়, তোমকো ছোড় দিয়া। যায়েগা জারা বাদ। তোম বাহার নাহি নেকলেগা। হার ওয়াকত লাইন পার হাজির রাহেগা।”

আমি প্রশ্ন করলাম: রাজারবাগ পুলিশ লাইনে এত মেয়ে কিভাবে ২৬ মার্চ আনা সম্ভব হলো এবং পাক সেনারা কি করে জানতো যে কোন বাড়িতে সুন্দরী মেয়ে বা ছাত্রী আছে?

আমার প্রশ্নের উত্তরে রাবেয়া বললেন : ২৫ মার্চের রাতে ঢাকা আক্রমণ করে পাক সেনারা সারা ঢাকায় গণহত্যা ও জ্বালাও-পোড়াও চালালে প্রাণ বাঁচাতে ঢাকাবাসী ঘর বাড়ি ফেলে বউ ছেলে মেয়ের হাত ধরে ঢাকা থেকে পালাতে থাকে। সে অবস্থায় রাজপথে নেমে আসা পরিবারদের মধ্য থেকে পাক সেনারা, জামাত ইসলামীর লোকরা, মুসলিমলীগের দালালরা এবং বিহারীরা পলায়নরতদের মধ্যে থেকে সুন্দরী মেয়েদের বন্দুক-রাইফেলের মুখে কেড়ে নিয়ে পাক সেনাদের জিম্মায় দিয়ে দেয়। যেখানে যার বাবা-মা বা ভাই বাধা দেবার চেষ্টা করেছে সেখানে রাস্তার ওপর পাক সেনারা তাদের গুলি করে মেরেছে। আপন মেয়েকে খান সেনাদের হাতে ফেলে সেই কেয়ামতের দিন রেখে নিজের জীবন নিয়ে বাবা-মা ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। পাঞ্জাবী সেনারা ২৭ মার্চ এভাবে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু সুন্দরী, তরুণী, বালিকা ও বৌদের ধরে ফেলে এবং তাদেরকে জিপে, মিলিটারি ট্রাকে করে পুলিশ লাইনের বিভিন্ন ব্যারাকে নিয়ে আসতে থাকে। আমি কেন্টিনের ড্রেন পরিষ্কার করছিলাম। দেখলাম আমার সামনে দিয়ে জীপ থেকে, আর্মি ট্রাক থেকে লাইন করে বহু সুন্দরী, তরুনী ও বালিকা যুবতী এবং মহিলাকে এস. এফ কেন্টিনের মধ্যে দিয়ে ব্যারাকে নিয়ে রাখা হলো। বহু মেয়েকে হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং এর উপর তলায় রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। আর অবশিষ্ট মেয়ে ব্যারাকের ভিতরে যাদের জায়গা হলো না, তাদেরকে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। কয়েকটি মেয়ের হাতে বই ও খাতা দেখলাম। একটি মেয়ের হাতে পবিত্র কোরান শরীফ দেখলাম। একজনের হাতে গীটার দেখলাম। অনেক রূপসী যুবতীর দেহে অলঙ্কার দেখলাম। সে সব মেয়েদের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। মুখ ঢেকে তারা সব ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলো।

আমি প্রশ্ন করলাম: তাদেরকে যে জোর করে ধরে এনেছে, তার প্রমাণ কি ছিল? না কি দালালদের মাধ্যমে এনেছিল?

রাবেয়া খাতুন বললেন: এ সব মেয়েদের অধিকাংশকে পাক সেনারা ঢাকার রাস্তায় পলায়নরত পরিবারদের থেকে কেড়ে নেয়। বিহারীরাও অনেক অভিজাত বাঙালি পরিবারের বাড়ি থেকে সুন্দরী মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয়। এসব মেয়েদের অনেকের হাতে পায়ে লাঠির, বেতের ও বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন স্পট ছিল। অনেকের আঙ্গুল ফেটে, হাত ফেটে, দাঁত মুখ ও কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। তাদের অনেকে জোরে জোরে কলমা শরীফ পড়ছিল। কেউ কেউ দুহাত তুলে সারাক্ষণ মোনাজাত করছিল। আর কাঁদছিল। ২৬ মার্চ দুপুরের একটু পরেই আরম্ভ হয়ে গেল সেই মা বোনদের উপর পৈশাচিক ধর্ষণ। পুলিশ লাইন থেকে পাঞ্জাবী সেনারা কুকুরের মত জিভ চাটতে চাটতে ব্যারাকের মধ্যে উন্মত্ত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে একে একে বাইরে থেকে জিপে, ট্রাকে করে প্রবেশ করতে লাগলো। মানে ওদেরকে খবর দিয়ে তখন আনা হচ্ছিল। ওরা ব্যারাকে ব্যারাকে প্রবেশ করেই প্রতিটি যুবতী, মহিলা ও বালিকার পরণের কাপড় এক হ্যাচকা টানে খুলে একেবারে উলঙ্গ করে মাটিতে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে ধর্ষণে মেতে উঠতো। কে কার আগে ধর্ষণ করবে, তাই নিয়ে মেতে উঠলো পাক সেনারা। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সেই নিরীহ বালিকাদের উপর ধর্ষণে লেগে গেল।

আমি রাবেয়া খাতুনকে প্রশ্ন করলাম: আপনি এ সব কিভাবে দেখলেন? আপনি কি আদালতে ধর্ষণ ঘটনার সাক্ষী দিতে পারবেন?

আমার প্রশ্নের উত্তরে রাবেয়া বললেন: সাক্ষী দিতে পারবো। আমি নিজে পাক সেনাদের হাতে ধর্ষিতা। আমি অন্যান্য মেয়েদেরকেও জোর করে ধর্ষণ করতে দেখেছি। আমি ব্যারাকে ড্রেন পরিষ্কার করার অভিনয় করছিলাম আর ওদের বীভৎস পৈশাচিকতা দেখছিলাম। ওদের উন্মত্ত উল্লাসের সামনে সেই ৫০/৬০টি বন্দী বাঙালী সুন্দরী মেয়েদের কেউ টু শব্দটি পর্যন্তও করতে পারেনি। সারা ঢাকায় তখন কেয়ামত চলছে। ঢাকাবাসী সব পালাচ্ছে। তখন পুলিশ ব্যারাকে বন্দী হয়ে তারা আর কিছুই করতে পারছিলো না। শুধুই কাঁদছিলো। আর কলেমা শরীফ পড়ছিল । কলেমা শুনে জেনায় লিপ্ত অবস্থা থেকে উঠে, এক জেনাখোর রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক বোনকে গুলি করে মেরে ফেললো। তৎক্ষনাৎ আরেকজনের সাথে জেনা শুরু করলো। উম্মত্ত পাঞ্জাবী সেনারা এই নিরীহ বাঙ্গালী মেয়েদের শুধুমাত্র ধর্ষণ করেই ছেড়ে দেয়নি। আমি দেখলাম পাক সেনারা সেই মেয়েদের উপর পাগলের মত উঠে ধর্ষণ করছে আর দাঁত বের করে বুকের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। মেয়েরা আর্তনাদ করছে। ছটফট করছে। ওদের কামড়ে অনেক কচি মেয়ের স্তনসহ বুকের মাংস উঠে আসছিল। মেয়েদের গাল, পেট, ঘাড়, বুক, পিঠের ও কোমরের অংশ ওদের অবিরাম দংশনে রক্তাক্ত হয়ে গেল। যেসব যুবতী ওদের ধর্ষণের শিকার হতে অস্বীকার করলে দেখলাম তৎক্ষনাৎ পাঞ্জাবী সেনারা ওদের চুল ধরে মাটিতে ছুড়ে উলঙ্গ অবস্থায় ফেলে দিয়ে, ওদের যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারাল ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে সেই দেহ মুহূর্তের মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলছিলো। সেসব দৃশ্য চোখে দেখা যায়না। সহ্য করা যায় না। এখন মনে হয়, সেদিন তারা আমাকে মেরে ফেললে আমার কষ্ট থেকে আমি বাঁচতে পারতাম।

মানব ইতিহাসের বর্বরতম পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দানকালে সে দিনের প্রত্যক্ষদর্শী রাবেয়া খাতুনের গলা বার বার বন্ধ হয়ে এলো। চোখের পানিতে ২৭ মার্চে পাক সেনাদের নিষ্ঠুর পাশবিকতার শিকার সেই হতভাগ্য বোনদের জন্য তিনি ৭ বছর পরে ’৭৭ সালে কেঁদে বুক ভাসালেন। আমি তাকে বললাম: আরেক দিন আবার আসবো।

তিনি বললেন: আমি আরেকটি নিষ্ঠুর ঘটনা বলতে চাই এবং আল্লাহর কাছে এর বিচার চাই।। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে এই পুলিশ লাইনে অনেক পশু ছোট ছোট বালিকাদের উপর পাশবিক অত্যাচার শেষ করে তাদের অসাঢ় রক্তাক্ত দেহ বাইরে এনে দুজনে দু পা দুদিকে টেনে ধরে চড়চড়িয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলো। আমি দেখলাম সেখানে বসে বসে। আর ড্রেন পরিষ্কার করার ভান করছিলাম। পাঞ্জাবি কুকুরেরা মদ খেয়ে সব সময় সেখানকার যার যে মেয়ে ইচ্ছা তাকেই ধরে ৯ মাস ধরে ধর্ষণ করেছিল। সাধারণ পাঞ্জাবি সেনারাই শুধু এই বীভৎস পাশবিক অত্যাচার করেনি। তাদের সকল উচ্চ পদস্থ সামরিক অফিসাররাও মদ খেয়ে হিংস্র বাঘের মতো হয়ে দুই হাত বাঘের মতো নাচাতে নাচাতে সেই উলঙ্গ বালিকা, যুবতী ও বাঙালি মহিলাদের উপর সারাক্ষণ পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে গাড়ি করে চলে যেতো। এখানে বন্দী কোন মেয়ে, মহিলা বা যুবতীকে এক মুহূর্তের জন্য অবসর দেয়া হয়নি। এদের উপর্যুপরি ধর্ষণ ও অবিরাম অত্যাচারে বহু কচি বালিকা পুলিশ লাইনে বন্দী অবস্থায় রক্তাক্ত দেহে “ও আল্লাহ, ও আল্লাহ” বলে কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।”

আমি প্রশ্ন করলাম: পাক সেনারা ‘মহান আল্লাহ’র নাম শুনেও তাদেরকে কি রেহাই দিতো না? পাক সেনারা নিজেদের মুসলমান বলে কি দাবি করেনি?

রাবেয়া খাতুন: পাক সেনারা মুসলামান ছিল না। এরা ছিল জানোয়ার। এদের পাশবিক অত্যাচারে কেউ মারা গেলে তার লাশ পরের দিন অন্যান্য মেয়েদের সামনে ছুরি দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে বস্তার মধ্যে ভরে বাইরে ফেলে দেয়া হতো। এটা করার আগে বন্দী সকল মেয়েকে ডাকা হতো। তাদের সামনে মৃত মেয়েদের লাশ কুচি কুচি করে কাটা হতো। এ সকল মহিলা, বালিকা ও যুবতীদের নির্মম পরিণতি দেখে সেখানে অন্যান্য বন্দী মেয়েরা আরও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তে এবং তাদের কাছে মৃতের ন্যায় দেহদানে বাধ্য হতো।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙালী ললনাদের জীবনের রোজ কেয়ামতের বর্ণনা দিয়ে মিসেস রাবেয়া অশ্রু সজল চোখে বললেন: ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ মুক্ত করার পূর্ব পর্যন্ত পাঞ্জাবি খান সেনারা এখানে বন্দী সকল নিরীহ বাঙালি মহিলা, যুবতী, তরুণী ও বালিকাদের উপর এভাবে নির্মম ও পাশবিক অত্যাচার ও বীভৎসভাবে ধর্ষণ করে যাচ্ছিল। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় বোমাবর্ষণের সাথে সাথে পাঞ্জাবি সেনারা আমাদের চোখের সামনে এসব বন্দী সকল মেয়েকে নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে আর্মির ট্রাকে লাশ নিয়ে যায়। রাজারবাগ হেডকোয়ার্টার অফিসের উপর তলায়, সমস্ত কক্ষে, বারান্দায় এই ৫০/৬০ জন বন্দী নির্যাতিতা মহিলা, যুবতী, তরুণীর গণহত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ লাইনের ড্রেন দিয়ে বন্যার পানির মতো রক্ত বয়ে গিয়েছিল। বহু স্থানে তাজা রক্ত জমাট বেঁধেছিল।

রাবেয়া খাতুন বললেন: ১৬ই ডিসেম্বরে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী রাজধানীতে বীর বিক্রমে প্রবেশ করলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল পাঞ্জাবী সেনা আত্মসমর্পণ করে। মিত্রবাহিনীর সাথে তারা চলে যায়। আমাদের মা বোনদের ওপর ৯ মাস ধরে তারা যে ধর্ষণ করেছিল তার কোন বিচার হয়নি। গণ ধর্ষণের পর মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হবার পূর্বে তাদের পাপের সাক্ষী চিরকালের জন্য ঢেকে দেবার জন্য ৯ মাস ধরে ধর্ষিতা বোনগুলোকে এক সাথে যে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলে, তারও কোন বিচার হয়নি। বা তাদের কেন সাজা হয়নি।

আমি তাকে শেষ প্রশ্ন করলাম: বিদেশে আন্তর্জাতিক আদালতে বা দেশের আদালতে তাদের বিচার হলে তাদের বিরুদ্ধে আপনি সাক্ষী দেবেন?

রাবেয়া খাতুন: আমি দেশে, বিদেশে সব আদালতে সাক্ষী দেবো। রোজ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার সামনে সাক্ষী দেবো। আমি মরণের আগে আমার সাক্ষী দিয়ে যেতে চাই। আমি চোখে যা দেখেছি তা বলে যেতে চাই…..। বলতে বলতে তিনি আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলেন।

মুসা সাদিক: স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপনডেন্ট এবং সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts