যেভাবে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর

বিডি মেট্রোনিউজ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর প্রধান জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে (৭৩) ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

মঙ্গলবার রাত ১২টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত ফাঁসির মঞ্চে এ দণ্ড কার্যকর করা হয়। নিজামীর এই দণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে দেশে এই প্রথম কোনও রাজনৈতিক দলের প্রধানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো।

এর আগে এই কারাগারেই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে। এরপর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাতে দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ।

এরপর ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের করা রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ হয়। এরপর ২১ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দণ্ড কার্যকর হয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, নিজামী প্রাণভিক্ষা চাননি। এরপর আইন অনুযায়ী যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

এর আগে জামায়াতও বিবৃতি দিয়ে জানায়, দলের আমির নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। শুক্রবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে স্ত্রীসহ তার পরিবারের ১০ সদস্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

সর্বোচ্চ আদালতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজামীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ হয় গত বৃহস্পতিবার (৫ মে)। বিচারকদের সইয়ের পর ওই রায়ের প্রত্যায়িত কপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে সোমবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। পরে কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে আদেশ পড়ে শোনান। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়ে নিজামীর কাছে জানতে চাওয়া হয়। মঙ্গলবারও একাধিকবার কারা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা করা না করার বিষয়টি জানতে চাইলেও নিজামী তাতে সাড়া দেননি।

এরপরই জামায়াতের আমির নিজামীর দণ্ড কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু হয়। দণ্ড কার্যকরের নির্বাহী আদেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বাক্ষরের পর তা মঙ্গলবার রাতে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত নিজামীকে ফাঁসির রশিতে ঝুলতে হয়েছে মঙ্গলবার মধ্যরাতে। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মিত স্থায়ী ফাঁসির মঞ্চে দণ্ড কার্যকর করে তাকে ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানোর পর চিকিৎসক নিজামীর মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর ময়নাতদন্ত ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে পুুলিশি পাহারায় তার গ্রামের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়ায় পাঠানো হবে।

কারা কর্মকর্তারা জানায়, সন্ধ্যার পর থেকে একে একে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইকবাল হাসান, ঢাকার জেলা প্রশাসক মো. সালাউদ্দিন, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসি শেখ নাজমুল আলম, সিভিল সার্জন ডা. আবদুল মালেক মৃধা, কারা চিকিৎসক, দুই ম্যাজিস্ট্রেট এবং ইমাম মনির হোসেন।

কারা কর্তৃপক্ষের ফোন পেয়ে রাত ৮টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান নিজামীর স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ ২৬ স্বজন। এসময় তাদের অনেকে বিজয়সূচক ‘ভি চিহ্ন’ দেখান। ‘শেষ সাক্ষাৎ’ শেষে তারা রাত সাড়ে ৯টার দিকে বেরিয়ে আসেন। নিজামীর স্বজনরা কারা ফটকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে কারা ফটকে নিজামীর আইনজীবী প্যানেলের সদস্য মোস্তফা শাকের উল্লাহ বলেন, ‘দণ্ড কার্যকর ঘিরে নিজামীর পরিবারের সদস্যদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।’

এরপর রাত ১১টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রজনীগন্ধার ৭ নম্বর সেলে বন্দি নিজামীকে গোসল করানো হয়। এরপর তিনি নামাজ আদায় করেন। পৌনে ১২ দিকে কেন্দ্রীয় কারা মসজিদের ইমাম মনির হোসেন তাকে তওবা পড়ান। এরপর তাকে ফাঁসির মঞ্চে নেওয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবীর তার হাতে রাখা একটি সাদা রুমাল মাটিতে ফেললে প্রধান জল্লাদ তানভীর হাসান রাজু ফাঁসির মঞ্চের লিভার (লোহার তৈরি বিশেষ হাতল) টান দেন। এতে নিজামীর পায়ের নিচ থেকে কাঠের পাটাতন সরে ফাঁসি কার্যকর হয়। ২০ মিনিট ঝুলে থাকার পর তাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানো হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে একাধিকবার চিকিৎসক নিজামীর শারীরিক পরীক্ষা করেন।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts