৭০ সালের বন্যাকে জিনিউজ বলল ‘সাইক্লোন ভোলা’

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ১৯৭০ সাল। বাংলাদেশ তখনও বাংলাদেশ হয়নি। দেশটার নাম তখনও পূর্ব পাকিস্তান। নভেম্বর মাসের ৮ তারিখ। খবরে শোনা যাচ্ছিল বঙ্গোপসাগরের কেন্দ্রে তৈরি হচ্ছে এক প্রবল শক্তিশালী সাইক্লোন, ভোলা। দিন তিনেক পর সেই সাইক্লোন আছড়ে পড়ল বাংলাদেশে।

১৮৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে বইতে শুরু করে বাতাস। একসময় বাতাসের বেগ গিয়ে পৌঁছয় ২২২ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। তছনছ হয়ে যায় প্রায় গোটা দেশটাই। গঙ্গার জলে ঢেউ ওঠে ৩৩ ফুট লম্বা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থকে নদীর জল ৪ ফুট উঁচুতে উঠে আসে। বিমানবন্দরও চলে যায় জলের নীচে। মৃত্যু হয় ৫ লক্ষ মানুষের।

এই সাইক্লোনে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভোলা জেলার উপজেলা তজুমুদ্দিন। এখানকার প্রায় অর্ধেক জনবসতি গ্রাস করে নিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় ভোলা। এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশ্চিমবাংলাও।

ভোলা ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের এ পর্যন্ত ঘটা সবথেকে বড় বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ের কবল থেকে দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে লেগে গিয়েছিল প্রচুর সময়। এই ঝড় শুধু প্রকৃতিকে নয়, হেলিয়ে দিয়েছিল দেশের সরকারকেও। বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতাকে হাতিয়ার করেই বিপুল ভোটে জয় পেয়ছিল আওয়ামী লীগ।

বলা হয়, প্রকৃতি থেকে রাজনীতি সবকিছুকে ওলোট-পালোট করে দিয়েছিল যে ভোলা ঘূর্ণিঝড়, সেই ঝড়কেই বিশ্বের সবথেকে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় মানা হয়।

কেমন ছিল এই ঝড়ের ভয়াবহতা দেখুন নিচের ভিডিওতে :          (জিনিউজ ‍এর বাংলা ভার্সন ২১ মে ২০১৬)

 

অপরদিকে বাংলাদেশের জনপ্রিয় অনলাইন রাইজিংবিডিতে সাংবাদিক ও কলাম লেখক শাহ মতিন টিপু ‍এর বর্ণনা লেখেন ‍এভাবে :

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল। সেই স্মৃতি বয়ে আজও যারা বেঁচে রয়েছেন কিংবা স্বজনদের হারিয়েছেন, কেবল তারাই অনুভব করেন সেদিনের ভয়াবহতা। ধারণা করা হয়, সেই দুর্যোগে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এর মধ্যে ভোলা জেলাতেই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিরান হয় অসংখ্য জনপদ। সেদিন উত্তাল মেঘনা নদী আর তার শাখা-প্রশাখাগুলো রূপান্তরিত হয় লাশের নদীতে।

৭০ সালের ১১ নভেম্বর বুধবার থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে থাকে। পরদিন ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার আবহাওয়া আরো খারাপ হতে থাকে এবং মধ্যরাত থেকেই ফুঁসে উঠতে থাকে সমুদ্র। তীব্র বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে এল পাহাড়সমান উঁচু ঢেউ। ৩০-৪০ ফুট উঁচু সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে মানুষের ওপর। আর মুহূর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষ, গবাদিপশু, বাড়িঘর এবং খেতের সোনালি ফসল। পথে-প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে পড়ে ছিল কেবল লাশ আর লাশ। কত কুকুর, শিয়াল আর শকুন খেয়েছে সেই লাশ, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

সত্তরের সেই কালো রাতের কথা মনে হলে ধূসর স্মৃতিতে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে বলে স্মৃতি রোমন্থন করেন ভোলার দৈনিক বাংলার কণ্ঠ সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে পড়ে আছে মেঘনার পাড়ে। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদিপশু বঙ্গোপসাগরের উত্তাল পানিতে ভেসে গেছে। জনশূন্য হয়ে পড়েছিল দ্বীপ ভোলা।’

সেই সময়কার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভোলার সমস্ত জনপদ বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল আর নদীতে গবাদিপশুসহ বনি আদম সন্তান সারিবদ্ধভাবে পড়ে ছিল। তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকার ভোলা প্রতিনিধি ও বর্তমান দৈনিক বাংলার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক এম হাবিবুর রহমান প্রেরিত সচিত্র প্রতিবেদন ছিল ‘বাংলার মানুষ কাঁদো ॥ ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে মানুষের লাশ’। আর এ সংবাদ বিশ্ব জানতে পেরেছিল চার দিন পর। সেই চিত্রটি আজও ঢাকা প্রেস ইনস্টিটিউট-এ কালের সাক্ষী হিসেবে বাঁধানো রয়েছে।

সত্তরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধ্বংসযজ্ঞ ও বেদনাহতদের দেখতে যান, এসব দৃশ্য দেখে শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন।

বলা হয়, এটাই ছিল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস। সেদিন ভোলা ছাড়াও উপকূলীয় হাতিয়া, রামগতি, চর আবদুল্লাহ, সন্দ্বীপ, বরগুনা, পটুয়াখালী ও চট্টগ্রামে ছিল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের স্বাক্ষর।

 

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts