ফেরি করে তামাক বিক্রি বন্ধ ও লাইসেন্স পদ্ধতি প্রচলন হলে প্রায় ১৫ লক্ষ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে

অসিত রঞ্জন মজুমদার: খুচরা বিক্রি ও ফেরি করে তামাক বিক্রি বন্ধ ও তামাক বিক্রিতে লাইসেন্স প্রথা প্রচলনের প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (হকার) ইউনিয়ন। এ সকল ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ বলেন, ফেরি করে তামাক বিক্রি বন্ধ ও লাইসেন্স পদ্ধতি প্রচলন হলে প্রায় ১৫ লক্ষ হকার বেকার হবে। ফলে ১৫ লক্ষ হকারের সাথে জড়িত প্রায় ১ কোটি মানুষ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মূখিন হবে বলে মনে করছেন তারা।

শনিবার (১২ নভেম্বর) ঢাকায় এশিয়া হোটেলে জনঅধিকার ফাউন্ডেশনের আয়োজনে রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিভিন্ন হকার্স ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ ও জাতীয় পর্যায়ে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে “সংশোধিত প্রস্তাবিত খসড়া ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন : হকারদের ভাবনা” শীর্ষক এক মত বিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।

শ্রমিক নেতা ও হকার্স নেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মত বিনিময় সভায় জানান, আইনটি সংশোধনের খসড়ায় এমন কিছু প্রস্তাব আনা হয়েছে, যা কার্যকর হলে নিশ্চিতভাবে কর্মসংস্থান হারাবেন লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও ভাসমান বিক্রেতা। ফলে ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে দেশে ৫০০০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্ভবনা রয়েছে। বিভিন্ন সংশোধনী প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার কমানো হলেও প্রকৃতপক্ষে কিছু প্রস্তাব কার্যকর হলে এর ব্যবহার না কমে অসাধু ও অবৈধ তামাক ব্যবসায়ীদের আরো উৎসাহিত করবে বলে মতামত দেন।

তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমাতে প্রস্তাবিত সংশোধনীর খসড়ায় এমন কিছু ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে, যা এর মূল উদ্দেশ্য পূরণ না করে এ খাতে সংশ্লিষ্ট সাপ্লাই চেইন এর সাথে জড়িত সকল অংশিজন ও তাদের জীবিকার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে ভাসমান হকারের পরিবারসহ প্রায় ১ কোটি মানুষের অন্নের সংস্থানে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। অর্থাৎ প্রায় ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্ষুদ্র ও ভাসমান ব্যবসায়ীর কর্মসংস্থানে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

শ্রমিক নেতা বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি ও হকার্স সংগ্রাম পরিষদের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন বলেন, গত দুই বছর কোভিডের ধাক্কায় অনানুষ্ঠানিক খাতের অনেক শ্রমজীবী মানুষের আয় অনেকাংশ কমে গেছে। অনেকেই দীর্ঘ দিন ব্যবসা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল। করোনা সংক্রমন কমে আসায় তারা আবার ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চেষ্টা করছে। তখন এমন বাস্তবতা বিবর্জিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী কার্যকর হলে তারা আবার মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হবে।

অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা ও সংগঠন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অনেকেই মনে করেন তামাকের ব্যবহার কমাতে সরকারের উদ্দেশ্যের সঙ্গে একমত। কিন্তু অর্থনীতির এই কঠিন সময়ে রাজস্ব আয় এবং কর্মসংস্থানের বিনিময়ে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে নয় তারা। এর পরিবর্তে সচেতনতা বৃদ্ধির বিভিন্ন প্রচারণা হাতে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, সংশোধিত আইনের খসড়ায় মোবাইল বা ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের সিগারেট বা তামাকজাত পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রয়েছে। সরকারের Informal economy কে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যের নীতি পরিপন্থী, এই ধরণের পদক্ষেপ নিম্ন আয়ের খুচরা বিক্রেতাদের দৈনিক জীবিকার উপর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে (যেমন: বেকারত্ব, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি) এবং এর পাশাপাশি, আইনের অপপ্রয়োগ ও মাঠ পর্যায়ে হয়রানির সৃষ্টি করবে। খুচরা শলাকা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ দোকানি পুরো প্যাকেট সিগারেট বিক্রি করতে হবে। সিগারেট বিক্রেতাদের স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহনের কথা উল্লেখ রয়েছে। দেশের ৭০% খুচরা দোকানেই unstructured এবং হোল্ডিং নং ব্যাতিত, এই দোকানগুলো লাইসেন্স গ্রহণ করতে পারবে না এবং হয়রানির শিকার হবে। এছাড়া চায়ের দোকানকে পাবলিক প্লেস বা উন্মুক্ত স্থান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে সেখানে ধূমপান নিষিদ্ধ করার সুপারিশও রয়েছে। এসব প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয় এবং এর ফলে মূল উদ্দেশ্য অর্জিত না হয়ে বরং দেশের বেকারত্বসহ অর্থনীতির বর্তমান সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলবে।

হেল্থ রিপোটার্স ফোরামের সভাপতি ও সংবাদিক জনাব রাশেদ রাব্বী বলেন, বিদ্যমান আইন ১০০% বাস্তবায়ন না করে নতুন সংশোধনীর প্রস্তাবগুলো অযৌক্তিক। যে সকল স্টেকহোল্ডার প্রস্তাবিত খসড়া আইনের বিভিন্ন ধারার সাথে অর্থনৈতিকভাবে সরাসরি সম্পৃক্ত সে সকল (বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা) অংশীজন বা স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা না করে খসড়া তৈরি করা হয়েছে যে কারণে সকলের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে এবং এর ফলে আইন করলেও, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। বিদ্যমান আইন বাস্তবায়নে সরকার অধিক মনোযোগী হলে আইনে উদ্দেশ্য পূরণ অধিক সহজতর হবে।

উক্ত মত বিনিময় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন কোয়ালিশন ফর দি আরবান পুওর সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রেবেকা সানিয়াত, বাংলাদেশ ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সম্পাদক পুলক রঞ্জন ধর, বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার সমিতির সভাপতি কামাল সিদ্দিকী, বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার্স লীগের সভাপতি মো. হারুন-উর-রশিদ, দৈনিক উন্নয়ন বার্তার সম্পাদক শেখ মঞ্জুর বারী মঞ্জু, বাংলাদেশ ভ্রাম্যমাণ হকার্স পরিষদের সহ-সভাপতি কবির রেজা, হকার্স শ্রমিক পরিষদের নেতা রফিকুল ইসলাম বাবদ ও জাতীয় হকার্স ফেডারেশনের আরিফ চৌধুরী প্রমুখ।

Print Friendly

Related Posts