শাহ মতিন টিপু: বাংলাদেশকে ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতির ৫১তম বার্ষিকী আজ। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন প্রথম দেশ হিসেবে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
লোকসভার অধিবেশনে এদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা করেন। এই দিনটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে ভুটানও বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিলো।
সেদিন ভারতের লোকসভায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশাল বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধির বক্তব্য শেষ না হতেই ভারতের সংসদ সদস্যদের হর্ষধ্বনি আর ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ে।
যুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তখন বাংলাদেশের পাশে একমাত্র ভারত সরকারই পরম বন্ধুর মত এসে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষদের আশ্রয় দেবার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সহযোগিতা করেছে এবং পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যাতে মুক্ত করা যায় সে ব্যাপারেও দেশটির সরকার ছিলো তৎপর। সে কারণেই প্রবাসী সরকার ভারতের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী ছিলেন সবচেয়ে বেশি। এই স্বীকৃতি মুক্তিযুদ্ধে এনে দিয়েছিল বাড়তি প্রেরণা।
সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিত্ররাষ্ট্র ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ভারতের সৈন্যবাহিনীর জওয়ানরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার শত্রুদের নির্মূল করার জন্য আজ যুদ্ধ করে চলেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে পাকিস্তান। এইদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধকৌশল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকায় বলেন, ‘আমাদের বাহিনী বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান ধরে রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর বিস্তারিত নিবন্ধ প্রকাশ করে নিউজউইক। ওই নিবন্ধে বলা হয়, এই সংঘাত ঠেকাতে বৃহৎ্ শক্তিগুলো কোন তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ নিচ্ছে না। ৪০০ কোটি ডলার খরচ করে ওয়াশিংটন ইয়াহিয়াকে রক্ষার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
এদিকে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম নিউজউইক পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা যে স্বাধীন হচ্ছি তা দেখার দূরদৃষ্টি যদি ইয়াহিয়ার থাকে, তাহলে তার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা হতে হবে। সে জন্য প্রথমেই তাকে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে দিতে হবে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর এটা শান্তিপূর্ণভাবে করতে না চাইলে আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’
এদিন রাতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি ঝিনাইদহ অবস্থান থেকে সরে এসে তার বাহিনীকে ঢাকা রক্ষার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী ঢাকার পথে পেছনে এসে মেঘনার তীরে সৈন্য সমাবেশ করার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু তা আর তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ ততক্ষণে ঢাকা-যশোর সড়ক মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।