এটিই হবে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে শেষ বাজেট। আগামী অর্থবছরের বাজেট আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যস্ফীতি, ভর্তুকি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য বেশ বড় আকারের বাজেট দিতে যাচ্ছে, প্রাথমিকভাবে যার আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা।
গতকাল মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে আগামী বাজেটের খসড়া রূপরেখা অনুমোদন করা হয়।
কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের আরো কয়েকটি বৈঠকের পর আগামী জুন মাসের শুরুতে বাজেটের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। বৈঠকে অংশ নেওয়া দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী বাজেটটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এটি বর্তমান সরকারের নির্বাচনী বাজেট। আবার অর্থনীতির নেতিবাচক সূচকগুলো সামাল দিয়ে পুনরুদ্ধারের বাজেট হবে এটি। মূল্যস্ফীতি সামাল দিয়ে জনগণকে স্বস্তিতে রাখার সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে আগামী বাজেটে। ’
বাজেটের আকার বাড়বে ৯২ হাজার কোটি টাকা :
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটটিই হবে আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট। তবে বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেটটিকে ‘বিশেষ’ করার ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীকে চার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের জন্য চারটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতি, ভর্তুকি, রিজার্ভ সংকট এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখা। নির্বাচনী বাজেট হিসেবে মূল্যস্ফীতি ও ভর্তুকিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে আগামী বাজেটে। এর মধ্যে ভর্তুকি নিয়ে সরকার উভয়সংকটে আছে। একদিকে ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণপ্রাপ্তির শর্ত রয়েছে, অন্যদিকে ভর্তুকি কমালে জনগণের ওপর ব্যয়ের চাপ বাড়বে। পাশাপাশি বাড়বে মূল্যস্ফীতি।
তবে অবস্থা যা-ই থাক, আগামী বাজেট বড় করতে কোনো ধরনের কার্পণ্য করা হচ্ছে না। আগামী বাজেটের আকার প্রাথমিকভাবে সাত লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা প্রাক্কলন করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। বৈঠকে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ছয় লাখ ৫৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা করা হচ্ছে। সে হিসাবে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী বাজেটের আকার বাড়ছে ৯২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা।
মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ :
কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে আগামী বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মূল্যস্ফীতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ধরে রাখার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের মধ্যে চার মাসই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের বেশি ছিল।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৮৫ শতাংশে। অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৯১ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরে ছিল ৯.১০ শতাংশ। গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৫২ শতাংশ, যা ১১ বছর তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে মানুষকে গত বছরের তুলনায় চাল, ডাল, তেলসহ সব নিত্যপণ্যই কিনতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এর বিপরীতে মজুরি হার বাড়ছে সামান্যই। মূল্যস্ফীতির বিপরীতে সর্বশেষ নভেম্বরে মজুরি হার শতকরা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৯৮ শতাংশে, যা এর আগের মাসে ছিল ৬.৯১ শতাংশ। এর অর্থ, মজুরি বা বেতন বাড়লেও মূল্যস্ফীতি তা খেয়ে ফেলছে।
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা, ঘাটতি বাড়ছে :
মানুষের আয় কমে গেছে। ব্যবসায় মন্দা। অর্থনীতির সূচকগুলোও নেতিবাচক। এর পরও আগামী বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আরো বড় হচ্ছে। বৈঠকে আগামী বাজেটে মোট রাজস্বপ্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেওয়া আছে।
সরকারের রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগ আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে। আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে চার লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। চলতি বাজেটে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য পেয়েছে সংস্থাটি। সে হিসাবে আগামী বাজেটে লক্ষ্য বাড়বে ৭২ হাজার কোটি টাকা।
আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বড় পার্থক্য থাকায় নতুন বাজেটে সরকারকে আরো বেশি ধার করতে হবে। নতুন বাজেটে ঘাটতি প্রাথমিকভাবে দুই লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। চলতি বাজেটে ঘাটতি দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি বাড়ছে ১৯ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।
এডিপিতে থাকবে নির্বাচনের ছোঁয়া :
সংসদ নির্বাচনের আগে শেষ বাজেট, তাই আগামী অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে বলা হয়েছে, আগামী বাজেটে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। জনসম্পৃক্ত নতুন প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি থাকবে। এ জন্য নতুন বাজেটে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার এডিপির প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি বাজেটের এডিপির আকার দুই লাখ ৬৪ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।
জিডিপির উচ্চাশা বহাল :
অর্থনীতির খারাপ অবস্থার মধ্যেও জিডিপির উচ্চাশা থেকে সরে আসেনি সরকার। আগামী অর্থবছরে তাই জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরেও একই পরিমাণ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা রয়েছে।