৫৪ ও ১৬৭ ধারায় হাইকোর্টের নির্দেশনা‍ই বহাল

বিডিমেট্রোনিউজ ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা দেওয়া হবে জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় দেয়।

এর ফলে ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা নিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া নির্দেশনা বহাল এবং তা মানায় সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

আদালত বলেছে, “আপিল খারিজ করা হল। হাই কোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে ৫৪ ও ১৬৭ ধারার কিছু বিষয় সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ কারণে হাই কোর্ট কয়েক দফা সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে কিছু সংশোধনী থাকবে। আমরা একটি নীতিমালা ঠিক করে দেব।”

আদালত থেকে বেরিয়ে রিট আবেদনকারী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, “হাই কোর্টের নির্দেশনাগুলো বহাল থাকছে। তা মানায় এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হল। ১৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটল।”

রিট আবেদনকারী পক্ষের আরেক আইনজীবী ইদ্রিসুর রহমান বলেন, “অন্য একটি মামলায় আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৯ এবং ৪৩৯ (এ) ধারা পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে তা সংশোধনের পক্ষে রায় দিয়েছিল। কিন্তু ৩৩ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি বলে আপিল বিভাগ দুঃখ প্রকাশ করেছে।

“আজ এই মামলায় আপিল বিভাগ বলেছে, হাই কোর্টের সুপারিশগুলো কিছু সংশোধন করে একটি গাইডলাইন করে দেবে। গাইড লাইনে কী থাকবে তা পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে জানা যাবে।”

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, “মনে হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে আমরা একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করছি।”

রায়ের সময় রিট আবেদনকারী পক্ষে ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম এবং রাষ্ট্রপক্ষে আদালতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।

মামলার বিবরণে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করার পর ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ-কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়।

ওই ঘটনার পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে।

সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করে। তার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাই কোর্ট এ বিষয়ে কয়েকদফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়।

রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে প্রচলিত বিধি সংশোধন করার পাশাপাশি ওই ধারা সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয় সরকারকে।

রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলে ২০০৪ সালে তা মঞ্জুর হয়। তবে হাই কোর্টের নির্দেশনা সে সময় স্থগিত করা হয়নি।

এর ধারাবাহিকতায় গত ২২ মার্চ আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। দুই কার্যদিবস শুনানি করে গত ১৭ মে আদালত রায়ের জন্য ২৪ মে দিন ঠিক করে দেয়।

হাই কোর্টের নির্দেশনা

ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না।

খ. কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।

গ. গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে।

ঘ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে।

ঙ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।

চ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে কারাগারের ভেতরে কাচের তৈরি বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওই কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকট আত্মীয় থাকতে পারবেন।

ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে।

ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবে। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নেবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।

এসব নির্দেশনা ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল হাই কোর্টের সেই রায়ে।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts