মিরপুরের বিহারি ক্যাম্প ছবি: বিবিসি
শাহ মতিন টিপু
মুক্তিযুদ্ধে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করলেও রাজধানীর ঢাকার মিরপুর শত্রুমুক্ত হয়েছিলো আরও দেড়মাস পর। আর স্বাধীন দেশে মিরপুর মুক্ত হয়েছিলো অনেক রক্ত ও অনেক প্রাণের বিনিময়ে। মিরপুরে মুক্ত দিবস আজ।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুরকে মুক্ত করতে তুমুল যুদ্ধ হয় ও পরদিন ৩১ জানুয়ারি সকালে মিরপুর এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এ যুদ্ধে সেদিন শহীদ হয়েছিলেন জিয়াউল হক লোদী, লে. সেলিমসহ ৪১ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য, শতাধিক পুলিশ এবং মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু দিবসটি ২০০১ সালে জানুয়ারির ৩১ তারিখ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয়।
বিবিসিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী: ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের একেবারে শেষ দিকের ঘটনা এটি।বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী এবং একেএম শফিউল্লাহ একদিন দুপুরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যান।
সেখানে তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন অবস্থান করছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন মইনুল হোসেন চৌধুরী। তিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হিসেবে সামরিক বাহিনী থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী তার ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইতে তিনি বর্ণনা করেন, ‘ওসমানী আমাকে বলেন, বিহারী, রাজাকার ও তাদের সহযোগীদের গ্রেফতারের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী মিরপুর ১২ নং সেকশনে যাবে। পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগীদের একটা লিস্টও তারা তৈরি করেছে। তিনি পুলিশকে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেন। ’
জেনারেল ওসমানীর আদেশ পেয়ে, তৎকালীন ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের (পরে মেজর জেনারেল এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান) নেতৃত্বে সৈন্যদের মিরপুরে পাঠানো হয়।
ঢাকার বাসিন্দারা তখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হলেও শহরের উপকণ্ঠে মিরপুর তখনো ‘স্বাধীন’ হয়নি।বিষয়টি তখন এরকম ছিল যে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই সেটিকে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘এক টুকরো পাকিস্তান’ হিসেবে বর্ণনা করেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ৪৫ দিন পরে ঢাকার উপকণ্ঠে মিরপুর ‘শত্রু মুক্ত’ হয়েছিল তীব্র এক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে।
এই যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম একজন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) এইচ এম এ গাফফার এর বর্ণনায়:
২ নম্বর সেকশনে প্রবেশের সময় আমরা শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলাম। রাস্তার পাশে একটা পাকা একতলা বাড়ি থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো এলএমজির স্বয়ংক্রিয় গুলি আসছিলো। রাইফেল দিয়ে বাড়িটির জানালায় বহুক্ষণ ধরে গোলাগুলি করেও ওই গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে আমি ৭৫ মিলিমিটার রিকয়েললেস রাইফেল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সাপোর্ট কোম্পানি থেকে একটি রিকয়েললেস রাইফেল এসে ফায়ারে অবস্থান নিলো।
আমি মাইক লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে সতর্ক করে দিলাম, তারা গোলাগুলি বন্ধ করে আত্মসমর্পণ না করলে তাদের ধ্বংস করে দিতে বাধ্য হবো। প্রত্যত্তুরে ওই বাড়িতে থাকা বিহারিরা অশ্রাব্য ভাষায় আমাদের গালাগাল করতে লাগলো। এরপর জানালাটি লক্ষ্য করে রিকয়েললেস রাইফেলের গোলা দাগার সঙ্গে সঙ্গে সব গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেলো। আমি আমার একটি প্লাটুনকে ওই বাসায় তল্লাশি করতে পাঠালাম। তারা ফিরে এসে জানালো, ওখানে কয়েকজন আহত বিহারি ছাড়া আর কোনো সক্ষম শত্রু নেই। সেখানে বিহারিদের দুটি এলএমজি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো।
আহত বিহারিদের আমার ব্যাটালিয়নের এমআই রুমে চিকিৎসা দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশের হাতে সোপর্দ করলাম। এই ঘটনার পর ২ নম্বর সেকশনের দখল বিনা বাধায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের হাতে চলে এলো। বিহারিরা একটিবারের জন্যও আর আমার সৈন্যদের ওপরে গুলি করার সাহস দেখায়নি। এক সৈনিক কোথা থেকে আমার কাছে একটি কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে এলো। আমি হতবাক হয়ে দেখলাম, তাতে অনেকগুলো মানুষের চোখ জড়ো করে রাখা হয়েছে! গণহত্যার শিকার বাঙালিদের চোখ। আমার সৈন্যদের উত্তেজনা ফেটে পড়ার জোগাড় হলো। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের কিছুটা শান্ত করলাম।
আমি আমার একজন নায়েব সুবেদারের নেতৃত্বে ৪০ জন সদস্যের একটা টিম করে তাদের ওপরে সন্দেহভাজন বাঙালি হত্যাকারীদের শনাক্ত করার দায়িত্ব দিলাম; বাকি সেনাদের সরাসরি বিহারিদের ওপরে কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ দিলাম না। এভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করলাম।
‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ট্রুথ কমিশন ফর জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ’ এর আহবায়ক সাবেক সেনা কর্মকর্তা এম এ হাসান লেখেন:
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি পুরো বাংলাদেশে গণহত্যা সংক্রান্ত যে গবেষণা চালায় তাতে এটা প্রতীয়মান হয় যে, পুরো দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ছোটবড় বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে ৯২০টি বধ্যভূমিকে শনাক্ত করা গেছে পুরো দেশে। ঢাকায় শুধু মিরপুরেই বধ্যভূমির সংখ্যা ২৩টি।
লেখক: কবি, সাংবাদিক।