যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেয়ারবাজার বিশ্লেষক সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ভারতের আদানি গ্রুপের শেয়ারবাজার কারসাজি, অর্থপাচার আর কর ফাঁকি নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই গ্রুপটির শেয়ারে ব্যাপক দরপতন ঘটেছে। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (৩০ জানুয়ারি) পর্যন্ত আদানি গ্রুপ সব মিলিয়ে ছয় হাজার ৫০০ কোটি ডলার হারিয়েছে।
কারসাজি ও জালিয়াতির কারণে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও আদানি গ্রুপের সঙ্গে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে সতর্ক অবস্থানে থাকার জন্য বলেছেন।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কম্পানিটির প্রমোটর বা মালিকের কারসাজির ফলেই স্টকের দাম বাজারে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। আদানিরা অন্য লোকের ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচুর শেয়ার কিনে নিজের শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে, যা এককথায় বিনিয়োগকারীদের চোখে ধুলা দেওয়ারই নামান্তর। এ ধরনের জালিয়াতির তালিকায় নাম রয়েছে আদানির পাঁচ কম্পানির।
জানা গেছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানি গ্রুপ ১৬০০ মেগাওয়াটের দুই ইউনিটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। আগামী মার্চ থেকে এই কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনার জন্য স্বতন্ত্র সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ভোজ্য তেল খাতে আদানি গ্রুপের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড (রূপচাঁদা, ফরচুন, কিংস, মিজান ও ভিওলা), সিঙ্গাপুরের উইলমার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও আদানি গ্রুপ মিলে ‘আদানি উইলমার নামে’ এই যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম ‘সামনে আদানির সঙ্গে কোনো রকম চুক্তিতে গেলে সরকারকে আরো সতর্কতার সঙ্গে যেতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে চুক্তিটি সঠিকভাবে করতে হবে, যাতে আদানির কিছু হলেও বাংলাদেশ সুরক্ষিত থাকে।’
ম. তামিম বলেন, ‘যদি কোনো কম্পানিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, তাহলে চুক্তি না করাই ভালো। কম্পানির বিশ্বাসযোগ্যতা, কর্মক্ষমতা ও সামর্থ্য ঠিক থাকার পরও চুক্তি করার সময় আবার চুক্তির মাধ্যমে নিজ নিজ সুরক্ষা ও স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। বর্তমানে বিদেশি চুক্তির ক্ষেত্রে আমরা খুব দুর্বল।’ আদানি বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে কোনো রকম সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই বলেও তিনি জানান।
দরপতনে ছয় হাজার ৫০০ কোটি ডলার হারাল আদানি গ্রুপ : সোমবারও কম্পানিটির দরপতন হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত তিন কার্যদিবসে আদানি গ্রুপের বাজার মূলধন কমেছে ৬৫ বিলিয়ন বা ছয় হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে গত রবিবার হিন্ডেনবার্গের অভিযোগের জবাবও দিয়েছে আদানি। কিন্তু তা বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে পারেনি।
ভারতের শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার পর গতকাল আদানি ট্রান্সমিশন ও আদানি টোটাল গ্যাসের দর কমেছে ২০ শতাংশ, আদানি গ্রিন এনার্জির দাম কমেছে ১৬ শতাংশ আর আদানি পোর্ট ও স্পেশাল ইকোনমিক জোনের দর কমেছে ১.১ শতাংশ।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এক দশক ধরে আদানি গ্রুপ তার কম্পানিগুলোর শেয়ারের দর কৃত্রিমভাবে বাড়িয়েছে। গৌতম আদানির প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডলার সম্পদের ১০ হাজার কোটি ডলারই অর্জিত হয়েছে গত তিন বছরে স্টক জালিয়াতির মাধ্যমে, অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের অভিযোগ খণ্ডন করে আদানি গ্রুপ বলেছে, প্রতিবেদনটি ‘ভারতের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত আক্রমণ’। গ্রুপটির দাবি, তারা দেশের সব আইন মেনেছে এবং নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে প্রদেয় সব তথ্য প্রকাশ করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় হিন্ডেনবার্গ বলেছে, ‘আদানি আমাদের ৮৮টি প্রশ্নের মধ্যে ৬২টির সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে।’
সূত্র : কালের কণ্ঠ