দৈনিক দিনকাল, জাতিসংঘের উদ্বেগ ও বাস্তবতা

মো. সাখাওয়াত হোসেন

 

বাংলাদেশে দৈনিক দিনকাল বন্ধ হওয়ায় জাতিসংঘ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের এই অবস্থান তুলে ধরেন মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাঁর মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক। তবে দৈনিক দিনকাল বন্ধ হওয়ার পেছনের কারণগুলো সঠিকভাবে যাচাই বাছাই করে সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে মন্তব্য করা প্রয়োজন। না হয় ঢালাওভাবে একপেশে নেতিবাচক ইমেজ সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে এবং অন্যান্য মিডিয়াহাউসগুলো স্বাধীন সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে বাঁধাগ্রস্থ হয়।

সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই ঘটনার কার্যকারণ ও মূল্যায়ন সাপেক্ষে আলোচিত বিষয় নিয়ে মন্তব্য করে থাকেন। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ষড়যন্ত্রকারী রয়েছেন যারা বিভিন্ন সময়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী হিসেবে প্ররোচনা দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্টে ঐক্যবদ্ধ। দৈনিক দিনকালের বিষয়টি এমন কিনা তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

বিভিন্ন সোর্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক জানা যায়, দৈনিক দিনকাল পত্রিকাটি বিগত ১৬/০৪/২০০২ তারিখে ৭২/২০০২ নং নিবন্ধনমূলে ঘোষণাপত্র প্রাপ্ত হয়। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা এর স্মারক নং- ৬৫৭০ তারিখ ০১/১০/২০১৯ খ্রিঃ এর পত্রে উক্ত পত্রিকার প্রকাশক তারেক রহমান দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করায়, ফৌজদারী মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমতি ব্যতিত অফিসের ঠিকানা ও ছাপাখানা পরিবর্তন করায় পত্রিকাটি বাতিল করার জন্য জেলা প্রশাসক, ঢাকাকে অনুরোধ করে। পত্রের নির্দেশনার আলোকে জেলা প্রশাসক কর্তৃক স্মারক নং- ২৯০/২ তারিখ ০৭/১০/২০১৯ খ্রিঃ অনুযায়ী কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়। কিন্তু দৈনিক দিনকাল কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসক, ঢাকাকে উক্ত কারণ দর্শানোর নোটিশের কোন উপযুক্ত জবাব প্রদান করে নি। তথাপি পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। পরবর্তীতে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, ঢাকা এর স্মারক নং- ৬৮৬৮ তারিখ ১৪/১০/২০২১ খ্রিঃ অনুয়ায়ী উক্ত পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক ও ছাপাখানা পরিবর্তন বিষয়ে কোন প্রমাণ প্রকাশনা অধিদপ্তরকে অবহিত না করায় [দ্যা প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিক্লেয়ারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন)] অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য পুনরায় জেলা প্রশাসক, ঢাকাকে অনুরোধ করে। দৈনিক দিনকাল পত্রিকার প্রকাশক তারেক রহমান দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করায়, ফৌজদারী মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্র্তৃক অনুমতি ব্যতিত অফিসের ঠিকানা ও ছাপাখানা পরিবর্তন করায় দ্যা প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিক্লেয়ারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন)] অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর যথাক্রমে ১০, ১১, ১৬, ২০(১)(খ) ধারা লংঘন করায় ঘোষণাকৃত “দৈনিক দিনকাল” পত্রিকা প্রকাশক ও মূদ্রাকর তারেক রহমানের নামে বিগত ১৬/০৪/২০০২ তারিখে ৭২/২০০২ নং নিবন্ধনমূলে প্রদানকৃত পত্রিকাটির ঘোষণাপত্র (ফরম-বি) এবং পত্রিকা মূদ্রণের ঘোষণাপত্র জেলা প্রশাসক, ঢাকা বাতিল করে।

[দ্যা প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিক্লেয়ারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন)] অ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুযায়ী গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে দৈনিক দিনকাল কর্তৃপক্ষ প্রেস কাউন্সিল বোর্ড বরাবর আপীল করে। একইদিন প্রেস কাউন্সিল বোর্ড দিনকাল কর্তৃপক্ষের আপীলের শুনানির জন্য ১০ জানুয়ারী ২০২৩ তারিখ নির্ধারন করে জেলা প্রশাসককে নোটিশ প্রদান করে আপীলের জবাব দিতে বলে।

জেলা প্রশাসক কর্তৃপক্ষ গত ১০ জানুয়ারি ২০২৩ শুনানির দিন সেই জবাব প্রেস কাউন্সিলের বোর্ড বরাবর জমা দেয়। দিনকাল কর্তৃপক্ষ আপীলের জবাবের কপি একইদিন হাতে পায়। উক্ত জবাব এর প্রেক্ষিতে দৈনিক দিনকাল কর্তৃপক্ষ আপীলের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য প্রেস কাউন্সিলের বোর্ড বরাবর দুই মাস সময় আবেদন করে এবং সেটি মঞ্জুরও হয়। উল্লেখ্য যে, আপীল বোর্ড দিনকাল কর্তৃপক্ষকে স্পষ্টকরে জানিয়ে দেন যে, পরবর্তীতে আর কোন সময় বাড়ানো হবে না। আপীল বোর্ডে ছিলেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নিজামুল হক নাসিম এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী।

মহামান্য বিচারপতিগণ বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের নিকট ব্যাখ্যা জানতে চানঃ তারেক রহমান দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার কারণে দৈনিক দিনকাল পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে তার বৈধতা হারিয়েছেন। একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়ে কিভাবে তিনি প্রকাশক/ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করছেন? ঘোষণা পত্রে মুদ্রণ ঠিকানা পরিবর্তনের কোন আনুষ্ঠানিক তথ্য/আবেদনপত্র জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রেরণ করেননি।

বিবাদী পক্ষের আইনজীবীগণ তাদের যুক্তি-তর্কে তুলে ধরেন যে, তারেক রহমান ২০১৬ সালে ফরম-সি এ প্রকাশক পরিবর্তন করে অধ্যাপক মাজেদুল ইসলামকে প্রকাশক করে (পাওয়ার অফ এটর্নি) ক্ষমতা বলে বাংলাদেশ হাই কমিশন লন্ডন অফিসে আবেদন করেন। তার পরিপেক্ষিতে কোন অনুলিপি না পাওয়ার কারণে সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিকট দিতে ব্যর্থ হন। বাদী পক্ষের আইনজীবী যুক্তি তর্কে তুলে ধরেন যে, তারেক রহমান দীর্ঘদিন দেশে অনুপস্থিত থাকার কারণে দৈনিক দিনকাল পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে তার বৈধতা হারিয়েছেন। ঘোষণা পত্রে মুদ্রণ ঠিকানা পরিবর্তনের কোন আনুষ্ঠানিক তথ্য/আবেদনপত্র জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রেরণ করেননি বা নতুন করে কোন ঘোষণা পত্র প্রদান করেননি যা সম্পূর্ণভাবে আইন পরিপন্থী। তারেক রহমান দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়ে কিভাবে প্রকাশক/ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন?

রায়ে বিজ্ঞ আদালত বলেন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ দৈনিক দিনকাল পত্রিকার প্রকাশক তারেক রহমানের প্রকাশক ও মুদ্রাকর হিসেবে বৈধতা ফরম-বি বাতিল হওয়ায় তিনি ফরম-সি তে পদত্যাগ/ঘোষণাপত্র জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করেন এবং আহমদ আজম খানকে প্রকাশক ও মুদ্রাকর হিসেবে ফরম-বি তে স্বাক্ষর করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আবেদনপত্র দাখিল করেন। তারেক রহমানের প্রকাশক/মুদ্রাকর পদ থেকে পদত্যাগ করা এবং আহমদ আজম খানকে প্রকাশক ও মুদ্রাকর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার আপীলটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট জমা রয়েছে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত উক্ত বিষয় সম্পর্কে আইনগত ব্যবস্থা/ আদেশ দেয়ার অধিকারী, এজন্যে আদেশটি বর্তমান আপিলের উপর নির্ভরশীল নয়। বিষয়টি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের রায়ের উপর নির্ভরশীল।

বিজ্ঞ আদালত বলেন যে, তারেক রহমান দৈনিক দিনকাল পত্রিকার প্রকাশক ও মুদ্রাকর এর দায়িত্ব হস্তান্তর না করে দীর্ঘদিন যাবত বিদেশে অবস্থান করছেন এছাড়া তিনি ফৌজদারী সাজাপ্রাপ্ত আসামী এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে অত্র পত্রিকার ঠিকানা ও ছাপাখানা পরিবর্তন করেছেন, যা দ্যা প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিক্লেয়ারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর ১০, ১১, ১৬, ২০ (১)(খ) ধারার লংঘন।

দৈনিক দিনকাল কর্তৃপক্ষকে বিজ্ঞ আদালত জেলা প্রশাসকের সকল কার্যক্রম ও আইন মেনে পত্রিকাটির কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য মতামত দিয়েছেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়। কাজেই দৈনিক দিনকাল প্রশ্নে আইনগত বিধানের কোন ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে কিনা, থাকলে সেটি কিভাবে সেই বিষয়ে মতামত প্রদান করা যেতে পারে কিন্তু যেভাবে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে মর্মে বলা হচ্ছে সেটি কিন্তু প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে সাজুশ্যপূর্ণ নয়। আবার এমনো মনে হচ্ছে, প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে রাখতেই ঢালাওভাবে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলি হলুদ সাংবাদিকতার আশ্রয় নিয়েছে।

বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই কার্যত এই বিষয়টি তুলে ধরার জন্য পশ্চিমা কিছু মিডিয়া উঠেপড়ে লেগেছে। প্রকৃতঅর্থে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধের পেছনের কারণ ও ব্যাকগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলো তুলে ধরছে না। আল জাজিরা ও গার্ডিয়ানসহ বেশ কিছু পত্রিকা এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই বিষয়টিকে পাকাপোক্ত করার পায়তারা করছে। তবে ডিজিটাল যুগে সত্যকে গোপন করার তেমন সুযোগ নেই, সত্য প্রকাশিত হবেই এবং সেটি গণমাধ্যমের কল্যাণেই। গণমাধ্যম একটি রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে, গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি গণমাধ্যমের প্রতি কখনোই সরকার অযাথিত আচরণ প্রদর্শন করবে না। তবে পাশাপাশি গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষকে রাষ্ট্রীয় নিয়ম নীতি মেনেই প্রকাশনা চালিয়ে যেতে হবে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় কোন গনমাধ্যম যেন কোনভাবেই রোষানলে না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরী।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Print Friendly

Related Posts