২৬শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ছয় ঐতিহাসিক সাক্ষী ও দলিল

মুসা সাদিক

আজ থেকে ৫২ বছর আগে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসব্যাপী আমি রণাঙ্গনে ছিলাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের War correspondent হিসেবে বিভিন্ন রণাঙ্গনে আমি চরম ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বহু সংবাদ আন্তর্জাতিক শিরোনাম লাভ করে। সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন ছাড়া রণাঙ্গনে অনেক সামরিক গোপন সংকেত আমি বহন করি এবং দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের দখলকৃত এলাকার পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থান ও প্রতিরক্ষা ব্যুহ সম্পর্কে আমার অনেক সামরিক গোপন তথ্য রণাঙ্গনে সেনা নায়কদের রণ কৌশল নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিয়েছে। অধিকৃত এলাকায় ও রণাঙ্গনে আমি বহুবার জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েছি এবং নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে থেকে ফিরে এসেছি।

বিভিন্ন রণাঙ্গনে আমার অভিজ্ঞতা ও মুক্তাঞ্চল সফরের ওপর স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আমি “রণাঙ্গন ঘুরে এলাম” এবং “মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম” শিরোনামে দুটি নিয়মিত কথিকা মুসা সাদিক নামে স্বকন্ঠে প্রচার করতাম।

স্বাধীন বাংলা বেতারের “চরমপত্রের” পর আমার “রণাঙ্গন ঘুরে এলাম” বাংলাদেশের কোটি কোটি মুক্তি পাগল মানুষের হৃদয়ে সেদিন আশার আলো জ্বেলে দিয়েছিল। রণাঙ্গনে War correspondent এর পাশাপাশি আমাকে বহু সাময়িক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হত। জীবনবাজী রেখে প্রতিদিন, প্রতিরাত নিশ্চিত মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েও আমি দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বনে, জঙ্গলে, নদীতে, পাহাড়ে, খাল-বিলে, পথে-প্রান্তরে কখনো না খেয়ে না ঘুমিয়ে আমার দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করে গেছি।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বাংলা অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলাম। সেই সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইত্তেফাকের সংবাদ দাতা এবং চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদি প্রতিকার রিপোটারের চাকুরি করতাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক আবু জাফর আমার অগ্রজ এবং আরও দুই ছোট ভাইয়ের সাথে চট্টগ্রামে বসবাস করতাম। চট্টগ্রাম রেডিওর অনুষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তা বেলাল মোহাম্মদ এর সাথে নিয়মিত রেডিও প্রোগ্রাম করতাম।

২৫ মার্চ রাত ১২ টায় ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মেসেজ চট্টগ্রামে আজাদী পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের টেলিপ্রিন্টারে টেলেক্স যোগে আসে। সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনুপম সেন ও আমার অগ্রজ অধ্যাপক আবু জাফর আজাদী অফিসের সম্পাদকের কক্ষে ছিলেন। একই সময়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম নন্দন কানন অয়ারলেস অফিসে ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা বার্তা আসে। সেই সাথে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী অয়ারলেস অফিসের সুপার ভাইজার নুরুল আমিন ঢাকা থেকে প্রেরিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার টেলেক্স মেসেজ পান। ২৬ মার্চ এর প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম শহরব্যাপী মাইকিং শুরু হয়ে যায়। সাইক ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনা করে দিয়েছেন এবং সকলকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানানো হতে থাকে। আমি ও চাকসুর ভি পি ইবরাহিম ভোর ৫ টায় নন্দন কানন অয়ালেস অফিসে গেলাম। অয়ারলেস অপারেপটর মাহতাব উদ্দিন বললেন, “কথা বরতে পারছিনা ১ গ্লাস পানি পর্যন্ত খাবার ফুরসত নাই। সারা রাত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার মেসেজ সারাদেশব্যাপি প্রচার করে যাচ্ছি।

আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগ অফিসে আওয়ামী লীগের নেতা এম.এ হান্নানের নির্দেশে জনৈক হিন্দু ভদ্রলোক ইংরেজির অধ্যাপক (নাম স্মরণে না থাকায় দুঃখিত) বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার মেসেজ বঙ্গানুবাদ শুরু করে দিলেন। তার সাথে আমার ও ইব্রাহিমের কথা হলো। ভিতরের মধ্যে তিনি ডুবে ছিলেন। মুখ তুলতে পারছিলেন না। সেখান থেকে আমরা ভোর ৬ টায় আখতারুজ্জামান বাবু ভাইয়ের বাড়ী জুপিটর হাউজে গেলাম। সেখানে আমরা আওয়ামী লীগের সকল শীর্ষ নেতাকে পেলাম। যাঁদের মধ্যে ছিলেন জহুর আহম্মেদ চৌধুরী, এম.এ হান্নান, এম.এ মান্নান, এম আর সিদ্দিকি, শীর্ষ যুব নেতা আখতারুজ্জামান বাবু, এস.এম ইউসুফ, মেজর রফিক, এস.পি সামসুল হক সহ অন্যান্য সিভিল ও পুলিশ অফিসার ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁদেরকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

সেখানে থেকে চাকসুর ভি পি ইব্রাহিম, যুব লীগের নেতা এস.এম ইউসুফ এবং আমি জুপিটার হাউজ থেকে আখতারুজ্জামান বাবু ভাইয়ের দেয়া একটি জিপ গাড়ী পেয়ে আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশনে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম যে, রেডিওটা প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে বাঙ্গালী টেকনিশিয়ানরা কালুরঘাট সাব স্টেশনে চলে গেছে। আমরা সেখান থেকে জুপিটার হাউজে ফিরে আসলাম। ইতিমধ্যে কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার চালু হয়ে গেছে। ছাত্র নেতা আবুল কাশেম সন্দীপ এর কন্ঠস্বরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার অবিরাম প্রচার শুরু হয়ে গেছে। বাবু ভাইয়ের দেয়া জিপ গাড়ীতে আমরা ৩ জন সহ জহুর আহম্মদ চৌধুরীর এক ছেলে কালুরঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। দুপুর ১ টায় পৌঁছালাম। তখন বেতার বন্ধ ছিল। আমার বন্ধু সন্দীপকে সেখানে পেলাম। সেখানে আরও পেলাম কালুরঘাট বেতারের সংগ্রঠক বেলাল মোহাম্মদ, প্রধান প্রকৌশলী আবদুস শাকের, সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল করিম, টেকনিক্যাল এসিসটেন্ট রাশেদুল হাসান প্রমুখদের। সেখানে জানলাম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এম.এ হান্নান সকাল ১১ টায় কালুরঘাটে এসে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে গেছেন। তাঁর নির্দেশে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বিপ্লবী শব্দ বাদ দেয়া হয়। (সন্দীপ ছাত্র ইউনিয়ন করতো বলে সে বিপ্লবী শব্দ চালু করেছিল।)

কালুরঘাট বেতার চালু হওয়াতে সেখানে এলাকার বেশ কিছু লোক সমাগম হতে থাকে। বেতারের নিরাপত্তার জন্য মূল সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ ফটিকছড়িতে অবস্থিত ৮ম বেঙ্গলের সৈনিকদের সাথে দেখা করতে যাবেন বলে শুনলাম। ২৬ মার্চ দুপুর ৩টার দিকে আমরা কালুরঘাট থেকে চলে আসি। পরদিন ২৭ মার্চ সকাল ১১ টার দিকে চাকসুর ভি পি ইব্রাহিম, জি এস আব্দুর রব (শহিদ) ও আখতারুজ্জামান বাবু ভাই সহ আমরা কালুরঘাটে যাই। সেখানে অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন ও বেলাল মোহাম্মদ আমাদের জানান যে, স্বাধীন বাংলা বেতারের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ৮ম বেঙ্গলের ফোর্স মোতায়েন হবে। ফটিকছড়িতে আগের দিন বেলাল মোহাম্মদ এর সাথে ৮ম বেঙ্গলের কমান্ডার মেজর জিয়ার সাক্ষাত হয়েছে এবং তিনি বেতারের নিরাপত্তার জন্য ফোর্স পাঠাবেন বলেছেন। মেজর জিয়ার সাথে সাক্ষাতের সময় বেলাল মোহাম্মদের মনে উদয় হওয়ায় তিনি মেজর জিয়াকে হাসতে হাসতে বলেন -“দেখেন মেজর সাহেব, আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারে সবাই মাইনর। আপনি একমাত্র মেজর। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেশব্যাপি অয়ারলেস এর মাধ্যমে প্রচার চলছে। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকেও আমরা প্রচার করছি। আমাদের বেতার থেকে আপনি যদি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পুনঃপ্রচার করে দেন তা হলে, বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট ও দেশব্যাপি ইপিআর এর বিওপিতে অবস্থিত বাঙালী সৈনিকরা স্বাধীনতার পক্ষে ঝাপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তাঁর কথা মেনে নিয়ে মেজর জিয়া কালুরঘাট এসে ২৭ মার্চ শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গবন্ধুর নামে ও পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে দেন।

জহুর আহম্মেদ চৌধুরী, এম.এ হান্নান ও এডওয়ার্ড হীথ

বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রস্তুতি পর্ব বহুদিন ধরে বহু স্থান থেকে এবং বহু মাধ্যমে প্রচারের পদক্ষেপ সংগোপনে নিশ্চিত করে রাখেন। যাতে কোন একটি ঘোষণা ব্যর্থ হলে জাতি আরেকটি সোর্স থেকে তার স্বাধীনতা ঘোষণা পেয়ে যান। কিন্তু তিনি একজনের সাথে আরেকজনের সংযোগ রাখেননি বা পরিচিত হতে দেননি। যেমন- পিলখানা তদানিন্তন ইপিআর এর অয়ারলেস রুম ইনচার্জ সুবেদার মেজর শউকত আলীকে বঙ্গবন্ধুর তার স্বাধীনতার ঘোষণার মেসেজ দিয়ে রেখেছিলেন। ২৫শে মার্চ রাত ১২ টা ০১ মিনিটে তিনি অয়ারলেস অফিসে ঢুকে আল্লাহর নাম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার শুরু করেন। তিনি প্রায় ২০ মিনিট ধরে প্রচার করে দেবার পর পাক সেনাদের হাতে সেই রুমে ধরা পড়েন এবং নির্মম নির্যাতনে তাদের হাতে শহীদ হন।

তার স্ত্রী রাজশাহীর অধ্যাপিকা ফিরোজা বেগম আমাকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন- “বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার স্বামীর গোপন যোগাযোগ ছিল। কিন্তু কি ছিল তা আমি স্ত্রী হওয়া স্বত্বেও তিনি আমাকে বলেননি। কিন্তু মার্চ মাসের শুরুতে তিনি তার স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা সেলিনা পারভীন রিতাকে রাজশাহীতে তার বাবার বাড়ী পাঠিয়ে দেন।”

তার স্ত্রী আমাকে আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তিনি কিছু করলে তাঁর মৃত্যু সুনিশ্চিত তা তিনি জানতেন। আত্মদানে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আমার স্বামী ২৫শে মার্চ রাত ১২ টায় পিলখানার অয়ারলেস অফিস রুম থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা শুরু করেন।”

একইভাবে ঢাকা মগবাজার অয়ারলেস অফিসের ইউনিয়ন লিডারদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর একজন বিশ্বস্ত অনুসারি ছিলেন। যার কাছে তিনি তার স্বাধীনতার ঘোষণা মেসেজ দিয়ে রেখেছিলেন। ২৫ শে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমনে সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুর পূর্বের নির্দেশ অনুযায়ী অয়ারলেস অফিসে থেকে তাঁর উক্ত ইউনিয়ন লিডার বঙ্গবন্ধুর উক্ত স্বাধীনতার ঘোষণা সারাদেশে প্রচার শুরু করেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আর্থিক সহযোগিতা দানের জন্য চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতা এম.আর সিদ্দিকি আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন এবং ঘনিষ্ট ছিল। তাঁর বাটালি হিল এর বাসায় তার স্ত্রীর উপস্থিতিতে আমাকে দেয়া সাক্ষাতকরে বলেন, “২৫ শে মার্চ রাতে আমার আত্মীয় মোশাররফ এর ( এ কে খানের কন্যা জিন্নাত এর স্বামী) বাসায় ফোন করে চট্টগ্রামের সকল নেতাদের জন্য গোপন নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশে ছিল বঙ্গবন্ধু যে কোন মুহূর্তে একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা দিবেন। সে ঘোষণা অনুযায়ী চট্টগ্রামের নেতারা চট্টগ্রাম বিভাগকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন এবং তাদের সকল শক্তি একত্রিত করে কুমিল্লার প্রবেশ মুখ পর্যন্ত বন্ধ করে দিবেন। যাতে ঢাকা থেকে কোন ফোন চট্টগ্রাম অভিমুখে না যেতে পারে। আমার বাসার ফোন পাকিস্তানিদের নজরদারীতে থাকায় আমার ভায়রা ভাইয়ের ফোনে তিনি গোপন নির্দেশটি পাঠান। নির্দেশ পায়ার সাথে সাথে আমি সকল নেতাদের সাথে মিলিত হই এবং ইপিআর এর মেজর রফিক, বেঙ্গল রেজিমেন্টর মেজর জিয়া এবং পুলিশের এসপি সামসুল হক সাহেবদের সাথে মত বিনিময় করি। আওয়ামী লীগ সহ সংগঠনের সকল অঙ্গ সংগঠন তথ্য শ্রমিক লীগ যুবলীগ, ছাত্র লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, অবসরপ্রাপ্ত বাহিনী ২৫ শে মার্চ থেকে আমরা সংগঠিত করতে থাকি। সেই সাথে সীমান্ত থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহের চিন্তাও করা হয়। তার সকলে মিলে সকল শক্তি সম্মিলিত করে চট্টগ্রামকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন করে ফেলার কার্যক্রম গ্রহন করেন। সে সাথে চট্টগ্রাম পোর্ট এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে যাতে কোন সংযোগ গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগ্রাবাদ পর্যন্ত আমরা বিশাল বেরিকেড গড়ে তুলি।”

কিন্তু চট্টগ্রামের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে মূলত মেজর রফিকের ইপিআর এবং চট্ট্রগ্রাম পুলিশ বাহিনীর মিলিত ফোর্স এর সাথে মেজর জিয়ার ৮ বেঙ্গল মিলিত হয়ে সম্মিলিত ফোর্স গড়ে না তুলতে না পারার কারণে। মেজর রফিক তার ফোর্স এবং এসপি শামসুল হক (শহীদ) পুলিশ বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম দখলে রাখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কারণ মেজর জিয়ার নেতৃত্বে ৮ বেঙ্গল শহর ছেড়ে চলে যায়। আওয়ামী লীগের নেতা এম এ মান্নান আমাকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, “ মেজর জিয়া কথা দিয়েও কথা রাখেননি, তার ফোর্স নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদান করেননি”।

চট্টগ্রাম শহর পতল হলে আমার অগ্রজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু জাফর, অধ্যাপক অনুপম সেন, ডঃ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, উপাচার্য ডঃ এ আর মল্লিক সহ আমরা তিন ভাই আগরতলা হয়ে কলকাতায় চলে যাই। কলকাতা থেকে আমি ৯নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন শাহাজাহান এর অধীনে মে মাসে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সাথে সমুখ যুদ্ধে অংশগ্রহন করি।

৯ নম্বর সেক্টরে কালিন্দী নদীর যুদ্ধে আমার বীরত্ব গাঁথা মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমি রণাঙ্গনে আহত হলে পরবর্তীতে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অধীনে স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘ওয়ার করেসপনডেন্ট’ হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সাথে এক ফ্রন্ট থেকে অন্য ফ্রন্টে উল্কার বেগে চলাচল ছিল আমার। মিত্রবাহিনীর ইস্টার্ণ কমান্ডের হেড কোয়ার্টার উইলিয়াম ফোর্ট থেকে যখনই মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টার রণাঙ্গনের উদ্দেশ্যে উড়ে যেতো, তখন স্বাধীন বাংলা বেতারের সাংবাদিক হিসাবে আমাকে নেয়া হতো। ফলে রণাঙ্গনের দৈনন্দিন যুদ্ধের ফলাফল ও মুক্তিবাহিনীর বীরত্বগাঁথা স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচার করা আমার পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। জেনারেল অরোরার এডিসি ক্যাপ্টেন সুধ এবং জেনারেল জ্যাকবের কাছে সেজন্য গভীর কৃতজ্ঞতা ঋণ স্বীকার করছি।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের একটি সফল অপারেশন, একটি পাক সেনাদের টহল জীপ বা ট্রাক ধ্বংসের অথবা খান সেনাদের একটি লঞ্চের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি রকেট লাঞ্চারের শেল নিক্ষেপের সংবাদ না দিতে পারলে সে রাতে আমার ঘুম হারাম হয়ে যেতো। স্বাধীন বাংলা বেতারে বার্তা বিভাগের সম্পাদক জনাব কামাল লোহানী এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব আনোয়ারুল হক খান অপেক্ষা করে থাকতেন ফ্রন্ট থেকে আমার পাঠানো একটি সফল অপারেশনের খবরের জন্য। তাই যেখানে যুদ্ধ, যেখানে বারুদের গন্ধ, কামানের কান ফাটা শব্দ, সেখানে আমি উল্কার বেগে মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডো অপারেশনের সংবাদের জন্য ছুটে যেতাম।

’৭১-এর ৩ ডিসেম্বর শুক্রবার ৮ নম্বর সেক্টরের চাঁচড়ায় অকস্মাৎ আমার জীবনে মৃত্যুর ছায়া নেমে আসে। যখন আমার জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান ছিল ১ সুতার ব্যবধান মাত্র। যশোরের চাঁচড়ায় হানাদার এলাকায় সাংবাদিকতার ছদ্মাবরণে গোয়েন্দা কাজে লিপ্ত অবস্থায় পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়া মাত্র আমার ওপর তারা ক্ষিপ্ত হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমার বুকে, পেটে, মাথায় রাইফেলের বাট দিয়ে ও বুটের লাথি মেরে আমার মাথা, বুক, হাত-পা প্রায় ভেঙ্গে ফেলে আমাকে তারা প্রায় মেরেই ফেলে। শুধু মনে পড়ে আমার মাথায় রাইফেলের বাটের আঘাতে, আঘাতে আমার চোখের ওপর হঠাৎ হলুদ পর্দা ভেসে ওঠে… । এরপর আমার দেহ থেকে আমি আলাদা হয়ে যাই… । আমার সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। পরবর্তীতে সেখানে অকস্মাৎ মিত্রবাহিনীর আর্টিলারির শেলিং শুরু করলে পাক বাহিনী দ্রুত ভেগে যায় এবং যাবার কালে মৃতদেহের স্তুপের ওপর গুলি করতে করতে রিট্রিট করে যায়। চাঁচড়া মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে এলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা বীরবিক্রম (শহীদ) চাঁচড়ার মৃতদেহের মধ্য থেকে জীবন্মৃত অবস্থায় আমাকেসহ আরেকজনকে উদ্ধার করেন বলে আল্লাহর হুকুমে আমিসহ আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবার প্রাণ ফিরে পাই।

মুক্তিযুদ্ধের জন্য জীবন বিলিয়ে দেবার সেই পুণ্যময় দিনগুলোর ঘটনার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী প্রাতঃস্মরণীয় তাজউদ্দিন আহমেদ স্যার নিজের হাতে লিখে রেখে গেছেন, “মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে জনাব মুসার অপরিসীম অবদান এবং বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন হুদা যে ভাবে পাক সেনাদের গোলা বৃষ্টির মধ্যে নিজের জীবনের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে মুসার জীবন বাঁচিয়েছেন, সে জন্য তাঁদের উভয় জনের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করার জন্য এবং তাঁদের কাছে জাতির ঋণ স্বীকার করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সরকারের পক্ষে আমি এখানে স্বাক্ষর করলাম।” তারিখ ………………

আমি মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পর দেশবাসীর কাছে পরম গর্বের সাথে বলছি, সেখানে অথবা রণাঙ্গনে আমি একজনকেও দেখিনি নিজের জীবনের মায়া করতে। শত-সহস্র তরুণ-কিশোর-যুবক “জয় বাংলা”, “জয় বঙ্গবন্ধু”, “আল্লাহু আকবার” বলে হাতিয়ার ঘাড়ে গ্রেনেড হাতে বীরদর্পে ফ্রন্টের দিকে ছুটে গেছে। দেশ মাতৃকার তরে হাসি মুখে তাদের প্রিয় প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে গেছে। আমি দেখেছি বিভিন্ন রণাঙ্গনে রক্তজবা ফুলের মতো বীর তরুণ তাজা কিশোর-যুবক-মুক্তিযোদ্ধারা মাঠে-ময়দানে খালে-বিলে পড়ে আছে। পাক হানাদার বাহিনীর গোলায় ছিন্ন-ভিন্ন লাশ ছড়িয়ে আছে রণাঙ্গনের দিগন্ত দিগন্ত জুড়ে। সেসব লাশের পাশ দিয়ে বীরদর্পে ‘জয় বাংলা’, ‘আল্লাহু আকবার’ হায়দারী হাঁক দিয়ে ছুটে যাচ্ছে পঙ্গপালের মতো বাংলার দামাল ছেলেরা সম্মুখ পানে। ছুটে যাচ্ছে পাক হানাদারদের ট্রেঞ্চ, বাংকারের দিকে। ’৭১-এর রণাঙ্গনে কে, কার আগে শহীদ হবে বাংলা মায়ের বীর সন্তানেরা সেদিন তা দেখিয়ে দিয়ে ভারতীয় জেনারেলদের ও বিদেশী সাংবাদিকদের অবাক করে দিয়েছে। ফিল্ড মার্শাল জেনারেল মানেক শ ১৯৭১-এর ৭ই ডিসেম্বর আমাকে দেয়া বিরল এক সাক্ষাতকারে এভাবেই আমাদের তরুণ, কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদানের কথা উল্লেখ করেছেন।

৯ মাস ধরে রণাঙ্গনের বহু মর্মস্পর্শী ঘটনার মুখোমুখি আমি হয়েছি। আমি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে তার কিছু “রণাঙ্গন ঘুরে এলাম” ও “মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম” কথিকায় সপ্তাহে দুবার স্বকণ্ঠে তা প্রচার করেছি। আমার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তিনটি বই “মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম”, “Bangladesh Wins Freedom” এ তার কিছু প্রকাশ করেছি। ব্যতিক্রম শুধু খুলনার খালিশপুরের একটি গভীর বেদনাদীর্ণ একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা! খুলনার খালিশপুরের উক্ত মর্মস্পর্শী ঘটনার কথা আমি আমার বইতে লিখতে পারিনি বা কোন পত্র-পত্রিকায় লিখে আজও প্রকাশ করতে পারিনি।

খুলনায় পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, ঢাকায় জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকিস্তানী জেনারেলদের আত্মসমর্পণের একদিন পর। কারণ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা ও যশোরে অবস্থিত পাক সেনাবাহিনী যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে খুলনায় সমবেত হতে থাকে। এমনকি, যশোর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত পাক সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড প্রায় বিনাযুদ্ধে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে দিয়ে খুলনায় পৌঁছে তারা ৪/৫টি জেলার মোট প্রায় পঁচিশ হাজার ফোর্স খুলনার রূপসা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আমেরিকার সপ্তম নৌ-বহরের সাহায্যে পাকিস্তানে পালিয়ে যাবার গোপন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টের ডীভ কমান্ডার ১০৭ ব্রিগ্রেডের ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খান। ১৭ই ডিসেম্বর শুক্রবার খুলনার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমি তার সাক্ষাৎ গ্রহণ করি ও তার ব্যর্থতার কথা সে স্বীকার করে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীকে মোকাবেলার জন্য তাদের ৭/৮টি ট্যাঙ্ক বহরের দ্বারা যশোরের শিরমণিতে তারা দুর্ভেদ্য ডিফেন্স গড়ে তোলে। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় অবস্থিত পাক সেনাদের হেড কোয়ার্টারের পতন হয়ে গেলেও খুলনায় তারা একদিন বেশী প্রতিরোধ করে রাখতে সমর্থ হয়। ১৭ই ডিসেম্বর ভোরে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের নির্মম পরাজয় ঘটে ও খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা উইলিয়াম ফোর্ট থেকে আসা ব্রিগেডিয়ার দেলবার সিং-এর সাথে স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপনডেন্ট হিসেবে আমি উক্ত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান কভার করি। ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খান তার দলবল সহ ব্রিগেডিয়ার দেলবার সিং-এর কাছে আত্মসমর্পণ করে। উক্ত আত্মসমর্পণ শেষে আমাকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলে যে, খালিশপুর জুট মিলের পেছনে ২/১ দিন আগে বহু বাঙালি ভাই-বোনকে নিয়ে পাক সেনারা ও তাদের দেশীয় দালাল রাজাকার-আলবদররা হত্যা করে। শোনামাত্র একজনের মোটর সাইকেলে করে সেখানে আমি ছুটে যাই।

খালিশপুরে জুট মিল এলাকায় যখন পৌঁছে যাই, তখন সেখানকার নন-বাঙালিরা আমাকে সেদিকে যেতে বাধা দেয়। আমি তাদেরকে বলি যে, আমি বিবিসি’তে সংবাদ দেবো। সে কথা সত্য, কারণ আমার বহু সংবাদ বিবিসি’তে মার্ক টালীর মাধ্যমে ৯ মাস ধরে আমার বাই নেমে প্রচারিত হয়েছে। আমি বিবিসি’র কথা বলায় নন-বাঙালিরা আমাকে যেতে দেয়। সেখানে গিয়ে আমি এক জুট মিলের পেছনে খোলা মাঠে নারিকেল গাছের পাতা দিয়ে ঢাকা বহু বাঙালি ভাই-বোনের মৃতদেহ দেখি। ৯ মাস ধরে বহু রণাঙ্গনে এ ধরণের মৃতদেহ দেখতে দেখতে আমার মধ্যে কোন ভয়-ভীতির লেশ মাত্র তখন ছিল না। আমি মৃতদেহগুলো টপকে টপকে যাচ্ছি। প্রায় ১০/১১টি মৃতদেহ পার হয়ে যাবার পর হঠাৎ আমার বামদিকে চোখ থমকে গেল একজন কিশোরী নগ্ন বোনের ওপর। চোখ থমকে যাবার কারণ হলো, তার বুকের ওপর একটি বাঁশের লাঠি পোতা ছিল। যার মাথায় পাকিস্তানী পতাকা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং আরেকটি বাঁশের লাঠি আমার সেই মমতাময়ী বোনের নিম্নাংগে বাংলাদেশের পতাকা পোতা ছিল। আমাদের সেই শহীদ বোনের মমতাময়ী মুখের দিকে তাকালাম। তার বড় বড় মায়া ভরাত আঁখি দুটি আকাশের দিকে তাকানো ছিল। টুকটুকে ফর্সা আমাদের সেই বোনের মুখ সম্পূর্ণ নীল হয়ে ছিল। আকাশের দিকে তার বড় বড় আয়ত আঁখি দুটি মেলে ধরা ছিল। বঙ্গ-জননীর আদরের নিষ্পাপ সেই কিশোরীর আঁখি দুটি আকাশের দিকে মেলে ধরে আল্লাহকে কি বলছিল? আল্লাহর কাছে কি ফরিয়াদ করছিল? সেখানে দাঁড়িয়ে সে কথা মনে করে আমার চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়ছিল। সেখানে আমার মোটর সাইকেল চালকের ও আমার শার্ট খুলে আমরা আদরে, সম্মানে আমাদের বোনের নগ্ন শরীর ঢেকে দিয়ে আসি এবং পাকিস্তানের পতাকাসহ বাঁশের লাঠিটি তার বুক থেকে উপড়ে ফেলি। তার নিম্নাংগে শ্রোথিত আমাদের প্রাণ প্রিয় বাংলাদেশের পতাকা তুলে নিয়ে আমি ‘আল্লাহু আকবার’, ‘আল্লাহু আকবার’, ‘আল্লাহু আকবার’ তিনবার বলে এবং ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ তিনবার করে উচ্চারণ করে আমার মাথায় বাঁধি এমন অসীম মর্মস্পর্শী ও বেদনাদীর্ণ দৃশ্য আমি ৯ মাসের রণাঙ্গনে দ্বিতীয়টি আর দেখিনি।

এ ঘটনাটি আমি আজ পর্যন্ত কলম দিয়ে লিখতে পারিনি। লিখতে গেলে আমার হাত কাঁপে, বুক কাঁপে এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার বুক ভিজে যায়। আমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। আমার বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ে এবং আমার গলা জ্বালা করে ও দম বন্ধ হয়ে আসে।

পাকিস্তানী জল্লাদ জেনারেলরা, বিশেষ করে রক্তপিপাসু টিক্কা খান ঢাকায় ২৬শে মার্চ রাতে গণহত্যার ব্লু-প্রিন্ট কিভাবে তৈরী করেছিলেন এবং সেই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় কোন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তা জানার এক অপূর্ব সুযোগ আমার জীবনে আসে ১৯৮৮ সালে। আমি তখন রাষ্ট্রপতির ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারী হিসেবে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে একটি প্রেস টিম নিয়ে গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজী দৈনিক ‘দি ইনডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম এবং তদানীন্তন ঢাকা টিভি’র জনপ্রিয় ‘আইন-আদালত’ অনুষ্ঠানের পরিচালক এডভোকেট রেজাউর রহমান উক্ত প্রেস টিমের সদস্য ছিলেন। ইসলামাবাদে উক্ত সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মানব ইতিহাসের বর্বরতম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের জল্লাদ টিক্কা খানকে বিশিষ্ট আমন্ত্রিত অতিথিদের আসনে উপবিষ্ট দেখতে পাই। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় কিভাবে তিনি সেই নিষ্ঠুর গণহত্যা শুরু করেছিলেন সেই অজানা তথ্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে আমি তার সাক্ষাতকার নিতে এগিয়ে যাই। বাংলাদেশের গণহত্যার নায়ক জেনারেল টিক্কা খানকে চোখের সামনে দেখে অজান্তে চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। কণ্ঠস্বর বুঝে এলো। ২৬শে মার্চ ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর ঐ আইসম্যান কিভাবে গণহত্যা শুরু করেছিল ও ঢাকার বুকে রক্তের প্লাবন বইয়ে দিয়েছিল, তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলাম। সাপ্তাহিক “এখনই সময়” পত্রিকার সাংবাদিক এবং এডভোকেট রেজাউর রহমানকে সাথে নিয়ে টিক্কা খানের কাছে গেলাম।

পাঞ্জাবের গভর্ণর হাউসে (তিনি তখন পাঞ্জাবের গভর্ণর) দীর্ঘ দু’ঘন্টা ধরে আমাদেরকে দেয়া তার ইন্টারভিউ থেকে এখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে তার বক্তব্যের অংশ বিশেষ তুলে ধরছি মাত্র। আমি ইংরেজীতে প্রশ্ন করছিলাম এবং তিনি উর্দুতে ও ইংরেজীতে উত্তর দিচ্ছিলেন।”

জেনারেল টিক্কা বললেন, আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি থ্রি ব্যান্ড রেডিও এনে বললো স্যার শুনুন, শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা করছেন। আমি নিজে রেডিওতে শেখ সাহেবকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে শুনলাম, কারণ, শেখ সাহেবের কন্ঠস্বর আমি ভাল করেই চিনতাম। যে ঘোষণা তখন দেশদ্রোহিতার শামিল ছিল। সেক্ষেত্রে শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করা ছাড়া আমার কোন বিকল্প ছিল না।

টিক্কা বললেন, আমি ভাল করেই জানতাম শেখ মুজিবের মতো নেতা তার নিজের লোকদের ছেড়ে যাবে না কোথাও। আমি শেখ মুুজিবকে গ্রেফতার করার জন্য ঢাকার সমস্ত জায়গায় প্রতিটি বাড়ীঘরে এমনকি প্রতিটি কোণায় কোণায় তল্লাসি চালাতাম। তাজউদ্দিনের মতো অন্য কোন নেতাদের আমার গ্রেফতার করার ইচ্ছা ছিলো না। এজন্য তারা সবাই খুব সহজেই ঢাকার বাইরে চলে যেতে পেরেছিল।

টিক্কা খান দৃঢ় স্পষ্ট স্বরে ’৭১ এর ২৬শে মার্চ রাতের কথা বললেন যে, শেখ মুজিবকে সে রাতে না পাওয়া গেলে তিনি ও তার ফৌজ ঢাকার এবং বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কারবালার শোক বইয়ে দিতেন। শেখ মুজিবকে না পাওয়া গেলে হায়েনারা ২৬শে মার্চের রাতে ঢাকার কোন ঘর, এমনকি ক্ষুদ্র কোন কোণ তারা ছাড়তো না। বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাসে তারা ত্রিশ লাখ লোককে হত্যা করে, কিন্তু শেখ মুজিবকে ২৬শে মার্চ তাদের হাতের মুঠোয় না পেলে চেঙ্গিস খান-হালাকু খানের বংশধরেরা নয় মাসে নয়, শেখ মুজিবের জন্যে হন্যে হয়ে তা নয় দিনে কোটি লোক হালাক করে দিতো। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বুকে পানির ঢেউ থাকতো না, রক্তের ঢেউ জেগে উঠতো। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, বিশ্ববাসী সাক্ষী, সকল ঝড়-তুফান থেকে তিনি বাঙালি জাতিকে রক্ষা করেছেন। ২৬শে মার্চ তিনি গণহত্যাকারী টিক্কা খানের আক্রোশ ও ছোবল থেকে লাখ লাখ ঢাকাবাসী তথা দেশবাসীকে বাঁচানোর জন্য হিমালয়সম সাহস নিয়ে– ৩২ নম্বর বাড়ীতে অপেক্ষা করেছেন আত্মদানের জন্যে। কেউ জানতো না সে রাতে তাকে গ্রেফতার করা হবে, না হত্যা করা হবে?”

১৯৯৬ সালের জানুয়ারী মাসে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষ্যে আমি জেনেভায় যাই। সেখানে হোটেল ‘শেরাটন জেনেভায়’ এক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথকে পেয়ে বিনীতভাবে বললাম: একসেলেন্সি, ‘আমি বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা……..’, তিনি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘তোমাকে স্বাগত: জানাই’। আমিও বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের জন্য আমি বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক যুদ্ধ করেছি। আমি বাংলাদেশের শেখ মুজিবের বন্ধু এবং তিনি আমাদের শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ মহামানব।’

আমি বাংলাদেশের ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাঁর একটি ইন্টারভিউ চাইলাম। তাঁর ব্যস্ততার কথা বলে লন্ডনে আসতে বললেন। আমি রাজী হলাম। ৩রা এপ্রিল, বুধবার, ১৯৯৬ লন্ডন পৌছে স্যার এডওয়ার্ড হীথের অ্যরুনডেলস, ৫৯ ক্যাথেড্রেল ক্লজ, স্যালিসবারি বাসায় কল দিলাম। তাঁর সেক্রেটারী বললেন: “স্যার এডওয়ার্ড হীথ আপনার জন্য তাঁর প্যাডে একটি বিবৃতি লিখে স্বাক্ষর করে রেখে গেছেন। কিন্তু তিনি এখন লন্ডনের বাইরে। আপনি কোথায় আছেন বলুন, আমরা এটা আপনার কাছে আজই পৌঁছে দেব। বৃটিশ আভিজাত্যে ও সৌজন্যতায় মুগ্ধ হয়ে, আমি নিজেই সংগ্রহ করবো বলে জানালাম। তাঁর কাছ থেকে তাঁর বাসা ও অফিস অ্যরুনডেলস, ৫৯ ক্যাথেড্রেল ক্লজ, স্যালিসবারি গিয়ে ৪ঠা এপ্রিল বৃহস্পতিবার তাঁর সেক্রেটারীর থেকে জানলাম যে তিনি জরুরী কর্মসূচীতে ১ সপ্তাহের জন্য লন্ডনের বাইরে গেছেন। তবে, যাবার পূর্বে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মুসার কথা বিস্মৃতি হননি। স্যার এডওয়ার্ড হীথের প্যাডে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক ঘটনা বিষয়ে তাঁর স্বাক্ষরিত “একটি ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট” আমাকে দেবার জন্য রেখে গেছেন, এই কথা বলে তাঁর সেক্রেটারী সেই ডকুমেন্টটি আমার হাতে তুলে দিলেন।”

১৯৯৬ সালে প্রদত্ত সেই তিন প্যারার ১৯২ শব্দের ডকুমেন্ট-এর প্রথম বাক্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুদ্ধ ইতিহাস যথার্থই তুলে ধরে তিনি লিখেছেন: পঁচিশ বছর পূর্বে ১৯৭১ ২৬শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে æস্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র” হিসেবে ঘোষণা করেন।

স্যার এডওয়ার্ড হীথের আমি তাঁর একান্ত সচিবকে বলে তাঁর একদিন সাক্ষাতকার গ্রহনের সুযোগ পাই লন্ডনের স্যালিসবারির বাড়ীতে সাক্ষাতের প্রারম্ভে গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমি বললাম, “বাঙালি জাতি আপনাকে বাংলাদেশের একজন মহান বন্ধু বলে জানে। ’৭১-এ বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রতি আপনি ও আপনার নেতৃত্বে বৃটিশ সরকার যে সমর্থন ও সহযোগীতা দান করেছেন, সে কথা বাংলাদেশের প্রত্যেক নরনারী কৃতজ্ঞচিত্তে আজও স্মরণ করে। বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিতে পারা সত্ত্বেও আপনি ও আপনার সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রেরিত প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে লন্ডনে বাংলাদেশের অফিস খুলতে দিয়ে এবং লন্ডনে হেড অফিস করে সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের স্বপক্ষে রাজনৈতিক প্রচার-প্রচারণা চালাতে দিয়েছেন। আপনার কাছে বাংলাদেশের ঋণ চিরদিন তা প্রতিশোধ্য হয়ে রবে। সর্বশেষে তিনি অট্টহাসি দিয়ে আমার মন্তব্য উপভোগ করলেন, যখন বললাম যে, স্যার, ৭১-সালে লন্ডন ছিল বাংলাদেশের সেকেন্ড ক্যাপিটাল, দ্বিতীয় রাজধানী।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে বিশ্বের অন্যান্য জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের পরম্পরা উল্লেখ করে সেই সাক্ষাতকারে স্যার এডওয়ার্ড হীথ আমাকে বলেন, “বাংলাদেশ যে সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তার আগে পরে যুদ্ধ করে যে সব জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে, তারা অনুন্য ১৫ বছর থেকে ৩৫ বছর যুদ্ধ করে তা অর্জন করে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিব নিশ্চয়ই তাঁর দূরদৃষ্টি দ্বারা এই পরম্পরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন ও গুনে গুনে সেই মতো একের পরে আরেক করে, তার ঐতিহাসিক পদক্ষেপগুলি দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্ব মানব জাতির পরম সৌভাগ্য, অন্য কোন দেশে অতীতে কখনো যা সম্ভব হয়নি, সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে মাত্র ন’মাসের যুদ্ধে তোমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলে। এই পৃথিবীর যত বয়স হয়েছে, ততো বয়স পর্যন্ত এমন কোন নেতাকে কেউ দেখেনি বা এমন কোন নেতার নাম কেউ শোনেনি যে, তিনি ভিন্ন দেশে বা ভিন্ন কোন দ্বীপে বন্দী অবস্থায় তাঁর যাদুকরী বা অলৌকিক কোন ক্ষমতাবলে একটি দেশ স্বাধীন করেছেন বা একটি স্বাধীন জাতির জন্ম দিয়েছেন। যেটা তোমাদের ছোট্ট ভূ-খন্ডের কেরেশমেটিক নেম শেখ মুজিব করে গেছেন। বিশ্ববাসী ও বিশ্ব নেতৃত্ববৃন্দের চোখে তোমরা আজ বীরের জাতি ও “মার্শাল রেস”—এর গৌরবের ও সম্মানের অধিকারী। বৃটিশ সেনাবাহিনীও তোমাদেরকে যে মার্শাল রেস ‘বীরের জাতি’র সম্মানের চোখে দেখে, সে কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই।”

সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘকালীন ঘনিষ্ঠ ও পরীক্ষিত সহচর আলহাজ মোহাম্মদ গোলাম মোরশেদ এবং পিএসসির সাবেক পরিচালক জনাব তবিবুর রহমান। চল্লিশ দশকের তদানীন্তন ছাত্র ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যশোর জেলা শাখার আহ্বায়কও ছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে হাজী মোরশেদকে তিনি তাঁর অবৈতনিক সহকারী নিয়োগ করেছিলেন।১৯৯০ সালের দৈনিক দেশ (অধুনালুপ্ত) পত্রিকার স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় হাজী গোলাম মোরশেদ সাহেব এক স্মৃতিচারণ করে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর আলোকপাত করে বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের সময় ৩২ নম্বরের বাসভবনে বেগম মুজিব, রাসেল, গৃহ পরিচালিকা বুড়ি, কাজের ছেলে রহমান ও আমি ছিলাম। শেখ হাসিনা, জামাল ও রেহানাকে অন্য কোন বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাত সাড়ে দশটায় আমি ৩২নং বাসায় পৌঁছবার পর অনেকে টেলিফোনে আমাকে বলেছিল, বঙ্গবন্ধুকে পালিয়ে যেতে বলার জন্য। কেউ কেউ বাসায় এসেও তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোথাও যেতে সম্মত হননি।

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু রাজারবাগ ও যশোর পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র ডিষ্ট্রিবিউট করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ২৫ মার্চ রাতে বলধা গার্ডেন থেকে রেডিও প্রকৌশলী শহীদ নুরুল হক কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা অয়ারলেসযোগে মেসেজ প্রেরণ করেন বলেও জনাব মোরশেদ উল্লেখ করেন। একাত্তরের পঁচিশ মার্চ রাতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যার আগে তাঁর নির্দেশে আনসার বিভাগের ডিরেক্টর আওয়াল সাহেব ও আমি পুলিশের এসপি জনাব ই. এ. চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তাকে জানালাম, “রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র বণ্টন করে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু বলেছেন।” জনাব চৌধুরী পানি বসন্তে তখন আক্রান্ত ছিলেন। অতঃপর ই. এ. চৌধুরীর বাসা থেকে বেরিয়ে ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে রিপোর্ট করলাম। এ সময় যশোর পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র ডিস্ট্রিবিউট করে দেওয়ার জন্য আবার আমাকে বলা হলো। আমি নিজ বাসায় গিয়ে টেলিফোনে যশোরে মশিহুর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের কথা জানালাম। বাসা থেকে আবার ৩২ নম্বর অভিমুখে রওনা হয়ে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দেখলাম ব্যারিকেড। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে গ্রীনরোড হয়ে ধানমন্ডি অভিমুখে চললাম। কলাবাগান পৌঁছে দেখি রাশেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ব্যারিকেড। আমি কোনমতে ৩২নং পৌঁছে রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে ভেতরে ঢুকলাম। আমি বঙ্গবন্ধুর সামনে পৌঁছবার সাথে সাথে তিনি বললেন, “আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম। “They are comming to take me or kill me. I have decided to stay.”

তিনি বললেন, “জনাব তবিবুর রহমান (সাবেক পরিচালক, পিএসসি) এসে বঙ্গবন্ধুর দু পা জড়িয়ে ধরে অঝোর নয়নে কাঁদছিলেন আর বলেছিলেন, “আপনি চলে যান বঙ্গবন্ধু, নতুবা পাকিস্তানিরা আপনাকে মেরে ফেলবে।” বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন “If they don’t get me, they will massacre and destroy the city.”

হাজী মোরশেদ বলেন, “এভাবে নিজেকে মৃত্যুর মুখে সঁপে দেওয়া বড় মহাপুরুষের পক্ষে সম্ভব। আমাকে ঐ সব কথা বলার পর তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের সাথে বঙ্গবন্ধুর কিছুক্ষণ আলাপ হলো। রাত ১১টার দিকে বলধা গার্ডেন থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসার টেলিফোন ২৪২৫৬১ নম্বরে একটা টেলিফোন কল আসে। আমি ধরলে অপর প্রান্ত থেকে জানালো, “Radio messege প্রচার করা হয়ে গেছে। এখন মেশিন নিয়ে কি করব?” আমি দৌড়ে গিয়ে খবরটা জানাতে বঙ্গবন্ধু বললেন, “মেশিন ফেলে রেখে ওকে পালিয়ে যেতে বলো।”

মুসা সাদিক: স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট এবং সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।
Email: infomusabd@gmail.com, web: www.musabd.net

Print Friendly

Related Posts