বালাসী ঘাট: সবই আছে, তবুও সুনসান

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসী ঘাটে ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফেরিঘাট টার্মিনালে ভেড়েনা কোনও নৌযান। ফেরিঘাট টার্মিনালে দৃষ্টিনন্দন একাধিক ভবন, গাড়ি পার্কিং মাঠ, প্রশস্ত রাস্তা, নিরাপত্তায় গার্ডসহ প্রয়োজনীয় সবই আছে, তবুও সুনসান ঘাট।

অন্যদিকে, বালাসী ঘাট থেকে নদীর মাঝ দিয়ে হেঁটে প্রায় তিন কিলোমিটার বালু পথ অতিক্রম করার পর দেখা মেলে অস্থায়ী নৌকা ঘাটের। ফলে প্রতিদিন চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এই পথে চলাচলকারী শিশু-বৃদ্ধসহ শত শত মানুষ। যাদের নষ্ট হচ্ছে অর্থ ও গুরত্বপূর্ণ সময়।

স্থানীয়দের জীবনমানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, উত্তরাঞ্চলের সাথে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজকরণ ও বালাসী-বাহাদুরাবাদের দুইপাড়ে শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অবকাঠামো রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি এই পথে চলাচলকারী যাত্রীসহ এ অঞ্চলের সচেতন মহলের।

স্থানীয় সচেতন মহল বলছেন, ব্রহ্মপুত্রের বালাসী ঘাটের মূল পয়েন্টে নৌকা না পৌঁছার কারণে এই পথে যাতায়াতকারী মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বাণিজ্যিক মালমাল পরিবহণও। বন্ধ হয়ে গেছে ছোট-বড় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বেকার হয়েছে শত শত মানুষ। আর এতে করে বছরে প্রায় কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

সারা বছর লোক দেখানো ড্রেজিং করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ঘাট ও নদীর এই পথ সচল রাখতে কাজের কাজ কিছুই করছেননা তারা। ড্রেজিংয়ের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হচ্ছে। তাহলে এত টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফেরিঘাট টার্মিনাল-অবকাঠামোর ভবিষ্যৎ কি? তবে কি এভাবেই অবহেলায় পড়ে থেকে ধ্বংস হয়ে যাবে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব স্থাপনা!

সরেজমিনে বালাসী ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ফেরিঘাট টার্মিনালের বিশাল দুটি প্রবেশদ্বার। ভিতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন রাস্তা ও দৃষ্টিনন্দন একাধিক ভবন। সেখানে রয়েছে বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ। পুলিশ, আনসার ও নাবিকদের আলাদা আলাদা ব্যারাক। ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, বৈদ্যুতিক ও জেনারেটর সাব-স্টেশন, বিশ্রামাগার, মসজিদ, রেঁস্তোরা ও শৌচাগার। ভিতরে আরো সৌন্দর্য্য বর্ধণে করা হয়েছে রাস্তা সংলগ্ন ফুলের বাগান।

এসব দেখভালের জন্য সেখানে পোর্ট বিভাগে রয়েছে ট্রাফিক সুপার ভাইজার, টোল কালেক্টর, টার্মিনাল গার্ড ও টোল গার্ডসহ দশজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়া ড্রেজিং বিভাগে টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারসহ রয়েছে ১৫ জন।

এতোসব অবকাঠামো আর জনবল থাকার পরেও ফেরিঘাট টার্মিনালের বিশাল এলাকাজুড়ে ছিল সুনসান নিরবতা। এছাড়া টার্মিনালের বাহিরেও ছিল একই দৃশ্য। ঘাট না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দোকান। পেশা বদল করেছেন স্থানীয় অনেকেই। অথচ ঘাট সচল থাকলে সেখানে ছোট-বড় শত শত নৌকা, জেলে-মাঝি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্রেতা- বিক্রেতা, যাত্রী ও পর্যটকসহ হাজারো মানুষের হাক-ডাকে থাকে মুখরিত। এছাড়া দেখা যায়, মূল ঘাট থেকে নদী পার হতে ভাসমান নৌকা ঘাটে হেঁটে বালু পথে যাচ্ছে মানুষ। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল যাত্রীরা ঘোড়ার গাড়িতে গেলেও বেশিরভাগ মানুষ যান হেঁটে হেঁটে। এতে করে ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয় তাদের।

বিআইডাব্লিউটিএ সূত্র জানায়, বর্তমানে বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌপথে যাত্রীবাহী দুটি লঞ্চ ও দুটি নৌকা দিনে একবার করে আসা-যাওয়া করে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন ৬’শ থেকে ৭’শ যাত্রী যাতায়াত করলেও ঘাট দূরে যাওয়ার কারণে এখন প্রতিদিন মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ জন যাত্রী এই পথে আসা-যাওয়া করেন। এতে করে সরকার বছরে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

যাত্রী, স্থানীয় ও সচেতন মহলের অভিযােগ, বিআইডব্লিউটিএ সারা বছর ধরে নদী খননের কাজ করে থাকেন অথচ কাজের কাজ কিছুই হয়না। বছরের তিন থেকে চারমাস টানা-পোড়েনের মধ্য দিয়ে নৌকা চলাচল করলেও আট থেকে নয় মাস পানি শূন্য থাকে বালাসী ঘাট। ফলে নদীর সাথে সর্ম্পক করে গড়ে ওঠা মানুষগুলোর নানা পেশায় ভাটা পড়ে। বেকার হতে হয় শত শত মানুষকে। জেলে-মাঝি মাল্লারা জীবন বাঁচাতে বেঁচে নেয় ভিন্ন ভিন্ন পেশা, কেউ কেউ হন দেশান্তরী। অথচ এই ঘাট থেকে সারাবছর যদি বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌপথে নৌকাও চলাচল করে তবুও পাল্টে যাবে এই এলাকার মানুষের জীবনমান। শুরু হবে অর্থনীতির অগ্রগতি। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় আয়ে।

এমন ভাবনা থেকে উত্তারঞ্চলের রাজশাহী ও বৃহত্তর রংপুর বিভাগের সঙ্গে ঢাকা, সিলেট ও বৃহত্তরও ময়মনসিংহের মানুষের চলাচলের দূরত্ব কমানো এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর ঝুঁকি কমাতে গাইবান্ধার বালাসী ঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত ফেরি চলাচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রায় ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। পরবর্তীতে দুই দফা সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পটির সময় ২০২১ সালের জুন ও ব্যয় ১৪৫ কোটি ২ লাখ টাকায় বাড়িয়ে বালাসী ঘাট-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ কিলোমিটার নদী খনন এবং ঘাটের উভয় পার্শ্বে জমি অধিগ্রহণ, পার্কিং ইয়ার্ড, ফেরিঘাট, ইন্টারনাল রোড ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে এলে ওই পথ দিয়ে কয়েক দফায় পরীক্ষামূলকভাবে ফেরি চালানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর একই বছরের এপ্রিলে নৌরুটটির সমস্যা খুঁজে দেখতে বিআইডব্লিউটিএ একটি কমিটি গঠন করে। পরে কমিটির প্রতিবেদনে ‘ভৌত কাজের গুণগতমান ও কাজের তদারকির অভাব, নাব্যতা সংকট-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীণতাসহ নানা দিক তুলে ধরে এই পথে ফেরি চলাচলের অনুপযোগী বলে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ২০২১ সালের জুনে বৃহত্তরও এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও নদীর মরফোলজিক্যাল অবস্থা না জেনেই দুই পাড়ে ঘাট নির্মাণ করায় প্রতিবেদনে বালাসী ঘাট ও বাহাদুরাবাদের দুই প্রান্তের ফেরিঘাট অন্যত্র স্থানান্তর করতে বলা হয়। একই সাথে যেসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়ে গেছে, তা ভিন্ন কাজে ব্যবহারের সুপারিশও করে ওই কমিটি।

গাইবান্ধা সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক জহুরুল কাইয়ুম বলেন, ‘এই পথে ফেরি সার্ভিস চালু করতে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলো, তা অকেজো হয়েছে। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌ-পথে সেতু অথবা টানেল নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। এই পথে টানেল অথবা সেতু নির্মাণ করা হলে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের আট জেলার সাথে ঢাকার যোগাযোগে পণ্য পরিবহনে স্থানভেদে ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে গিয়ে সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচবে। এছাড়া এই এলাকার মানুষের জীবনমানে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতেও।’

 

Print Friendly

Related Posts