কদর বেড়েছে হাতপাখার

অদিত্য রাসেল: এক সপ্তাহ ধরে ভয়াবহ তাপদাহে সিরাজগঞ্জের জনজীবন বিপর্যস্ত। চলতি তাপদগ্ধ জীবনে খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। রাত-দিনের প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে পশু-পাখিও। গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে সিরাজগঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে এখন হাত পাখাই ভরসা।

একটু স্বস্তির আশায় ডাব, ঠান্ডা শরবত বা পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা করছে সাধারণ মানুষজন। গরম থেকে কিছুটা রেহাই পেতে কদর বেড়েছে, ডাব ও শরবতের পাশাপাশি, তালপাতা ও সুতার তৈরি হাতপাখার।

শনিবার (১৫ এপ্রিল) সকালে শহরের ব্যস্ততম বাজার স্টেশন এলাকায় মৌসুমী ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হাতপাখা কেনার দৃশ্য দেখা যায়। আগে যে হাতপাখা ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হতো বর্তমানে তা ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে পাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটছে গৃহবধূসহ কারিগরদের।

জানা যায়, গরম থেকে স্বস্তি পেতে হাতপাখা ছিল সবার ভরসা। বর্তমানে প্রতি বাসা-বাড়িতে রয়েছে বৈদ্যুতিক পাখা। কেউ কেউ ব্যবহার করছেন এসিও। প্রচণ্ড গরমে লোডশেডিং বেড়েছে। দিন-রাত মিলিয়ে সাত-আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। নিয়ম করে সন্ধ্যা হলে বিদ্যুৎ থাকছে না জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেশির ভাগ এলাকায়। একদিকে, প্রচণ্ড গরম অন্যদিকে, লোডশেডিংয়ের কারণে অনেকেই ফেরি করে হাতপাখা বিক্রি করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীত শেষ হতেই জেলার বিভিন্ন গ্রামের নিম্ন-আয়ের মানুষদের বাড়ির গৃহবধূরা পাখা তৈরি করে থাকে। গ্রামাঞ্চলে এই পাখার কদর বেশি থাকলেও শহরের অনেকেই এখনও এই পাখা কেনেন। গত ১ সপ্তাহের তীব্র গরমে
চাহিদা বেড়েছে হাতপাখার। হাতপাখা তৈরির মানুষগুলো ৪/৫ প্রকারের পাখা তৈরি করে থাকেন। তবে শহর অঞ্চলে নকশি করা পাখা বেশি বিক্রি হয়। সাধারণত এই পাখাগুলো অর্ডার নিয়ে ২শ থেকে ৫শ টাকাতে বিক্রি হয়। পাখাগুলোতে ফুল, ফলের দৃশ্যসহ বিভিন্ন প্রকৃতির অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয় সুই-সুতা দিয়ে।

পাখা তৈরিকারক গৃহবধূ মোছা. সোনেকা বেগম জানান, সংসারের কাজের ফাঁকে যে সময়টা পাওয়া যায়। বসে না থেকে সেই সময়ে পাখা তৈরি করি। একটা পাখা তৈরিতে ১৫/২০ টাকা মজুরি পাই। আর সুতায় কাজ করা তৈরি পাখার মজুরি দেওয়া হয় ২০/২৫ টাকা, আর বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা।

শহরের ব্যস্ততম বাজার স্টেশন এলাকায় মৌসুমী হাতপাখা ব্যবসায়ী আনোয়ার শেখ। জেলার শেষপ্রান্ত রায়গঞ্জে তার বাড়ি। তিনি ১০ বছর ধরে জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারসহ শহরের অনেক প্রান্তে পায়ে হেঁটে হেঁটে এই হাতপাখা বিক্রি করেন। সেই টাকায় চলে সংসার। তিনি বলেন, আমার মতো অনেকেই পাখা বিক্রি করে চালাচ্ছেন সংসার।

পাখা ব্যবসায়ী আনোয়ার জানান, গত ২ সপ্তাহ ধরে শহরে এসেছেন। এই সময়টায় তিনি তালের ও বাঁশবেতের হাত পাখা বিক্রি করছেন। নিজ এলাকা থেকে এই হাত পাখা সংগ্রহ করে বিক্রি করছেন প্রতি পিস ৪৫/৫০ টাকা ও জোড়া ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। অন্য সময়ের চেয়ে ১ সপ্তাহ ধরে পাখা বিক্রি হচ্ছে বেশি।

পাখা ক্রেতা রিকশাচালক শুকুর আলী (৫৬) বলেন, হাতপাখা সবসময় পাওয়া যায় না, তাই একটা কিনলাম। প্রচণ্ড গরমে রিকশা চালিয়ে হাঁপিয়ে যাই। কাজের পাশাপাশি শরীর ঠাণ্ডা করতে পাখাটি কিনলাম। এখন গরমে এই পাখাই ভরসা।

শহরের বাসিন্দা লাইব্রেরি ব্যবসায়ী রুবেল হোসেন বলেন, দুইটি তাল পাতার পাখা কিনলাম ১১০ টাকায়। পাখাটি হালকা ও সুন্দর। বিদ্যুৎ না থাকলে বাতাসও করা যাবে। এই গরমে বিদ্যুৎ বিভ্রাট তো লেগেই আছে। তাই পাখার কোনো বিকল্প
নাই। পাখার বাতাসও অনেক প্রশান্তি দেয়। কিন্তু আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, ইলেকট্রিক পাখার দাপটে এখন বাঁশবেতের তৈরি হরেক রকমের হাতপাখা বিলুপ্ত প্রায়।

পাখার পাইকারী ব্যবসায়ীরা জানান, গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাখাগুলো পাইকারি দরে শতকরা হিসেবে কিনে নেওয়া হয়। এই পাখাগুলো জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। বর্তমানে যে গরম চলছে এতে পাখা বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের সহকারী মহা ব্যবস্থাপক মো. রাশেদুল রহমান বলেন, হাতপাখা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের অংশ। এই কাজের সঙ্গে বেশির ভাগ নারী শ্রমিক জড়িত। বাংলার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আমরা সবসময় পাশে আছি। উদ্যোক্তারা যদি আমাদের কাছে আবেদন করেন, অবশ্যই তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে।

 

Print Friendly

Related Posts