দেশে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫৭ হাজার

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আট হাজার আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশের বিভিণ্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে।

২০০৩ সালে সারা দেশে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী ছিল ৩৮ হাজার ৪১২ জন। ২০১৩ সালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ২৮০।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ২০১৮ সালের পর থেকে আর্সেনিক রোগী শনাক্ত করা ও বিনা মূল্যে সেবা দেওয়ার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। সামনে এ প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ২০১৯ সালের গুচ্ছ জরিপের তথ্যানুযায়ী দেশের ১১.৮ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি রোগীপান করে। সেই হিসাবে প্রায় দুই কোটি মানুষ এই পানি পান করছে।

এই অবস্থার বিপরীতে একটি আশার তথ্যও আছে। দেশে গত ২০ বছরে ২১ শতাংশ নলকূপে আর্সেনিক কমেছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। অবশ্য গভীর নলকূপ বসানোর হার বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ইতিবাচক ফল এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ডিপিএইচইর আওতায় পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন প্রকল্পের পরিচালক বিধান চন্দ দে বলেন, ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৪ জেলার মোট ৭২ লাখ নলকূপে আর্সেনিক স্ক্রিনিং করা হয়। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ নলকূপে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। ২০০৩ সালে এই হার ছিল ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০ বছরে ২১ শতাংশ নলকূপে আর্সেনিক কমেছে।

দেশের নলকূপে আর্সেনিকের মানমাত্রা নিয়ে ডিপিএইচইর সমীক্ষার তথ্য বলছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে আর্সেনিকের হার সবচেয়ে বেশি। এখনো ২৫ শতাংশের বেশি আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও সাতক্ষীরা জেলার নলকূপগুলোতে।

বিধান চন্দ দে বলেন, দেশের মানুষ আগের চেয়ে অনেকটা সচেতন হয়েছে। তাই এখন অগভীর নলকূপের সংখ্যা কমছে। গভীর নলকূপ বসানোয় এলাকাভেদে কোথাও ৫৫০ ফুট, কোথাও ৭৫০ ফুট গভীর থেকে আর্সেনিকমুক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় আর্সেনিকের মাত্রা বেশি, সেসব এলাকার মানুষের উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মেটাবোলিক সিনড্রোম, বুদ্ধিবৈকল্য ও অ্যাজমার প্রবণতা বেশি।

দেশে ২৫ বছর ধরে আর্সেনিক বিষক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. খালেদ হোসেন। তিনি বলেন, আর্সেনিক বিষক্রিয়া বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি অন্যতম প্রধান হুমকি। উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক আছে এমন নলকূপ স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া জোরদার করলে গ্রামীণ জনপদের মানুষের খাওয়ার পানির খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না।

যশোরের শার্শা উপজেলার সামটা গ্রামের সাথী আক্তার (৩৫) বলেন, ‘শুরুতে হাতে-পায়ে ছোট ছোট গুটি দেখা দেয়। প্রথমে বুঝতে পারিনি, হঠাৎ করে তা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে যাই। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলেন, আর্সেনিকের কারণে এমন হয়েছে। কিছুদিন সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধ দিয়েছিল, এখন আর সেটিও পাই না।’

তিন বছর ধরে এই গৃহবধূ হাত-পায়ের ঘায়ে ভুগছেন। তাঁর পরিবারের আরো দুই সদস্যেরও একই অবস্থা। মা সকিনা বেগম এই রোগে ভুগছেন ৩০ বছর ধরে। তাঁর বুদ্ধিবৈকল্য দেখা দিয়েছে। সাথীর ভাই এই রোগে ভুগছেন ২৫ বছর ধরে। বাবা জহুর আলীও আর্সেনিকে আক্রান্ত ছিলেন। পরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের যশোর শাখা সূত্রে জানা যায়, যশোরে সাথীর মতো আর্সেনিকের ক্ষতিকর ক্রিয়ায় ভোগা রোগী তিন হাজার সাত শর মতো।

এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের যশোর শাখার ব্যবস্থাপক তরুণ কান্তি হোড় বলেন, নতুন করে এখন আর আর্সেনিক রোগী শনাক্ত করা হয় না। নলকূপগুলো পরীক্ষার কাজ বিনা মূল্যে করার ব্যবস্থা ছিল, এখন তা-ও বন্ধ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৬৩ সালে প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করে .০৫ মিলিগ্রাম। ১৯৯৩ সালে তা .০১ মিলিগ্রামে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু দেশে ১৯৬৩ সালের সেই মাত্রা আর পরিবর্তন করা হয়নি। সরকার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে .০৫ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে সেই পানি পান করা বা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

Print Friendly

Related Posts