পাঁচ দিনের পবিত্র হজের প্রধান আনুষ্ঠানিকতা আজ মঙ্গলবার। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে জীবনের সব গুনাহ মাফ করার আকুল আকাঙ্ক্ষায় ৪৬ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যেই আজ আরাফাতের ময়দানে সমবেত হবেন সারাবিশ্বের ২৫ লাখ মুসল্লি।
এদিন তালবিয়া তথা ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা, ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক’ (আমি উপস্থিত হয়েছি হে আল্লাহ, আমি উপস্থিত হয়েছি তোমার সমীপে, তোমার কোনো শরিক নেই, পুনরায় আমি উপস্থিত হয়েছি, নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও সকল নিয়ামত শুধু তোমারই জন্য, সব সাম্রাজ্যও তোমার এবং তোমার কোনো শরিক নেই) ধ্বনিতে গোটা আরাফাত ময়দান প্রকম্পিত হতে থাকবে।
আজ (সৌদি আরবে ৯ জিলহজ) মহান আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিতে আসা মুসলমানরা হজের দ্বিতীয় রুকন আদায়ের জন্য সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হবেন। সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিদায় হজের স্মৃতিবিজড়িত এই ময়দানের চারদিকে হলুদ বোর্ড দিয়ে চিহ্নিত এলাকার ভেতরে অবস্থান করবেন হাজিরা। এখানেই হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। তাঁরা প্রায় সার্বক্ষণিক জিকিরে মশগুল রয়েছেন। তালবিয়া পড়ছেন।
তিন দিক থেকে পাহাড় পরিবেষ্টিত ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে রয়েছে রহমতের পাহাড় (জাবালে রহমত)। এই পাহাড়টি দোয়া কবুলের স্থান। এ কারণে কোনো কোনো হজযাত্রী জাবালে রহমতে উঠেও ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। কোনো কোনো হজযাত্রী প্রায় দুই মাইল দৈর্ঘ্য এবং দুই মাইল প্রস্থের অর্থাৎ প্রায় চার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিরাট ও বিশাল আরাফাত ময়দানে যাঁর যাঁর মতো সুবিধাজনক জায়গা বেছে নিয়ে ইবাদত-বন্দেগি করবেন। এই ময়দানে একটি উঁচু পিলার রয়েছে। এই পিলারটিও দোয়া কবুলের স্থান। আদি পিতা প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা হাওয়া (আ.) আরাফাতের ময়দানে এসে পুনর্মিলনের সুযোগ পেয়েছিলেন। এ জন্য তাঁরা এই ময়দানেই মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।
হিজরি সন অনুয়ায়ী ১৪৩৪ বছর আগে (১০ম হিজরি) ঐতিহাসিক এই আরাফাত ময়দানেই বিদায় হজের খুতবা দিয়েছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী, বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সা.)। এ কারণে আরাফাত ময়দানে উপস্থিত না হলে হজের আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন পবিত্র হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে আসার পর যাঁরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, তাঁদেরও অ্যাম্বুলেন্সে আরাফাতের ময়দানে আনার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। কেউ কেউ হুইলচেয়ারে এই ময়দানে আসেন।
আরাফাত ময়দানের মসজিদে নামিরা থেকে জোহরের নামাজের আগে মিম্বরে দাঁড়িয়ে আরবি ভাষায় হজের খুতবা পাঠ করা হবে। এবার খুতবা দেবেন শায়খ ড. ইউসুফ বিন মোহাম্মদ। তিনি নামাজের ইমামতিও করবেন। হজের খুতবা বাংলাসহ প্রায় ১৪টি ভাষায় অনুবাদ করে শোনানোর প্রস্তুতি রয়েছে। হজযাত্রীরা হজের খুতবা শুনবেন। পবিত্র হজের খুতবার পর মসজিদে নামিরায় সমবেত মুসলমানরা এক আজান এবং দুই ইকামতে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে জামাতে আদায় করবেন। কারও অবস্থান মসজিদে নামিরা থেকে দূরে থাকলে তিনি নিজের তাঁবুতে আলাদাভাবে আদায় করবেন জোহর ও আসরের নামাজ। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের পর কিছু সময় পর্যন্ত হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানেই অবস্থান করবেন।
হাজিরা সূর্য অস্ত যাওয়ার কিছু সময় পর মাগরিবের নামাজ আদায় না করেই আরাফাত ময়দান থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা দেবেন। মুজদালিফায় গিয়ে এশার নামাজের সময় একসঙ্গে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায়ের পর তাঁরা সেখানেই বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে রাত যাপন করবেন। রাতে প্রতীকী শয়তানের উদ্দেশে নিক্ষেপের জন্য সেখান থেকে ৭০টি পাথর সংগ্রহ করবেন। সুবহে সাদিক পর্যন্ত মুজদালিফায় অবস্থান করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ।
হাজিরা আগামীকাল ১০ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায়ের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় অবশ্যই মুজদালিফায় অবস্থান করবেন। এর পর তাঁরা মুজদালিফা থেকে মিনায় যাবেন। সেখানে মিনার জামারায় (শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোড়ার স্থান) বড় শয়তানের উদ্দেশে প্রতীকী সাতটি পাথর নিক্ষেপ শেষে পশু কোরবানি এবং রাসুলুল্লাহর (সা.) আদর্শ অনুসরণে পুরুষরা মাথা মুণ্ডন করে গোসল করবেন। নারীরা চুলের অগ্রভাগ থেকে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ চুল কাটবেন। এর পর হাজিরা সেলাইবিহীন ইহরাম খুলবেন; পশু কোরবানি দেবেন। এর পর হাজিরা হজের তৃতীয় অর্থাৎ শেষ রুকন আদায়ের জন্য মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে সুবহে সাদিকের পর থেকে কাবা শরিফ তাওয়াফ করবেন।
কাবা শরিফের সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় সাতবার ‘সাঈ’ (দৌড়ানো) করবেন। সেখান থেকে তাঁরা আবার ফিরে যাবেন মিনায়, নিজেদের তাঁবুতে। হজযাত্রীরা ১১ জিলহজ আবার মিনার জামারায় গিয়ে জোহরের নামাজের পর থেকে পর্যায়ক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় শয়তানকে সাতটি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করবেন। একইভাবে ১২ জিলহজ আবারও ছোট, মধ্যম ও বড় শয়তানকে ২১টি পাথর নিক্ষেপের পর সন্ধ্যার আগে তাঁরা মিনা ত্যাগ করবেন। ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত যে কোনো সময়ে কাবা শরিফকে ফরজ তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা।