গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শ্রাবণী রায়ের কার্যালয়ে আব্দুল মোতালেব
শাহীন রহমান: জমি না পেয়ে দীর্ঘ দশ বছর ধরে শতবর্ষী মাকে ছেড়ে শ্বশুড়বাড়িতে বসবাস করছিলেন ছেলে। নিতেন না কোনো খোঁজখবর, দিতেন না ভরণপোষণ। বৃদ্ধা মা থাকতেন হতদরিদ্র নাতনীর কাছে৷ এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ছেলের ওপর চাপ বাড়ে প্রশাসনের।
সংবাদ প্রকাশের পর নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শ্রাবণী রায় ও পাবনার চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ মহলের হস্তক্ষেপে সব অভিমান ভুলে মা আমেনা বেগমের সঙ্গে দেখা করলেন কোটিপতি ছেলে আব্দুল মোতালেব। এ সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন চাটমোহরের ছাইকোলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান নুরু, সাংবাদিক পবিত্র তালুকদার সহ স্থানীয়রা।
পাবনার চাটমোহরে পলিথিনে ঘেরা নাতনীর ভাঙা ছাউনিতে থাকতেন মা আমেনা বেগম। ছেলে মোতালেন থাকেন নাটোরের গুরুদাসপুরে।
জানা যায়, গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শ্রাবণী রায় গত সোমবার (১০ জুলাই) দুপুরে আব্দুল মোতালেবকে তার অফিসে ডাকেন এবং চাটমোহর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ মহল তাকে ফোনে ধর্মীয় ও আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে তার মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। সেই সঙ্গে তাকে সতর্ক করেন। তার ফলশ্রুতিতে মঙ্গলবার (১১ জুলাই) স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান নুরুকে নিয়ে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করেন ছেলে মোতালেব। ছেলে মাকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। উপস্থিত অনেকের চোখে গড়িয়ে পড়ে আনন্দ অশ্রু।মায়ের ভরণপোষণের প্রতিশ্রুতি দেন ছেলে মোতালেব।
স্থানীয়রা জানান, আমেনা বেগমের বয়স ১১০ বছর। শতবর্ষী ওই বৃদ্ধার এক সময় ছিল সুখের সংসার। এক কন্যা সন্তান জন্মের পরই আমেনা বেগমের কোলজুড়ে আসে ছেলে সন্তান। ছেলের নাম রেখেছিলেন আব্দুল মোতালেব। মেয়ে মারা গেলে নাতনিকে কোলে পিঠে মানুষ করেন নানা-নানি। হতদরিদ্র নাতনিকে ১০ শতক জায়গা লিখে দেওয়ার অজুহাতে প্রায় ১০ বছর পূর্বে বাবা মাকে ফেলে ছেলে মোতালেব পাড়ি জমান নাটোরের গুরুদাসপুরে শ্বশুরবাড়িতে।
তবে নানি আমেনা বেগমকে ফেলতে পারেননি হতদরিদ্র নাতনি রমেছা খাতুন (৩৫)। নাতনির সংসার চলে না। শতবর্ষী আমেনা বেগমের দিনরাত কাটে ঘরের বাইরের পলিথিনে ঘেরা একটি ছাউনিতে। সেখানেই অতিকষ্টে চলছে তার জীবন। তাতেও ওই মায়ের কোনো কষ্ট নেই। কষ্ট একটাই সেটা হলো তার ছেলেকে এক নজর দেখার।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই বৃদ্ধার করুণ কাহিনী মানুষকে কাঁদালেও মন গলে না ছেলে আব্দুল মোতালেবের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাটমোহর উপজেলার চর এনায়েতপুর গ্রামের আমেনা বেগমের একমাত্র ছেলে পার্শ্ববর্তী গুরুদাসপুর পৌর সদরের চাচকৈড় বাজারে শ্বশুরবাড়ি এলাকায় বিশাল অট্টালিকায় বসবাস করেন। পেশায় ওষুধ ব্যবসায়ী। আব্দুল মোতালেব দীর্ঘ ১০ বছরেরও অধিক সময় তার মায়ের কোনো খোঁজ রাখেননি। এমনকি মায়ের মুখ পর্যন্ত দেখেননি।
বিষয়টি এলাকাবাসী ভালোভাবে নিতে পারেননি। ছেলে মোতালেবের এমন কর্মকাণ্ডের বিচার দাবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। ফেসবুকের সেই পোস্টগুলো মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। চারিদিকে বইতে থাকে নিন্দার ঝড়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী আমেনা বেগম। বিয়ে দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান মেয়ে হাজেরা খাতুন। তবে রেখে যান ছয় মাস বয়সি কন্যাসন্তান রমেছা খাতুনকে। নানা-নানির কাছেই বড় হতে থাকে নাতনি রমেছা খাতুন। রমেছা খাতুন বড় হওয়ার পর তার নামে নানা ওসমান মোল্লা ১০ শতক জায়গা রেজিস্ট্রি করে দেন। এতেই বিপত্তি বাঁধে। এই ১০ শতক জায়গা ভাগনিকে দেওয়ায় বাবার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ছেলে মোতালেব চাচকৈড় এলাকায় বিয়ে করে সেখানেই বসবাস শুরু করেন।
ওষুধের ব্যবসা করে এখন মোতালেব বিপুল সম্পদের মালিক। এর মধ্যে প্রায় ১০ বছর আগে মারা যান আমেনা বেগমের স্বামী ওসমান মোল্লা। বাবার জানাজা শেষ করে মাকে ফেলে রেখে নিজ আবাসস্থলে চলে যান আব্দুল মোতালেব। সেই যাওয়াই শেষ যাওয়া! একা হয়ে পড়েন আমেনা বেগম।
ছেলে ফেলে গেলেও ফেলতে পারেননি নাতনি রমেছা খাতুন। একই উপজেলার ছাইকোলা কানাইয়েরচর গ্রামে নাতনি রমেছা খাতুনের কাছে ঠাঁই হয় শতবর্ষী ওই বৃদ্ধা আমেনার।
ছাইকোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান নুরু বলেন, বৃদ্ধা ও তার ছেলেকে মিল করে দিতে পেরে ভালো লাগছে। বৃদ্ধ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হলো ছেলে।
এ ব্যাপারে রমেছা খাতুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমি যতদিন বেঁচে আছি নানির পাশে থাকব ইনশাআল্লাহ। নানা আমার নামে ১০ শতক জমি লিখে দিয়েছিলেন কিন্তু সেই জমি তো আমার মামা (মোতালেব) দখল দেননি। কিন্তু তাই বলে, মায়ের মুখ দেখতে আসবে না? অবশেষে মামা এসেছে তাতে তিনি খুব খুশি। নানার দেওয়া ১০ শতক জমি মামাকে ফেরত দিতে চান তিনি।
এ ব্যাপারে আব্দুল মোতালেব বলেন, আমার অন্যায় হয়েছে। এখন থেকে মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি বহন করবো। আশা করি মা আমাকে ক্ষমা করবেন। সেই সাথে ভাগনি রমেছাকেও ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা জানাই এতদিন ধরে কষ্ট করে আমার মাকে দেখে রাখার জন্য।