আ হ জুবেদ, কুয়েত: কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতে বিভিন্ন পেশার ভিসা পাওয়া যাচ্ছে বলে একটি সংঘবদ্ধ চক্র বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচার চালাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। ওই চক্রটি ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ ও কম মূল্য দেখিয়ে সহজ সরল প্রবাসীদের আকৃষ্ট করে প্রতারিত করছে।
অনেক প্রবাসী ফেসবুক ও ইউটিউবে নতুন ভিসা সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেখে ‘হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমু’র মাধ্যমে এসব ভিসা চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সরাসরি সাক্ষাৎ বিহীন কথোপকথন চলতে থাকে উভয়ের। ভিসা দাতা চক্র তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য নিখুঁত কিছু কাজও করে দেখান। যেমন- আরবি ভাষায় কফিল বা নিয়োগকারী ব্যক্তির ভয়েস মেসেজ, ভিসা দাতার পাসপোর্ট কপি, সিভিল আইডি কপিসহ ইত্যাদি নথিপত্র হোয়াটসঅ্যাপে প্রেরণের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ান।
সম্প্রতি অনেক কুয়েত প্রবাসীদের কাছ থেকেই এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কুয়েত প্রবাসী সুজন সাজ্জাল, কুয়েতের জাবরিয়া এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। তিনি জানান, Kuwait to bangladesh নামে ফেসবুকের একটি গ্রুপে বিজ্ঞপ্তি দেখেন কুয়েত প্রবাসী বাংলাদেশী জাহাঙ্গীর নামের এক ব্যক্তির। ওই গ্রুপে এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন ভিসা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। আর তখন থেকে তিনি ‘হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমু’র মাধ্যমে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। জাহাঙ্গীর নতুন ভিসা পেতে প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলে সাজ্জাল এর কাছ থেকে পাসপোর্ট এর ফটোকপি চেয়ে নেন। আর সাজ্জাল যাকে কুয়েতে নিয়ে আসতে চান ওই ব্যক্তির পাসপোর্ট এর কপি পাঠিয়ে দেন জাহাঙ্গীরের হোয়াটসঅ্যাপে। কিছুদিন অপেক্ষার পর জাহাঙ্গীর নতুন একটি ভিসার ছবি পাঠিয়ে সাজ্জালের কাছে এক হাজার কুয়েতি দিনার দাবি করেন।
জাহাঙ্গীরের কথা অনুযায়ী সাজ্জাল বাংলাদেশের কয়েকটি বিকাশ নম্বরে এক হাজার কুয়েতি দিনার সমপরিমাণ বাংলাদেশী টাকা পাঠান।
সাজ্জাল জানান, তিনি স্থানীয় ‘কুয়েত প্রবাসী সাপোর্ট টিম’ এর এডমিন এর সহযোগিতা নিয়ে ভিসা যাচাই করে দেখেন ওই ভিসাটি জাল। পরবর্তীতে কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে এ বিষয়টি জানানো হলে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
সাঈদ খান নামে আরেকজন প্রবাসী বাংলাদেশী জানান, জাহাঙ্গীর ভিসা দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে এক হাজার কুয়েতি দিনার নিয়েছে।
প্রতারণার শিকার এই দুই প্রবাসীসহ আরো অনেক প্রতারিত প্রবাসীই জাহাঙ্গীরকে কখনো সরাসরি দেখেননি, কথাও বলেননি। ভিসা সংক্রান্ত ব্যাপারে শুধুমাত্র ‘হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমু’র মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদে পা দেন।
প্রশ্ন উঠেছে, কে এই জাহাঙ্গীর আলম? কোথা থেকে জাহাঙ্গীর অনলাইনে এই ভিসা প্রতারণা করছেন?
প্রবাসী সংবাদকর্মী মহসিন পারভেজ প্রতারণার শিকার হওয়া প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে জাহাঙ্গীরের দেওয়া তার নিজ পাসপোর্ট ও সিভিল আইডি কপি নেন এবং খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। জাহাঙ্গীর নামের লোকটির সন্ধান পান। দেখা গেলো এখানেও আরেক প্রতারণা। এই জাহাঙ্গীরের পাসপোর্ট কপি ও সিভিল আইডি কপি ব্যবহার করে আরেক ছদ্মবেশী এই ভিসা জালিয়াতি চালিয়ে যাচ্ছে।
আসল জাহাঙ্গীর জানান, প্রায় দুই বছর আগে গৃহকর্মীর ভিসায় কুয়েতে আসেন তিনি। স্থানীয় নাগরিক কফিল দেড় বছর পর তাকে আকামা পরিবর্তন করে অন্যত্র কাজ খুঁজে নিতে বলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তিনি কোথাও কাজ পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন- তাকে যেনো কেউ একটি কাজের সন্ধান দেন। এ সময় মনির নামের একজন কুয়েত প্রবাসী হোয়াটসঅ্যাপে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান যে, তার কাছে কাজের সন্ধান আছে। জাহাঙ্গীর অনেক আনন্দিত হয়ে ওই মনিরকে বলেন আকামা পরিবর্তন করতে হলে তাকে কী করতে হবে। মনির জানিয়ে দেন অবশ্যই তাকে বৈধ পাসপোর্ট ও সিভিল আইডির কপি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে হবে। জাহাঙ্গীর তাই করলেন, পাসপোর্ট ও সিভিল আইডির কপি পাঠিয়ে দেন। তারপর, জাহাঙ্গীর আলম কথিত মনিরকে অনেকবার ফোন দেন, আকামা পরিবর্তন বা কাজ সম্পর্কে জানতে চান, কিন্তু মনির কোনো উত্তর দেননি।
এদিকে একসময় এই মনিরই ‘ছদ্মবেশী জাহাঙ্গীর’ হয়ে অনলাইন ভিত্তিক ভিসা প্রতারণা শুরু করেন। সুজন সাজ্জাল, সাঈদ খান, শামিম, কামাল, খালেদসহ অনেকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভিসা প্রতারণা করেন।
কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান (এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, জি) এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা জানতে পেরেছি ফেসবুকে বিজ্ঞাপন আকারে প্রচারের মাধ্যমে অনেকে বলছে যে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। ওরা ভিসা দেবে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রদূত।
তিনি বলেন, আমি কুয়েত প্রবাসীদের অনুরোধ করবো, আপনারা এরকম প্রচারণা ও প্ররোচনায় পড়ে প্রতারিত হবেন না।
রাষ্ট্রদূত বলেন, যদি কেউ কখনো ভিসা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে, তাহলে আপনারা দূতাবাসে এসে যোগাযোগ করুন, তবেই আমরা তার সত্যতা যাচাই করে পরামর্শ দিতে পারবো। ফেসবুকে ভিসা দেওয়ার বিজ্ঞাপন দেখে কেউ যেনো অর্থ লেনদেন না করেন।
কুয়েত ও বাংলাদেশ যৌথ নাম ব্যবহার করে কুয়েত থেকে পরিচালিত অনেক ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে বিভিন্ন পোস্ট, বিজ্ঞাপন দেখে সহজ সরল প্রবাসীরা প্রভাবিত হচ্ছেন।