‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ মূর্ত হয়ে উঠলো ২৫ মিনিটে

সাকিরুল কবীর রিটন: ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড যেনো ভেসে উঠলো চোখের সামনে। যশোর-কলকাতা রোড। এই রোডেই একটি প্রতীকী উপস্থাপনা। খুবই অল্প সময়ের। এরপরও একটি ইতিহাসের অদ্ভুত ফিরে দেখা।

সড়কের দুধারে বিভিন্ন বয়সী উৎসুক মানুষ। সবারই রোমকূপ জেগে উঠলো। সবার ভেতরেই দোলা। হৃদয়ে শিহরণ। একটু পর পর তারা এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। হঠাৎ সড়কের দিকে স্থির দৃষ্টি। শত শত মানুষের দলবেঁধে হাঁটা। এ হাঁটা যেন অজানা এক গন্তব্যের দিকে। কারোও গায়ে জামা নেই। কারোও গায়ে থাকলেও সেটি ছেঁড়া। খালি গায়ে রুগ্ন শরীরে হেঁটে চলছে এই সড়ক বেয়ে। কেউ বা তার বৃদ্ধ মা বাবাকে কাঁধে তুলে হাঁটছে। আবার কেউবা সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে নিজেদের শেষ সম্বল নিয়ে অজানা ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছেন। দলবেঁধে এ যাত্রা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে এ সড়কের শেষে ভারতের আশ্রয় শিবিরে। পাক আর্মির বর্বরতা থেকে বাঁচতে নিরস্ত্র বাঙালিদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাওয়ার এ যাত্রা।

এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও যুদ্ধকালীন সময়ে যশোর রোডে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র ঘটনাপ্রবাহে ফিরে যাওয়া হলো গৌরবোজ্জ্বল অতীতে।

শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) ৫২ বছর আগের ইতিহাস স্মরণ করল যশোরবাসী। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত যশোর রোডের পুলেরহাট বাজার থেকে কৃষ্ণবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ‘স্মরণে সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড-৭১’ স্মৃতিচারণের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন যশোর।

প্রায় ২৫ মিনিটে এক কিলোমিটারের এ যাত্রাতে যুদ্ধকালীন যশোর রোডের শরণার্থীদের যুদ্ধবিভীষিকা ও অবর্ণনীয় দুর্দশা ফুঁটে উঠে। ৫২ বছর আগের গৌরবোজ্জ্বল প্রতীকী স্মৃতিচারণে একদিকে যেমন অনেকের হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়েছে, অন্যদিক হয়েছে আবেগতাড়িত।

শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪ টায় শুরু হয় যশোর রোডের এই প্রতীকী পদযাত্রা। শহরতলী পুলেরহাট বাজার থেকে শুরু হওয়া প্রতীকী উপস্থাপনাতে প্রায় পাঁচ শতাধিক কলাকৌশলী যশোর রোডে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র ঘটনাপ্রবাহ প্রতীকী উপস্থাপনাতে ফুটিয়ে তোলেন।

কাঁধে করে এক বয়স্ক পিতাকে তার ছেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন আশ্রয়ণ শিবিরে। যাওয়ার পথে পাকিস্তানি মিলিটারিদের ভয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সেই বৃদ্ধ পিতাকে ফেলে রেখে যান গাছের নিচে। পরবর্তীতে একটি শিয়াল সেই বৃদ্ধের অসাড় দেহটির বিভিন্ন অংশ খেয়ে ফেলে। এসময় বৃদ্ধটি মারা যান। আবার একমাত্র সন্তানের মরদেহ নিয়ে হেঁটে চলার এমনও দৃশ্য ফুটেঁ উঠে। শত শত ক্ষুধার্ত শরণার্থীকে খাবার দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দরা। অনেকেই নিজের সম্বলটুকু পুটলি বেঁধে হেঁটে চলার দৃশ্যও দেখা গেছে। কেউ বা নিজের স্ত্রী সন্তানদের হারিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বেঁচে থাকা অবলা প্রাণী ছাগলটিকে শেষ সম্বল করে এই পথে হেঁটে চলার দৃশ্য ফুটে উঠে।

আবার মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যেভাবে তার ক্যামেরা এই সব শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশাচিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলো, সেটিও দৃশ্য দেখা গেছে।

এই প্রতীকী পদযাত্রা উপস্থাপনাতে অংশ নিয়েছিলেন অনুসূয়া নামে এক সাংস্কৃতিক কর্মী। তিনি বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। বাবা মায়ের মুখে শুনেছি। অভিনয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে শরণার্থীদের যে দুর্দশা, তার কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সে এক অসাধারণ সময়ের সাক্ষী হয়ে গেলাম।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার খবর বিশ্ববাসীর কাছে পোঁছে দিয়েছিলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের চরিত্রায়ন করেছেন যশোরের সাংস্কৃতিক কর্মী শফিকুল আলম পারভেজ।

তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন যশোর রোডের শরণার্থীদের নিয়ে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ রচনা করেছিলেন কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এটি শুধু একটি কবিতাই নয়, বাঙালির আত্মত্যাগের একটি মূল্যবান উপাখ্যানও। তার সেই চরিত্রটি সেভাবে করতে পারিনি। তবে তার সেই চরিত্র করতে যেয়ে আমি ফিরে গিয়েছিলাম গৌরবোজ্জ্বল অতীতে।

এই প্রতীকী পদযাত্রা নির্দেশক কামরুল হাসান রিপন বলেন, পাঁচ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী ও বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডের গৌরবোজ্জ্বল প্রতীকী স্মৃতিচারণে অংশ নেয়। এই সড়কের শুরু থেকে শেষ স্থান কৃষ্ণবাটি গ্রাম পর্যন্ত তারা নিজ নিজ চরিত্রে ডুবেছিলেন। ২০২৩ সালের এই দিনটাতে সবাই যেনো ফিরে গিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের সেই সেপ্টেম্বর মাসে।

যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আফজাল হোসেন দুদুল বলেন, একাত্তরে আমরাও এই সড়ক দিয়ে ওপারে গেছিলাম। সেই দৃশ্য আমাদের চোখে আজও ভেসে ওঠে। প্রতীকী যাত্রা আর সুনিপুণ অভিনয়ে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো।

পদযাত্রা শেষে স্থানীয় কৃষ্ণবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঐতিহাসিক যশোর রোড মুক্তিযুদ্ধের একটি অংশ। এই রোড ঘিরে আছে অনেক গল্প-গান। মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষ জীবন বাঁচাতে এই পথ দিয়েই ভারতে আশ্রয় নেন। অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র নিয়ে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ রচনা করেছিলেন কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এই কবিতাটি পড়লে বর্বর পাকিস্তানিদের নৃশংস গণহত্যার চিত্র যেনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জেলা প্রশাসনের এই আয়োজনে নতুন প্রজন্ম তাদের ইতিহাসকে নতুনভাবে জানতে পারলো। প্রতিবছরই এভাবে আমরা সেই ঐতিহাসিক রোডকে স্মরণ করতে চাই। একই সাথে এই রোডকে সংরক্ষণে আমরা পদক্ষেপ নিবো।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যশোর রোডের নাম জড়িত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীরা এই যশোর রোড দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আবার এই সড়ক দিয়ে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়ে ছুটতে থাকে। শরণার্থীদের নিয়ে মার্কিন কবি সড়কটি নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে একটি কবিতাও লিখেছিলেন, যেটি সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে ও সড়কটিকে স্মরণ করতেই এই আয়োজন।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts