রফিক সরকার: আজ ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবস। নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার পালন করা হয় বিশ্ব নদী দিবস।
১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিলো বিসি রিভারস ডে পালন দিয়ে। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে রিভারাইন পিপল নামের একটি সংস্থা এ দিবস পালন করে আসছে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে।
এবছর বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আমাদের জনজীবনে নৌপথ’।
রাজধানী ঢাকার পাশের নদী শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী ছিলো দুই পাড়ের মানুষের জীবন জীবিকার উৎস। এক সময়ে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর পানি পান করতো মানুষ। এ নদীতে মাছ ধরে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতো। তবে সময়ের পরিক্রমায় সব কিছুই পাল্টে গেছে। নদীর পানি পান তো দূরের কথা, এখন শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে মাছ পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দূষণের কবলে পড়ে যেমন জৌলুস হারাচ্ছে ১১০ কিলোমিটারের শীতলক্ষ্যা, তেমনি প্রায় মৃত হয়ে পড়েছে ৪৪ কিলোমিটারের বালু নদীটিও। অথচ নদী পাড়ের মানুষরা এক সময় রান্না-বান্নাসহ ঘরের কাজে এ নদী দুটির পানিই ব্যবহার করতেন।
জানা গেছে, শীতলক্ষ্যা নদীর উৎসমূল হচ্ছে পুরাতন ব্র্রহ্মপুত্র নদ। এটি নারায়ণগঞ্জ হয়ে গাজীপুরের কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলা অতিক্রম করেছে। গাজীপুর জেলার টোক নামক স্থানে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে একটি ধারা বানার নামে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে লাখপুর নামক স্থানে শীতলক্ষ্যা নাম ধারণ করে বৃহত্তর ঢাকা জেলার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা কলাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীতে পড়েছে। নদীটি নাব্য এবং সারা বছরই নৌ চলাচলের উপযোগী। শীতলক্ষ্যার ভাঙন প্রবণতা কম।
অন্যদিকে, বালু নদী বেলাই বিল ও ঢাকার পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জলাভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডেমরার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে পড়েছে। শীতলক্ষ্যার সঙ্গে কাপাসিয়ার কাছে সুতি নদীর মাধ্যমেও এর একটা ক্ষীণ যোগাযোগ আছে। একই ধরনের সংযোগ রয়েছে টঙ্গী খালের মাধ্যমে তুরাগ নদীর সঙ্গে। কালীগঞ্জের কাছেও বালু নদী শীতলক্ষ্যার সঙ্গে মিশেছে। বন্যার মৌসুমে বালু নদী শীতলক্ষ্যা ও তুরাগের পানি বহন করে। এই নদীর প্রধান গুরুত্ব হচ্ছে স্থানীয় জল নির্গমন আর নৌ-পরিবহণ অব্যাহত রাখা।
জানা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশের নদ-নদীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় থাকা মোট ৩৮৩টি নদীর অনেকগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। দূষণ ও ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের পাশাপাশি অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন, আবাসন এবং সেতু, কালভার্ট ও স্লুইসগেইট নির্মাণের ফলে ছোটবড় আরও অনেক নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। নদ-নদী ও প্রাকৃতিক খাল রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করেছে। তবে প্রয়োজনীয় জনবল ও অন্যান্য সুবিধা না থাকায় সংস্থাটি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
নদী পাড়ের মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছোটবেলায় তারা শীতলক্ষা ও বালু নদীতে গোসল করেছেন, সাঁতার কেটেছেন। এই নদীর পানি খেয়ে বড় হয়েছেন। কিন্তু এখন নদীর পানি এত নোংরা ও দুর্গন্ধ যে, স্পর্শ করা দূরের কথা, নাম নিতেও খারাপ লাগে।
কালীগঞ্জে নদী নিয়ে কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন- বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল। কথা হয় সংগঠনটির কয়েকজন নদী কর্মীর সাথে। তারা বলেন, আমাদের নদীগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকার লাগায়ো কালীগঞ্জে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী আজ দখলে দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ক্ষমতার প্রভাবে ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান নদী দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কিন্তু এই নদীগুলোতো আমাদের জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমাদেরকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। শুধু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নয়, নদীর হয়ে কথা বলতে হবে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে। তাহলেই নদী ভাল থাকবে। আর নদী ভাল থাকলেই, ভাল থাকবো আমরা ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের নগরায়নের ফলে নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো কর্মকান্ড পরিচালনা করলে তার ফলাফল শূন্যই থেকে যায়। আমরা ধীরে ধীরে নদী দূষণ করছি ও দখল করছি। এখন যদি এসব বন্ধ করতে না পারি, তবে সামনে আমাদের দুর্দিন আসছে।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীকে বাঁচাতে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্নভাবে সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছি। অথচ প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে আজো শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর দখল ও দূষণ বন্ধ করা যায়নি।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আজিজুর রহমান বলেন, সরকারি স্বার্থ বিনষ্ট করবে যত বড়ই শক্তিশালী হউক তা আমি করতে দিব না। বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী দখল ও দূষণে যারা জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দিব না।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে জেলার শ্রীপুর উপজেলার লবনদহ নদীর দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একইভাবে বিআইডব্লিউটিএ, নদী কমিশন এবং জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।