এম. এ. কাদের
শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) বিশ্ব ডিম দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ্ব ডিম দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী ডিম দিবস পালন শুরু হয়। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে খাদ্যতালিকায় দৈনিক মাথাপিছু ডিমের পরিমাণ অন্তত দ্বিগুন করতে হবে।
দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহর-বন্দর, হাট-বাজারে মাত্র ১২-১৩ টাকার মধ্যে হাত বাড়ালেই ডিম পাওয়া যায়। প্রতিটি মানুষকে প্রতিদিন অন্তত একটি করে ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, তাহলে প্রোটিনের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হবে।
বাংলাদেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বাজারে ডিমের দাম একটু বেশি হওয়ায় সরকার ভারত থেকে ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুরগী পালনের বিভিন্ন উপকরণ খাদ্য, ভ্যাক্সিন, ঔষধের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার কারণে ডিম, মুরগী উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়াই স্বাভাবিক। সাময়িক এই মুরগী ও ডিমের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদেশ থেকে ডিম আমদানি করা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা ভেবে দেখা দরকার।
আমদানিকৃত ডিমের সাথে বিভিন্ন রোগ-বালাই আসতে পারে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) লাইভ স্টক ইকোনমির তথ্য অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ডিম উৎপাদিত হয়েছিল ১৭ কোটি ৩৬ লাখ ৪৩ হাজার বা মাথাপিছু ১০৪টি, এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ডিম উৎপাদিত হয়েছে ২০ কোটি ৫৭ লাখ ৬৪ হাজার বা মাথাপিছু ১২১টি। সে হিসাবে এক বছরে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে তিন কোটি ২১ লাখ আর মাথাপিছু বেড়েছে ১৭টি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউ এইচ ও) পুষ্টিমান অনুসারে, বছরে একজন মানুষকে কমপক্ষে ২০৪টি ডিম খেতে হবে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ বাস্তবায়নে জনপ্রতি দুধ, মাংস ও ডিম যথাক্রমে ২৭০ মিলি, ১৫০ গ্রাম এবং ১৬৫টি বছরে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে রূপকল্প-২০৪১ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে জনপ্রতি দুধ ৩০০ মিলি, মাংস ১৬০ গ্রাম ও ডিম ২০৮টি বছরে ধরা হয়েছে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ডিম উৎপাদনের একটি প্রাক্কলন করেছে। সে হিসাব অনুযায়ী ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ডিমের বার্ষিক উৎপাদন হবে প্রায় ৩২৯৩.৪ কোটি এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৪৬৪৮.৮ কোটি।
স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে বেশি করে ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে দেশের অপুষ্টির চিত্র আমুল পালটে যাবে। ডিমের পুষ্টিগুণের কথা কমবেশি সবারই জানা। কেউ হাঁসের ডিম খেতে পছন্দ করেন, কেউ আবার মুরগির। হাঁসের ডিমে কিছুটা আঁশটে গন্ধ থাকায় অনেকেই পছন্দ করেন না। আবার অনেকের মুরগির ডিমে অরুচি আছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাঁস ও মুরগি দুই ধরনের ডিমই শরীরের জন্য উপকারী। তবে পুষ্টিগুণের বিচারে এই দুই ডিমে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। যেমন- প্রতি ১০০ গ্রাম হাঁসের ডিম থেকে এনার্জি পাওয়া যায় ১৮৫ কিলো ক্যালোরি। অন্যদিকে ১০০ গ্রাাম মুরগির ডিমে থাকে ১৪৯ কিলো ক্যালরি এনার্জি। কার্বহাইড্রেট ও খনিজের পরিমাণ সমান হলেও হাঁসের ডিমে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে। দুই ধরনের ডিমেই ম্যাঙ্গানিজ, কপার, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, সেলেনিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ও আয়রন পাওয়া যায়। তবে সব উপাদান হাঁসের ডিমে বেশি পরিমাণে থাকে। খাদ্যশক্তিও বেশি থাকে হাঁসের ডিমে। হাঁসের ডিমে ফ্যাট থাকে ১৩ দশমিক ৭ গ্রাম, মুরগির ডিমে থাকে ১৩ দশমিক ৩ গ্রাম। ১০০ গ্রাম হাঁসের ডিমে ক্যালসিয়াম থাকে ৭০ মিলিগ্রাম, আয়রন ৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ২৬৯ মাইক্রোগ্রাম। অন্যদিকে মুরগির ডিমে ক্যালসিয়াম রয়েছে ৬০ মিলিগ্রাম, আয়রন রয়েছে ২ দশমিক ১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ রয়েছে ২৯৯ মাইক্রোগ্রাম।
হাঁসের ডিম এবং মুরগির ডিমের মধ্যে মূল পার্থক্য হল হাঁসের ডিম প্রায় ৫০ শতাংশ বড় হয়। হাঁসের ডিম দেখতেও একটু অন্যরকম হয়। হাঁসের ডিম দীর্ঘদিন ভালো থাকে কারণ হাঁসরা সাধারণত পানির ধারে ডিম পাড়ে, সেকারণে হাঁসের ডিমের বাইরের অংশ শক্ত হয়। শক্ত হওয়ার কারণে অনেকদিন পর্যন্ত ডিম ভালো থাকে। সহজে ভাঙেও না। হাঁসের ডিমের কুসুম মুরগির ডিমের থেকে বড় হয়। এতে ফ্যাটের পরিমাণও বেশি থাকে। মুরগির ডিমের চেয়ে হাঁসের ডিমে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম হাঁসের ডিমে প্রোটিনের পরিমাণ থাকে ১৩ দশমিক ৫ গ্রাম এবং অন্যদিকে মুরগির ডিমে প্রোটিনের পরিমাণ থাকে ১৩ দশমিক ৩ গ্রাম । যাদের মুরগির ডিমে এলার্জি থাকে তারা হাঁসের ডিম খেতে পারেন।
পুষ্টিতে ভরপুর হাঁসের ডিমে আছে ওমেগা-থ্রি, ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ডি। আয়রনের পরিমাণ মুরগির ডিমের থেকে হাঁসের ডিমে বেশি থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগির ডিমে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ থাকে ৩ দশমিক ১ গ্রাম । অন্যদিকে হাঁসের ডিমে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ মুরগির ডিমের থেকে ৫০ শতাংশ বেশি থাকে। অ্যামাইনো অ্যাসিডের পরিমাণ মুরগির ডিমের থেকে হাঁসের ডিমে বেশি থাকে। তবে মুরগির ডিমেও থ্রিয়োনিন, আইসোলিউসিন, ট্রিপটোফ্যান, লিউসিন, মিথায়োনিন, লাইসিন, কিস্টিন, টাইরোসিন, ভ্যালিন, সেরিন, গ্লাইসিন, প্রোলিন, অ্যাসপারটিক অ্যাসিড, হিস্টিডিন, অ্যালানিন ও আর্জিনিনের মতো অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে।
পুষ্টিবিদদের মতে, পুষ্টিগুণের দিক দিয়ে মুরগির ডিমের চেয়ে হাঁসের ডিম বেশি উপকারী। কারণ এতে পুষ্টি উপাদান মুরগির ডিমের চেয়ে বেশি থাকে। তবে হাঁসের ডিমে মুরগির ডিমের চেয়ে বেশি কোলেস্টেরল থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম হাঁসের ডিমে কোলেস্টেরলের পরিমাণ থাকে ৮৮৪ মিলিগ্রাম। মুরগির ডিমে কোলেস্টেরলের পরিমাণ থাকে মাত্র ৪২৫ মিলিগ্রাম। তাই কারো হৃদরোগের সমস্যা থাকলে হাঁসের ডিম না খাওয়াই ভালো। এছাড়া হাই প্রোটিন ডায়েট মেনে চললে হাঁসের ডিমের শুধু সাদা অংশটাই খাওয়া উচিত।
অন্যদিকে, মুরগি ও হাঁসের ডিম বহুল প্রচলিত হলেও কোলেস্টেরলের কারণে অনেকেই খেতে পারেন না। এর বিকল্প হিসেবে কোয়েলের ডিম খাওয়া যেতে পারে। কোয়েলের ডিমে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, এনজাইম এবং এমাইনো অ্যাসিড এমনভাবে বিন্যাসিত যে, এই ডিম শরীরের সকল ধরনের পুষ্টির অভাব পূরণ করে শরীরের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে দিতে পারে। কোয়েলের ডিম থেকে মুরগির ডিমে কোলেস্টেরলের পরিমাণ প্রায় ৩ গুণ বেশি এবং প্রোটিনের পরিমাণ মুরগির ডিম থেকে প্রায় শতকরা ৭ ভাগ বেশি। একারণে কোয়েলের ডিম অধিক সাস্থ্যসম্মত। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া সচল রাখতে পারে কোয়েলের ডিম। শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে বিভিন্ন রোগ-বালাই থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ডিমের কোন জুড়ি নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইমেইল: makader958@gmail.com