গার্মেন্টস শিল্পের অস্থিরতার দায় কার?

মো. সাখাওয়াত হোসেন

গার্মেন্টস শিল্প দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় এ দেশে গার্মেন্টস শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নৈরাজ্য, অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা পোশাক খাতের জন্য খুবই শঙ্কার। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে  সকল পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। মজুরি বৃদ্ধির এই ঘোষণাকে শ্রমিকদের একটা পক্ষ মেনে নিলেও আরেকটি পক্ষ তা মেনে নেয়নি। বরং বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন তারা। শ্রমিকরা বলছেন, বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই মজুরি নির্ধারিত হয়নি। ১২ হাজার ৫০০ টাকায় একজন শ্রমিকের পরিবার নিয়ে চলা কষ্টসাধ্য। আইন অনুযায়ী বোর্ডের মজুরি নির্ধারণের ঘোষণার পর ১৪ দিনের মধ্যে সেটি প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করতে হয়। এরপরের ১৫ দিনের মধ্যে মজুরি নিয়ে আপত্তি তোলার সুযোগ রয়েছে। শ্রমিকদের আরেকপক্ষ বলছে, বৈশ্বিক মন্দাসহ সবকিছু বিবেচনায় কাঙ্খিত আশা পূরণ না হলেও মন্দের ভালো হিসেবে এটি মেনে নেয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, কারখানা শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে আসছেন।

তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করার জন্য বহিরাগতরা উসকানি দিচ্ছে বলে মালিকপক্ষ অভিযোগ করছে। অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে গত কয়েক দশকের পথপরিক্রমায় দেশের তৈরি পোশাকশিল্প আজকের এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। অনেক প্রতিকূলতা এবং দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প এগিয়ে যাচ্ছে অগ্রগতির পথে। দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে পোশাকশিল্পের অনন্য সংযোজন রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশ থেকে যে রেমিট্যান্স আসছে তার অন্যতম খাত হলো গার্মেন্টস শিল্প। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক অর্থ আয় করছে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। বর্তমান বাস্তবতায় পোশাকশিল্পে নতুন করে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এরই মধ্যে রয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া ও চীনভিত্তিক ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বর্তমান দুর্বল বিশ্ব অর্থনীতি এবং আরেকটি হচ্ছে আগামী দিনে আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮৪ দশমিক ৫ শতাংশই গার্মেন্টস খাত থেকে আসে। দেশে ৪ হাজারের অধিক কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ লোক জড়িত, যাদের অধিকাংশই নারী। প্রতি ৫ বছর পর পর বেতন পুনঃনির্ধারণের যে বিধান রয়েছে, শ্রমিকরা সেটির বাস্তবায়ন চাইছে। সে লক্ষ্যে সরকারের মজুরি বোর্ডও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এবং এজন্য আগামী ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা দেয়া হয়েছে। তারপরও হঠাৎ করে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, মিরপুরসহ ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা আন্দোলন, জ্বালাওপোড়াও কর্মকান্ডে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনার পেছনে কার্যকারণ বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরী। মূলত কার্যকারণের মাধ্যমে ঘটনাকে যেমনভাবে বোঝা যাবে ঠিক তেমনিভাবে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পরিচয়ও জানা যাবে।

গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে উল্লেখ করেন শ্রমিক নামধারী কিছু নেতা নানা উসকানিমূলক কথা বলে শ্রমিকদের খেপিয়ে তুলছেন। তাদেরই উসকানিতে শ্রমিকরা গার্মেন্টস শিল্পে জ্বালাওপোড়াও, ভাঙচুর চালান এবং পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। এসব নেতা গার্মেন্টসে চাকরি করেন না, গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গেও জড়িত না। কিন্তু তারা স্বার্থান্বেষী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট নেতা। তারা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক সংগঠনের নামে কোটি কোটি টাকার আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকেন। ওই সব দেশ তাদের মতলব অনুযায়ী গার্মেন্টস শ্রমিকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বিক্ষোভে নামার পর থেকে পুলিশ, মালিকপক্ষ এমনকি শিল্প মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গেও শ্রমিকদের কোনো কথা বলতে দিচ্ছেন না এসব শ্রমিক নেতা। উলটো গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকে উসকে দিচ্ছে শ্রমিক নামধারী ওই চক্রটি। তারাই সুকৌশলে শ্রমিক অসন্তোষ লাগিয়ে দিয়েছে। বিজিএমইএ ও গার্মেন্টস শ্রমিক নেতারাও বলছেন, কোনো একটি পক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে পরিকল্পিতভাবে সহিসংতা চালাচ্ছে।

এছাড়াও একাডেমিক ও বাস্তবিক অবস্থার প্রেক্ষিতে গার্মেন্টস শিল্পের অস্থিরতাকে বিভিন্ন উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

প্রথমত: হুজুগে বিশ্বাস করা মানুষের সংখ্যা এখনো অসংখ্য। কোন ঘটনার যথার্থ বিশ্লেষণ না করেই উড়ো সংবাদকে বিশ্বাস করে অঘটন পটিয়সী ঘটনার সংখ্যাও অহরহ দেখা যায়। শুধু যে গার্মেন্টস সেক্টরে এর ছাপ দেখা যায়, ব্যাপারটি তেমন নয়। অন্যান্য অনেক উৎপাদনশীল সেক্টরে হুজুগে সংবাদের কারণে অঘটনের সংখ্যাও অজস্র। কেননা দেখা যায়, একটি গার্মেন্টসে কোনরূপ একটি আন্দোলন শুরু হলে সেটি দাবানলের মত আশেপাশের সকল গার্মেন্টস সেক্টরে ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের চরিত্রের মানুষের কারণে গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।

দ্বিতীয়ত:  একটি গোষ্ঠীই রয়েছে যারা পরিকল্পিতভাবে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মিথ্যা প্রোপাগন্ডা ছড়িয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সস্তা জনপ্রিয়তার প্রত্যাশা করে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য তাদের অর্থনৈতিক মুনাফার অনুষঙ্গ জড়িয়ে রয়েছে। তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পুরো দেশে বিচরণ করে থাকে। চুক্তিভিত্তিক কোন গ্রুপ কিংবা গোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই উল্লিখিত গ্রুপটি মিথ্যা প্রোপাগন্ডা ছড়িয়ে থাকে।

তৃতীয়ত: মিডিয়ার মাধ্যমে দেখা যায়, পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। শ্রমিকদের দাবি হচ্ছে, পণ্যের দাম কমাও না হলে মজুরি বৃদ্ধি কর। কাজেই যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি করছে তারা প্রত্যেকেই অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য দায়ী।

চতুর্থত: বেশকিছু দিন ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। হরতাল-অবরোধ দিয়ে বিএনপি জামায়াত রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে প্রতিনিয়ত। সরকারের নিকট একদফা দাবি প্রদান করে রাজপথের আহূত আন্দোলনে জনগণের সাড়া না পেয়ে বিকল্প হিসেবে এ পক্ষটি গার্মেন্টস সেক্টরকে ইন্ধন প্রদান করে উৎপাদনশীল সেক্টরকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা করতে পারে। তা না হলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে কেনইবা গার্মেন্টস সেক্টরে আন্দোলন? কাজেই এ ব্যাপারগুলোতে অধিক তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। অপরাধী যে বা যারাই হউক না কেন প্রত্যেককে আইনের নিকট সোপর্দ করতে হবে। তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে।

পঞ্চমত: যারা স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি, সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাসী গোষ্ঠী, উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করেন মূলত তারাই বাংলাদেশের চলমান অগ্রগতির ধারাকে বাঁধাগ্রস্থ করতেই ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবে গার্মেন্টস সেক্টরে ইন্ধন দিয়েছে।

ষষ্ঠত: আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থাপনায় গার্মেন্টস শিল্পে যারা বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রয়েছে ষড়যন্ত্রে তাদেরও ইন্ধন থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

শেষত: আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিভিন্ন সমীকরণ ও হিসাব নিকাশের জটিল প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান গ্রহণ করেছে তারা সবজায়গায় সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।

উল্লিখিত বিষয়গুলোর পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে ষড়যন্ত্রকারী, ইন্ধনদাতা, মদদদাতাদের চরিত্র উদঘাটন করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সম্ভাবনাময় এ শিল্পে সরকার অস্থিরতা নিরসনে শ্রমিকদের দাবির প্রেক্ষিতে মজুরি বৃদ্ধি করেছে। তবে যে বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে হয়ে যাওয়ার কথা সেখানে আন্দোলনের নামে অস্থিরতা সৃষ্টি করা কোনভাবেই সমীচীন নয়। তাছাড়া অনেকেই এ সেক্টরটিতে ঘোলাজলে মাছ শিকারের পায়তারা করেছিল। সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে শ্রমিক অসন্তোষ দূর হয়েছে তথাপি যারা এ সেক্টরে অস্থির পরিস্থিতির অবতারণা করেছে সকলকেই চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। জরুরী এই অর্থে এখন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক খেসারত দিতে হবে। আমরা কখনোই চাই না, গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করুক।

লেখক-চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Print Friendly

Related Posts