ফকির ইলিয়াস এর পাঁচটি কবিতা

————————-
বসন্তের বৃন্দগীত
————————

জানি— তুমি ভালোবাসো ঋতুদের সমাহার।
গ্রীষ্মের ঘর্মকণা কিংবা শীতের শিশিরে
সিক্ত হয় যে পুষ্প, তুমি তার পাপড়ি স্পর্শ করে
খুঁজো আকাশের অঙ্গীকার।

উন্মত্ত জোয়ার বুকে নেমে আসে যে বর্ষা—
তা’কেও আলিঙ্গনের জন্য তুমি থেকেছো উদগ্রীব।
জানি— যে দেশে কাশফুল নেই, তুমি সে দেশ
ঘুরে এসে প্রশংসা করেছো বাংলার শরতের।
পলিমাখা ধানী জমি খুঁজে পাওনি বলে,
কার্তিকে সাজিয়েছো হেমন্তের নবীন ভোর।

আমি তোমার কন্ঠে বসন্তের বৃন্দগীত শোনে
ভূগোলকে বাঁক বদল করতে বলেছি।
বলেছি—
এই বাংলায় ফিরে এসেই আবার জড়িয়ে ধরবো
তোমার ঋতুমাত্রিক বাহু।

——————————-
নীলান্তের হাওয়াকক্ষ
——————————-
উড়ে যাচ্ছো— না কী জুড়ে থাকছো হৃদয়
তা দেখার জন্য উঁকি মারি আকাশের জানালায়।
হাওয়াকক্ষগুলো বন্ধ করে তুমি নিচ্ছো
সান্ধ্যকালীন মেকআপ।

ডিনারের আগে যে চিত্রকর্মগুলো প্রদর্শিত হবে—
সেগুলোর ফর্দ দেখে আমি আগেই জেনে গেছি
সেখানে থাকবে না কোনও নীলান্তের ছাপ।

আমি রঙের গহীনে আমার সবটুকু প্রেম
সমর্পণ করেছি আরও আগে।
‘বিজলী’ ‘বিজলী’- বলে পুরোরাত গেয়েছি
আলোর বন্দনা। লোডশেডিং হবে না জেনেও,
তর্পণ করেছি বিগত অন্ধকারের স্মৃতি।

এই হাওয়াকক্ষে নীলসুবাস ছড়াবে বলে
যে পাখি দীর্ঘপথ উড়েছিল—
তাকে বলে দিয়েছি, গভীর আকাশে
নীল বলে প্রকৃত কোনও রঙ নেই।
11960034_10
——————
হিমের আকর
——————
জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি।এখনও নামেনি শীত। তবু খুব বেশি কাঁপনের ধ্বনি শুনি।
শীতল সৌন্দর্য ছড়িয়ে যে নদী বয়ে গেছে- তাকেও এখন আর প্রতিবেশী ভাবতে পারি না। অথচ একদিন এই নদীতেই স্টেনগান হাতে কেটেছি সাঁতার। একাত্তরে- এই চাঁদহীন
রাতের গায়ে হাত রেখে বলেছি, যুদ্ধজয় আমাদের হবেই। পতাকা হবে আমাদের প্রেম।
মাটিকে সাক্ষী রেখে যেদিন প্রথম ভালোবাসতে শিখেছিলাম, সেদিনও এই দুপুরের গায়ে
ফুটেছিল কয়েকটি জারুল ফুল।স্রোতের সান্নিধ্য পেয়ে আপ্লুত হয়েছিল পাপড়ির ছায়াগুচ্ছ,
বলেছিল পাখি,-উষ্ণতা চাই পালকের, ভুলে যেতে চাই সবটুকু সংশোধিত হিমের আকর।
মানুষ সবস্মৃতি ভুলে যেতে পারে না। যেমন ভুলিনি একাত্তর। স্বাধীন বাংলায়,এখন
সেই দাবনল দেখে পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোর কথাই মনে পড়ে। সড়কের পাশে, পেট্রোল
বোমার আঘাতে ঝলসে যাওয়া মুখ দেখে আঁতকে উঠি। এখন শীতকাল নয়, তবু
কুঁকড়ে উঠে পাঁজর- হে জীবন, তুমি কি দ্বিখণ্ডিত হয়ে আমাদের সম্মিলিত বেদনা
মোচন করে দিতে পারো না !

——————————
ছায়ার বিস্তার দেখে
—————————–

না পারার গ্লানি আমাকে আর ছুঁতে পারে না। অনেক কিছুই
সাধ্যের আঁধারে ডুবে থাকে। জানি সমুদ্র উতলা হলে
প্রাণকেও কাছে ডেকে নেয়। আর বিবর্ণ ফেনার সাথে পাল্লা দিয়ে চলে
জাহাজ, জলজন্তুরাও মুখ ভাসিয়ে দেখে অবনত চাঁদের মুখ। কবে ভোর
হবে কীভাবে নাবিকেরা পাবে তীরের দেখা, তা ভেবে বার বার উৎকন্ঠিত
হয় প্রকান্ড লৌহখণ্ড।

ভুলদুপুর সাজিয়ে আমি আবারও জলের কাছাকাছি বসে থাকি। স্থিতু রোদে,
জলাকাশের অবশিষ্ট চূর্ণ সাজিয়ে দেখি মুখ। চলে যাওয়া প্রেমিকার পায়ের
কর্দমাক্ত আলতাচিহ্ন। ছায়ার বিস্তার দেখে বুঝে যাই…
ছায়াহীন আমার ভবিষ্যত জানে, জোয়ারের অধিক কোনো দাগ
এই চর স্পর্শ করে নাই ।

————————–
জলের জীবনীকার
————————–
আমার বিশেষ কোনো শিক্ষাসনদ নেই। তাই ‘জলের জীবনীকার’ হবার
জন্য তোমার প্রস্তাব আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি। ফিরিয়ে দিচ্ছি – আমার হাতে
জমানো সবগুলো অতীত। যে অতীত পাখিজন্ম অতিক্রম করে মানুষের
হাতেই তুলে দিয়েছিল তার ভবিষ্যত। আর নদীকূলে দাঁড়িয়ে যারা খুব
সাবধানে দেখেছিল সেই দৃশ্যাবলী তারা সাক্ষী হয়ে বলেছিল – বাঁচো,
বেঁচে থাকো জীবনের বিশুদ্ধ প্রণালী।

আমি জীবনের জন্য কোনো দেনা রেখে যাচ্ছি না।রেখে যাচ্ছি না
এমন কোনো উপাত্ত – যার পরমাণু থেকে কেউ সংগ্রহ করতে পারবে
এমন কোনো রসদ, যা আগামী মানুষের কাজে লাগবে।

জানি, আমি কোনো কাহিনীই লিখতে চাইনি। তারপরও এই বৃষ্টি,
এই রোদ আমাকে দিয়ে কিছু কবিতা লিখিয়ে নিয়েছিল। অথচ
অপারগতার বিশেষণ সাথী করে আমি তাই চাইনি – জলের মুখোমুখি হতে।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts