শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ।।
আমার এক জ্ঞাতি জ্যাঠামশাই ছিলেন, যিনি পুরোহিতের কাজ করতেন। তাঁর কাছেই, বলতে গেলে ভূতচতুর্দশী সম্পর্কে আমার একটা ধারণা তৈরি হয়। থাকতাম মফসসল শহরে। তো সেই জ্যাঠা বলতেন, ভূতচতুর্দশীর দিন তিনি বাতাসে কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ পান। বলতেন, ‘আমি একটা গন্ধ পাই। তাঁরা আসেন।’ তখনই বুঝতে শিখেছিলাম, ‘তাঁরা’ আসলে কারা? কেনই বা সবসময় তাঁদের দেখা যায় না, কখনও কখনও অনুভবে বা অস্বস্তিতে ‘তাঁরা’ আসেন।
কালীপুজোর ঠিক আগের দিনই ভূতচতুর্দশী। কালীর সঙ্গেই থাকেন ভূতনাথ, মানে শিব। ভূতের রাজা। তাই কালীর সঙ্গে এর একটা যোগাযোগ আছে। মা কালী আসার আগে থেকে তাঁরা মর্ত্যে আগমন করেন।
তবে, এই ভূতচতুর্দশীর সঙ্গে আমাদের ছেলেবেলার একটা অদ্ভুত আনন্দ জড়িয়ে আছে। আমরা ওই দিন চোদ্দো শাক খেতাম, চোদ্দো প্রদীপ জ্বালাতাম। বলতে গেলে, আমার কার্যকলাপ বেড়ে যেত ভূতচতুর্দশীর দিন। চোদ্দো শাক বাছা, প্রদীপের সলতে পাকিয়ে তেল ঢেলে সেগুলো জ্বালানো।
এরই সঙ্গে কিন্তু একটা ভয়ও কাজ করত। আমাদের মফসসল শহর ছিল বেশ ঘন অন্ধকারে ঢাকা, চতুর্দিকে বড় বড় গাছ, রাস্তায় আলো ছিল না। গোটা দিন এক রকম, কিন্তু সন্ধ্যের পর থেকেই কেমন অন্য রকম হয়ে যেত। তখন নাইট লাইফ বলে কিছু ছিল না। সন্ধ্যে হলেই সকলে ঘরে। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া। ভয় পাওয়ার যাবতীয় উপাদানও ছিল সেখানে। এখন তো চড়া আলোয় সেই আতঙ্ক বা কল্পনাশক্তি কাজই করবে না।
তবে, ভূতচতুর্দশীর দিনটা বরাবরই এনজয় করেছি। ওই যে চোদ্দো শাকের কথা বললাম, তাতে হয়তো বিশেষ ধরনের ভিটামিন আছে। তাই হয়তো সেটা খেতে বলা হত। আজও খেয়েছি। বরাবর খেয়ে আসছি। অল্প কয়েক বারই হয়েছে যখন খেতে পারিনি। হয়তো মেসে বা বাইরে ছিলাম, সে বার হয়তো দেশের বাড়িতে যেতে পারিনি। চোদ্দো শাক আমার মা করতেন। সেই মফসসল থেকে শহরে বাসা করার পরেও এখনও খাই।
কিন্তু এখানে একটা কথা বলার আছে। আমার লেখালেখির সঙ্গে আমার ব্যক্তিজীবন মিলিয়ে ফেললে চলবে না। আমার ছোটদের লেখায় বহু সময় ভূতের চরিত্র আসে। তবে, তারা নেহাতই নিরীহ ভূত। আমি ভয় পাওয়ানোর জন্য লিখি না। ভয় ভাঙানোর জন্য লিখি। ছোটরা আমার লেখা পড়ে ভূতের ভয় পায় না, বরং ভূত সম্পর্কে তাদের ভীতি কেটে যায়।
আমি যদিও ভূতে বিশ্বাস করি। কারণ, আমার জীবনে এমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে যা থেকে আমি এই ধারণায় এসেছি এবং এই ধারণা থেকে আমি সরবও না। আমার জীবনে নানা সময়ে এমন সব ঘটনা ঘটেছে, তা থেকে ভুতে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কোনও মানুষ যখন চলে যায়, তার আত্মার হয়তো তখনও কিছু বলার আছে। সে ঘুরে ঘুরে আসে, কিছু কাজ করে, বোঝাতে চায় তার অস্তিত্ব। এ ব্যাপারে আমার কাছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করে লাভ নেই। আমি সেই ব্যাখ্যায় যাবও না। কারণ, এই অনুভূতি আমার নিজস্ব, অভিজ্ঞতাও।
গার্সটিন প্লেসে আকাশবাণীর পুরনো বাড়িতে ভূতের কথা আমি অনেকের মুখেই শুনেছি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ও আমায় তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। দ্বিজেন তো এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে অজ্ঞান হয়ে যান।
আমার নিজের জীবনের নানা ঘটনার মধ্যে আমাদের বাড়ির একটা ঘটনার কথা বলি। আমাদের বাড়িতে একটা ডাইনিং টেবিল ছিল। আমরা যখন কাটিহারে থাকতাম, তা সেটা ১৯৪২-’৪৩ হবে। সেখানেই বাবা পুরনো আসবাবপত্রের দোকান থেকে ওই ডাইনিং টেবিলটা কিনেছিলেন। খুব ভাল বর্মা টিকের জিনিস। তা সেটা আমাদের বাড়িতে আসার পরে অনেক রাতে আমি দেখেছি, এক মেমসাহেব ওই টেবিলের চারপাশে ঘুরছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়ে অদ্ভুত এক অস্বস্তি হয়েছে। অন্তত পাঁচ-ছ’বছর রাতে আমি এই দৃশ্য দেখেছি। তবে প্রতি রাতে নয়, মাঝে মাঝে মেমসাহেব দেখা দিত। টেবিলের চারপাশে ঘুরত। শুধু কাটিহারেই নয়, আমরা যখন মাল জংশনে থেকেছি, তখনও এই একই দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। এখনও সেই টেবিল শিলিগুড়ির বাড়িতে আছে।
আজ ভূতচতুর্দশীর রাতে সেই সব ছবিগুলো আবার আমার কাছে বড় স্পষ্ট হয়ে উঠল!