নোবেলে মাপা যায় না তাঁকে!

সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী

 

সে প্রায় তিন দশক আগেকার কথা। আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বেরিয়েছে। বিক্রি হচ্ছে গরমাগরম। পড়তে গিয়ে কিছুটা এগোনোর পরই মালুম হয়, পপুলার সায়েন্স বলতে যা বোঝায়, তার তুলনায় বইটি একটু কঠিনপাচ্য। তা হোক। বিগ ব্যাং থেকে ব্ল্যাক হোল— ব্রহ্মাণ্ডের এই যাত্রা–‌কথা দেখতে দেখতে বেস্ট সেলার। কয়েক বছর ধরে। বইয়ের বিষয়বস্তুর কারণে?‌ সৃষ্টির আদি–‌অন্ত বুঝে নেওয়ার স্বাভাবিক কৌতূহলে?‌ বইটির জনপ্রিয়তার আরও বড় কারণ বোধহয় ছিল লেখকের খ্যাতি। হ্যাঁ, স্টিফেন হকিং তখনই সাধারণ শিক্ষিত মানুষের কাছে এক বিস্ময়মানব।

Amyotrophic lateral sclerosis‌–‌এ পঙ্গু থেকে পঙ্গুতর হয়ে যাওয়া, পেশির সামান্য নাড়াচাড়ায় যন্ত্রের মাধ্যমে কথা বলা, মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপকে কোনওরকমে ভাষারূপ দিয়ে চলা— বিস্ময় তো ছিলই। মানুষটির শরীর যেন শুধুই মস্তিষ্ক— A beautiful brain! তাঁর অবদান বা সেই অবদানের তাৎপর্য আমরা যে খুব ভাল বুঝতাম, তা তো নয়। যেমন ধরা যাক হকিং রেডিয়েশন। কৃষ্ণ গহ্বরের রাক্ষুসে টান অতিক্রম করে কিছুই বেরোতে পারে না, আলোকরশ্মিও নয়, এই ধারণা খণ্ডন করলেন তিনি। গাণিতিকভাবে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সঙ্গে কোয়ান্টাম তত্ত্বের রফা করতে চাইলেন। এসবের মূল্য ঠিকঠাক উপলব্ধি হোক বা না হোক, আইনস্টাইন–‌উত্তর যুগের সবচেয় জনপ্রিয় বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন হকিং— the most loved scientist. ‌

তার পরেও প্রশ্ন, নিউটন বা আইনস্টাইনের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে হকিংয়ের নাম উচ্চারণ করাটা কি বাড়াবাড়ি নয়?‌ জ্ঞানের জগতে সত্যিই কি তেমন কোনও মোড় ফেরানো ঘটনা হকিং ঘটাতে পেরেছেন?‌ অনেক সম্মান, পুরস্কার পেয়েছেন, ঠিকই। কিন্তু ফি বছর এত এত বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন, হকিং তো সেটাও পাননি। কেন?‌

এর একটা সম্ভাব্য উত্তর, ব্ল্যাক হোল থেকে রেডিয়েশন সম্ভব কি না, তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়নি। হলে নোবেল পুরস্কারটা বাঁধা ছিল হকিংয়ের। হতে পারে। এমনও হতে পারে, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে মানুষটার অবদান নোবেল পুরস্কার দিয়ে মেপে ফেলা যাবে না। আমরা আম আদমি, এসব নিয়ে বেশি কথা না বললেই ভাল। তবে অন্য কিছু কথা বলা যেতে পারে। মহাবিশ্বের পথিক হকিংয়ের মধ্যে মানুষ দেখতে পেয়েছে এমন একজন মানুষকে, যাঁর অন্তর সাড়া দেয় সমসময়ের যন্ত্রণায়। একদিন তাই ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন তিনি।

আর এই তো কিছুকাল আগে, ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রশ্নে ট্রাম্পের নীতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। হওয়ারই কথা। এই মানুষটিই একদিন ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, সমাজ, রাজনীতি, পরিবেশের যা হাল, এই যে এত বিশৃঙ্খলা, ১০০ বছর পরে কী হবে এই মানব সভ্যতার?‌ পরে নিজেই বললেন, আসলে আমারও জানা নেই উত্তরটা।

মানুষ ভাবুক, এটাই চেয়েছিলাম। ‌

Print Friendly

Related Posts