মুক্তিযুদ্ধোত্তর গণশিক্ষা আন্দোলন ও একালের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস
এএইচএম নোমান

 

মুক্তির টানে, স্বাধীনতার চেতনায় মুক্তিযুদ্ধকালীন বিরামহীন সাহসী আমলা-মুক্তিযোদ্ধা- সমবায়ী বিজয়ী বেশে এভাবেই দ্বিতীয় যুদ্ধের জন্য ডাক দিলেন গণশিক্ষা আন্দোলনের- ’মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি, ব্রিটিশকে তাড়িয়েছি, পাকিস্তানিকে তাড়ালাম এখন নিরক্ষরতাকে তাড়াতে হবে। দীর্ঘ নয় মাস আপনারা-আমরা যুদ্ধ করেছি-মুক্তিযুদ্ধ। দেশকে স্বাধীন করেছি, প্রথম যুদ্ধ শেষ করেছি। মুক্ত মাটিতে আমরা এখন গর্বিত স্বাধীন জাতি। এখন আমাদের ২য় যুদ্ধ শুরু করতে হবে। নিরক্ষতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এ যুদ্ধেও জিততে হবে।
সঙ্গে বগল দাবা করে আনা এক বোঝা গণশিক্ষার কাজে ব্যবহৃত ফিপচার্ট, বই, পুস্তিকা উপস্থিত সকলকে দেখিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করলেন কিভাবে পড়াতে, বুঝাতে, ব্যবহার করতে হয় ও তাড়াতাড়ি দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে হবে। তাহলেই মুক্ত মাটির স্বাদ দেশবাসী পাবে, উৎপাদন বাড়বে, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় সাধারণ মানুষ সচেতন হবে।’

২২ ডিসেম্বর ১৯৭২। যেমন কথা তেমন কাজ, শুরু হয়ে গেল গণশিক্ষা। ঠিক হলো প্রাথমিক সমবায় সমিতি, উদ্যোগী যুবক, প্রাইমারী স্কুল, মক্তব, কাচারী ঘর/বৈঠকখানা ভিত্তিক শুরু হবে। সমবায়ের মাধ্যমে সকল থানায় মাস খানেকের মধ্যে শতাধিক গণশিক্ষা কেন্দ্র শুরু হয়ে গেল। প্রতিযোগিতামূলক দেশ গড়ার পরিবেশে বিছানা/বসার স্থান, হারিকেন, কেরোসিন, শিক্ষক, সমবায়ী, যুবক ইত্যাদি কিছুরই যেন ঘাটতি নেই। তবে বই পাবে কোথায় এবং কি বই, শ্লেট, পেন্সিল ইত্যাদি চাহিদার তুলনায় টান (অভাব) পড়ে গেল। বই হিসেবে সে সময় একমাত্র আদর্শলিপি ও বাল্যশিক্ষা গ্রামের পুস্তক বিক্রেতা বা ছোট মুদি দোকানে পাওয়া যেত। সাধারণ পড়ুয়ার জন্য চাহিদা কম থাকায় দোকানে খুব কম মজুদ থাকতো হেতু সরবরাহ সমস্যা দেখা দিল। পড়ুয়া সংগ্রহ খুব একটা সমস্যা হলো না। কেননা সবার মধ্যে একটা জোশ, চেতনা, প্রেরণা ও প্রয়োজনীয়তা যেন নিজ গ্রাম-এলাকা থেকেই উৎসারিত হচ্ছিল।

শ্লোগান ছিল ‘আমরা সবাই নিরক্ষরমুক্ত হবো’, নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ব। গণশিক্ষা কেন্দ্র চালুর এক পর্যায়ে শ্লেট, পেন্সিল, হারিকেন, কেরোসিন তেল ইত্যাদির টানাটানি শুরু হয়ে গেল। সমবায় সমিতির মাধ্যমে এর ব্যবস্থাপনায় ও অংশগ্রহণে হারিকেন ও কেরোসিন তেলের সমস্যার সমাধান কিছু হলেও যতই পড়–য়া বাড়ছে শ্লেট ও বইয়ের সমস্যা ততই বেড়ে যাচ্ছে।

শ্লেট ও বইয়ের সমস্যা সমাধানে আবিষ্কার হলো মাটি কাঠি পদ্ধতি। গ্রামে বা সমিতিতে শিক্ষিত যে ছেলে, যুবক, মহিলা বা সদস্য আছে সে গ্রামে যখন যে যেখানে সুযোগ ও সময় পাবে তখন মাটিতে ক, খ, গ বা ১,২,৩ কাঠিতে লিখে দেবে, হাত ঘোরাবে ও শিখবে। এভাবে মাটি কাঠির প্রচলন শুরু হয়ে গেল। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এলাকা থেকে আর এক এলাকায়। মহিলারাও ঘর, চুলা বা আশপাশে কাজ করা অবস্থায় অন্য শিক্ষিতদের সহায়তায় (কমই শিক্ষিত মহিলা ছিল) শ্লেট, কাগজের অভাব হলে মাটিতে লিখে শেখাতো।

কিভাবে একটা ধ্বংসস্তুপ থেকে দেশকে পুনর্গঠন ও গড়বে, এ সৃষ্টির তাড়নায় সবাইকে যেমন উদ্বেলিত করতে লাগল, তেমনি উৎসাহ, উদ্দীপনাও বাড়তে লাগল দিন দিন। মতিঝিল সমবায় সদন কার্যালয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমবায় ইউনিয়ন আওতায় জাতীয় গণশিক্ষা সেল খোলা হলো।

ইতোমধ্যে জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। সবাই আনন্দে একাকার। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন, সে এক ঐতিহাসিক আনন্দ – বিজয় উল্লাস। আমরা মাত্র ২/৩ দিন আগে জানতে পারলাম, বঙ্গবন্ধু রামগতি আসবেন, তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ইং। তখন প্রতিদিন আমরা ‘সন্ধ্যাকালীন আসরে’ বসতাম সমবায় সভাপতি আবদুর রব খন্দকার, মুক্তিযোদ্ধা তাজল ওসি, ছোলায়মান মিয়া বা রফিক সেক্রেটারী বা তোফায়েল ডাক্তার সাহেবের ঘরে। সেদিন আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী অজিউল্ল্যাহ মিয়ার নেতৃত্বে আমরাও তোফায়েল ডাক্তারের চেম্বারে বসলাম। আমি (কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা-সেক্রেটারী)সহ ঠিক করলাম, সমবায়ীরা ২১ ফেব্রুয়ারী স্মরণ উপলক্ষ্যে বুকে অ আ ক খ বর্ণমালা ১,২,৩ লাগিয়ে মিছিল সহকারে পোড়াগাছা যেখানে বঙ্গবন্ধু আসবেন) যাওয়া হবে।

আমরা ৭-৮ হাজার সমবায়ী সকলে বুকে সুই-সূতা দিয়ে ক খ গ ১, ২,৩ লাগিয়ে শেখের কিল্লায় যাই। প্রথম বিজয়ের মাসে প্রথম সপ্তাহেই মুক্তির পরবর্তি ২২ ডিসেম্বর ১৯৭২ আলেকজান্ডার স্কুল গৃহে মুক্তিযোদ্ধা সমবায়ীদের এক সভায় ‘নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় যুদ্ধ’ ঘোষণা করা হলো। পাশাপাশি দ্বিস্তর বিশিষ্ট সেলফ জেনারেটিং রামগতি থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির উদ্যোগে ‘মাটিকাঠি’ পদ্ধতিতে স্বেচ্ছাশ্রমে ১২০টি গণশিক্ষা কেন্দ্র চালু হয়ে গেল। তম্মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার আমলেই বিশ্বগ্রাম, হাওলাদারপাড়া অজিউল্লা মিয়া বাড়ীর দরজা, চর পাগলা(চর বুদ্ধি) পাটওয়ারী পাড়া ও আসলপাড়াসহ ১২টি সরকারী প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা পায়।

প্রসঙ্গত, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক জনাব বাসুদেব গাঙ্গুলীর সাথে তাঁর সভা কক্ষে দেশী বিদেশীদের এক মতবিনিময় সভায় (১৪.০২.২০১৭) অংশ নিয়ে খুবই তৃপ্তির কথা জেনেছি। গেজেটে প্রকাশ যে, দীর্ঘ ৪৪ বছর পূর্বে অনানুষ্ঠানিকভাবে গণশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ হলেও বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই ২৩ আগষ্ট ২০১৬ তারিখে ‘উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। যা বঙ্গবন্ধুর ২০ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ দিনটি দেশ গড়ার ডাকের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এভাবেই মুুক্ত স্বাধীন দেশ গড়ার গণশিক্ষা আন্দোলন তথা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম ডাক ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশ ও দুনিয়ায়।

বঙ্গবন্ধু রামগতি আসবেন। চর বাদাম ইউনিয়নে বাগ্যারদোনা যা পোড়াগাছা নামে পরিচিত। (১) এখানে বঙ্গবন্ধু জনসভা করবেন, দেশ গড়ার ডাক দিবেন এবং স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে নিজে ওড়া-কোদাল হাতে মাটি কাটবেন। আড়াই কিলোমিটার চর-কাঁদা-হালট বাঁধ দেয়া হবে। (২) একই সঙ্গে নিরক্ষরতা মুক্ত আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ঠিক হলো বঙ্গবন্ধুর আগমনের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সকালে যে যেদিক থেকে মিছিল করে যাবে, সকলের বুকে পিঠে কাগজে অ, আ, ক, খ; ১, ২, ৩ লেখা অক্ষর এঁটে দেয়া হবে। এতো আলপিন গ্রামে কোথায় পাবো? তাই ঠিক হলো সুঁই সুতা দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হবে।

এখন ঘন ঘন ঘরবাড়ী, গাছগাছালি, ফসল, স্কুল মাদ্রাসা লোকালয় ঘেরা ‘শেখের কিল্লা’ যেন কালের সাক্ষী হয়ে তাকিয়ে আছে সব সৃষ্টির দিকে। আর শেখের কিল্লাটি কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছে, ‘তোমরা আমাকে ভুলিয়ে দিচ্ছ জগৎবাসীর কাছে, যে এখান থেকে বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন, ‘নিজের পায়ে দাড়াতে হবে, স্বনির্ভর হতে হবে। মাথা উঁচু করে জানান দিতে হবে যে আমরাই পারি’। জানা যায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধুর দেশ গড়ার ডাক এর স্থানে ‘ডরপ’র আবেদনের প্রেক্ষিতে ‘শেখের কিল্লা মা-স্বপ্ন কমপ্লেক্স’ নির্মাণের প্রক্রিয়ায় গবেষণাসহ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। দেশের ইতিহাস রক্ষার্থে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতির নদী সৈকত পর্যটন কেন্দ্রসহ আমরা এর বাস্তবায়ন কামনা করি।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বর্তমান উন্নয়ন ধারায় এসডিজি বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত আমরা উন্নয়ন’র তলরেখা চিহ্নিত করতে পেরেছি কি ? যুগ যুগ ধরে আকাশের তারা গুণে শেষ করা যাবে ? না। অবশ্যই আমাদের একটা সীমানা থেকেই এগুতে হবে। এবং তা অবশ্য আমরা এখন পেয়ে গেছি। তা হলো ‘মা’। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রাপ্ত দরিদ্র মা’দের জন্য স্বপ্ন প্যাকেজ’র আওতায় উর্ধে ২ শিশুকে জন্ম পরবর্তী থেকেই আন্তঃমন্ত্রণালয় অনুমোদিত, ‘শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বিনোদন কার্ড’ হস্তান্তর করছে। যাতে শিশুরা স্কুলে যায় না, ঝড়ে পড়ছে এসব কথা আর না থাকে। মাটি-মানুষ-মালিকানায় ‘মা’-‘সন্তান’র দায়িত্ব নিচ্ছে এর চেয়ে বড় তারা আর আর কি হতে পারে ? এবং তা-ই স্বাভাবিক। সরকারের এ শিক্ষা কার্ড যোগ এ ধারাবাহিকতায় আশা করা যায় এসডিজি’র ১ নং এজেন্ডা ‘দারিদ্র্য নিরসন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, কর্মসংস্থানসহ মা কেন্দ্রিক ‘একের ভেতর সতেরো’ এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক প্রজন্ম মেয়াদে সাম্যতা ও ন্যায্যতার বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মানের ভীত তৈরী হবে।

স্বাধীনতার পর বিজয়ের বেশে আরো অনেক বেসরকারী উদ্যোগই দেশে সাড়া যুগিয়েছে। ব্রাক দিরাই-সাল্লাতে, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি এডুকেশন (বেইস), কুমিল্লার শাহরাস্তিতে, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, রাঙ্গুনিয়া, কাঠালিয়া, রামগতি, পাঁচবিবি, সাদুল্লাপুর, রৌমারীতে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আনসার ভিডিপি, সাভারে ভিইআরসি, বার্ড, র্ডপ বাঁশখালীতে, ঢাকা আহছানিয়া মিশন, এফআইভিডিবি সিলেটে, বর্তমানে নেটওয়ার্কিং এ একটিভ গণসাক্ষরতা অভিযানসহ আরো অনেক স্থানীয় ও জাতীয় উদ্যোগ বিভিন্ন নামে ও ধাঁচে বিদ্যমান। দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম ঠাকুরগাঁ’র কচুবাড়ী কৃষ্টপুর। প্রথম নিরক্ষরমুক্ত ইউনিয়ন চট্রগ্রামের রাঙ্গুনিয়া। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সরকারীভাবে পরে ৯০ দশকে গঠিত এনএফইপি শুরু হয়ে আজ একুনে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো নামে টেকসইতায় আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সরকার – গণশিক্ষা আন্দোলন ও পাশাপাশি দাতাদের পয়সায় গণশিক্ষা প্রকল্প সংমিশ্রনের ফসল আজকের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো। রাজনৈতিক কঠোর সিদ্ধান্ত না থাকলে দূর্নীতি ও ঘুষের প্রতিযোগিতায় আবারো ‘টোটাল লস মানি’ আখড়ায় থুবড়ী খাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ লুণ্ঠিত হবে।

গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘ভুঁইফোঁড় এনজিওর কবলে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা : এ প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন এনজিও কাজ পেয়েছে টাকার বিনিময়ে —’ কিন্তু ঋণের টাকার এ প্রকল্প কার ছোবলে, কার আঁচড়ে, কারা কি হারে, কত ধাপে টাকা নিল সে কথা বলা নেই। বর্তমানে ৬৪ জেলায় মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প কাজ চলছে তাও টাকার বিনিময়ে হচ্ছে কিনা তার উত্তরও একইভাবে পত্রিকার শিরোনাম যাতে না হয়, – দেশ প্রেমিক শিক্ষাণুরাগীরা তাই কামনা করে।

 

এএইচএম নোমান, প্রতিষ্ঠাতা ডরপ এবং গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী-২০১৩।
nouman@dorpbd.org

Print Friendly

Related Posts