মধ্যপ্রাচ্যে মুক্তারা কেমন আছে

এএইচএম নোমান

বাম পাশে রাজিয়া বেগম ডান পাশে মুক্তা আকতার মাঝখানে আমি। দুবাই পর্যন্ত ৩ ঘন্টা ২০ মিনিটের আকাশ জার্নি। মুক্তাকে জানতে চেষ্টা করলাম। মদিনায় তার ভাষায় সে হাসপাতালে কাজ করে। হেরেম শরীফের পাশেই, তার সাথীরা সৌদিই বেশী। রীতিমত হেরেম শরীফে নামাজ আদায় করতে পারত কিন্তু অনুমতি নাই হেতু মক্কায় হজ্ব করতে যেতে পারে নাই।

দেখতে মনে হলো ভাল লেখা পড়া জানে। তবে লেখাপড়া এসএসসি পাশ করেনি বলেছে প্লেনের মধ্যে এক ফাঁকে। এক হাজার রিয়েল (২২ হাজার টাকা) বেতনে ২ বছরের চুক্তিতে এসেছিল। ৩ মাস আগেই চলে যাচ্ছে। হঠাৎই। আবার ফ্রী ভিসায় আসবে আশায়। তার স্বামীও সৌদি কিন্তু কোথায় থাকে যায়গার নাম বলতে পারল না। বাড়ীতে ৪/৫ বছরের একটি মেয়ে ওর মা’র সাথে থাকে। বাড়ী মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর। হেমায়েতপুর থেকে ২০-২৫ মিনিটের পথ বাড়ী পৌঁছাতে। তিন মাসের বেতন কফিল দেয় নাই। তাই কফিলের সাথে বনিবনা না হওয়ায় আগেই চলে এসেছে। অবশ্য কফিল আসার সময় তাঁর ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছেন, ‘আবার আস, আসতে চাইলে ফোন করে জানালে, তোমার মা’র সঙ্গে কথা বলব ভিসা পাঠিয়ে দিব’। ভাবলাম এভাবে সকল প্রবাসীইত দূত এর কাজ করে থাকে, নিজ ও দেশ মাতৃকার জন্য।

কফিল কেমন প্রশ্নে বল্ল এক বউ ৪ বাচ্চা। ওঁদের সঙ্গে দূরে অন্য শহরে ওরও যেতে হতো। কফিলটা কেমন ? ভাল না, মোটা, অনেক মোটা, বেটেও। বল্লাম তোমার অসুবিধা কি, ওকে বশে নিতে পারলেইত ভাল করতে পারতে, আমাদের দেশে এক সৌদি জামাই পেতাম। না, ঐ দেশে অন্য দেশের মেয়েদের বিয়ের আইন নাই। যেমনিই হোক মিলমিশ করে থাকতা ? না ওরা ভাল না, তবে ওর বৌ ছেলে মেয়ে আমাকে ভালই জানত, আরবীতেই এখন কথা বার্তা বলতে পারি।

দেখতে ছিমছাম, প্রথমে মুখ ঢাকা বোরখা পড়া অবস্থায়ই ছিল। পরে প্লেনে খাওয়ার সময় মুখের কাপড় খুলে নিয়েছে। ফর্সা, চটপটে পাতলা গড়ন চিকন। বল্লাম সৌদিতে এত খানা পিনা মোটা হলেন না কেন ? বোরখার হাতা টেনে কব্জি পর্যন্ত হাত দেখিয়ে বল্ল, না বাড়ী থেকে যেমন গিয়েছি তেমনিই আছি, মোটা হতেও চাইনি, হইনি। রাত প্রায়ই সজাগ থাকতাম। ফজর বাদ দুপুর পর্যন্ত যত ঘুম।

অনায়াসে অনবরত দৈনন্দিন জীবন যাত্রার কথা বলতেছিল, ফাঁকে ফাঁকে স্মার্ট ফোনে টিপাটিপি করে কি লিখে বা দেখে তত বুঝলাম না। এক পাশে আমার বেগম সাহেবা, তা-ই কিছুটা সতর্কও থাকতে হয়েছে। বেমালুম বেফাঁস কোন কথা হয়ে যায় কিনা ? ওমরাহ হজ্জ্ব শেষে এয়ারএ বোর্ডিং কার্ড মতে সিটে বসে গেলে বেগম সাহেবাকে বল্লাম তুমি না হয় মাঝখানে বস, আমি এক সাইডে যাই, বল্ল না থাক যেভাবে আছে, মেয়েটা জানালার পাশেই থাক দেখতে পারবে। তবে আমার ভেতরে একটাই উশখুশ ছিল যে মধ্যপ্রাচ্যে বা সৌদিতে আমাদের দেশের নারীরা বিশেষ করে শ্রমিক নারীদের, ভীনদের সাথে ভেতরগত আচরণ ব্যবহার চলন বলন নিজকে রক্ষা করে চলার পরিমাপ করা যায় কিনা ?

জার্নির এক পর্যায়ে কফিল (মালিক) প্রসঙ্গ আবার তুলে বল্লাম, কি যে করলেন প্রায় দুবছরের মধ্যে ২/১ বারও বুঝি সে কিছু করতে পারল না, চান্স নিল না, না আপনি চান্স দিলেন না ? বলে উঠল, ‘নাউজু বিল্লাহ, নাউজু বিল্লাহ’। সোজা সাপ্টা চমকা উত্তরে ভালই লাগল যে, তাহলে তারা নিজকে রক্ষা করে এগিয়ে যেতে ঠিকই পারছে। যদিও অনেক ঘটনা রটনাত আছেই। তারপরও আমরা সন্দেহ প্রবণ মানবজাতি কোন মতেই সন্দেহ থেকে বের হতে পারি না। আল্লাহ মাফ করুক। তার মেয়ের জন্য মদিনা এয়ার পোর্ট থেকে বিশাল ২টা ট্যাং অনেক চকলেট আরো কত কি নিল। ওজন ও বহন সামলাতে পারতেছে না। আমাদের কে কয়েকবার অসহায়তার কথা বলছিল।

শেষ পর্যন্ত প্লেন থেকে নামার সময় আমার কেবিন ট্রলিতে ওর একটা ভারী ব্যাগ নিলাম। এমিরাটে দুবাই পরবর্তি বাংলাদেশে পৌঁছার গেইট পর্যন্ত তা টানতে হয়েছে, কষ্ট কম হয়নি। আমার বেগম সাহেবারও সহযোগীতার দৃষ্টি ছিল। কিন্তু ৭২ উর্দ্ধ বয়স্বী আমার কষ্ট হয় তাও বার বার সাবধান করতেছিল। এ ফাঁকে ওর আরো ২ পরিচিত নারী সাথী পেয়ে খুব চঞ্চল হয়ে উঠল। তারাও দেখলাম দূর্দান্ত! উচ্ছলতা ও বাঁধ ভাঙ্গা খুশীর তাড়নায় ট্রলি টানার এক পর্যায়ে মাঝে থাকা আমার ডাক্তার বেগম সাহেবার পায়ের গোড়ালিতে এমন লেগেছে যে প্রায় রক্ত ঝড়ে। তাড়াতাড়ি ও দুবাই শপিং এরিয়ায় ফাষ্ট ফুড দোকান থেকে বরফ নিয়ে দিয়ে কোন মতে উদ্ধার।

ওয়েটিং সিটে পাশাপাশি বসা অবস্থায় দেখলাম দুবাই এয়ারপোর্টে মহিলা ওয়াশ রুম পরিচ্ছন্নতায় কর্মরত প্রত্যয়ী এক নারী কর্মীও তাদের সঙ্গে কেনা-কাটা বিষয় গল্প করছে। উল্টো দিকের পুরুষ টয়লেটের কর্মীও দেখলাম বাংলাদেশী। উভয়ের চেহারা চোখে সহযোগীতার ছাপ। দুবাই এয়ারপোর্টেও মনে হয় কিছু কেনাকেটা সবাই মিলে করেছে। এখানে বোর্ডিং পাস সীট একসঙ্গে না থাকায় আর মিট হয় নাই।

ঢাকা ইম্রিগ্রেশানে পাশের ভিন্ন লাইনে দেখলাম মুক্তা তাকিয়ে খুব হাসছিল, খুশী, বাড়ী যাবে। ২৫ এপ্রিল ২০১৯ইং দুবাই বসেই ফোনে ভাইকে সকাল ৭ টার মধ্যে যেন ঢাকা এয়ারপোর্টে আসে সাহেবী (?) অধিকারী কায়দায় বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। একটু হেঁটে ওর লাইনে গিয়ে আমার মোবাইল নাম্বারটা চাইলে, বুঝলাম নাম জিজ্ঞেস করেছে। বানান করে বলেছি নোমান। লিখতে সঠিক পারল কিনা জানিনা। তবুও ইচ্ছা আরো জানার। কেমন থাকে আছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী বাংলার মুক্তারা। ‘নাউজুবিল্লার অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আমাদের সকলকে বাঁচান’র সংখ্যা আরো বাড়ুক, কামনা করি। আল্লাহর দান ‘মা’ জাতের নারীরা দূর্দমনীয় হয়ে সমতালে এগিয়ে যাক। বৈষম্য সৃষ্টিকারী ও নির্যাতনকারীদের মুখে চুন কালি পড়ুক। আলহামদুলিল্লাহ।

এএইচএম নোমান: প্রতিষ্ঠাতা ডরপ এবং গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী -২০১৩।
nouman@dorpbd.org

Print Friendly

Related Posts