আপনাকে বলছি…

জুঁই জেসমিন

বলতে পারেন, এই প্রযুক্তির গর্ভে জীবনের শক্তি রোজ কোন্ জিনিসটা শুষে নিচ্ছে? ফুরফুরে মন ক্লান্তিতে ভরে তোলে জগতের কোন বৃহৎ বিনোদন? আপনার ও আপনার সন্তানের সজীব নির্জাস গ্রাস করে প্রতিনিয়ত যার নাম ম্যাসেঞ্জার,ইমো, ভাইভার, টুইটার, হোয়াটস এপস! হ্যাঁ একদম তাই। সমাজে অনেক উচ্চ শিক্ষিত নারী পুরুষ আছেন যা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে জানেন না। নিজের নাম করে ফোন ক্রয় করে সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন । না পারেন নাম্বার সেভ করতে না পারেন কল লিস্ট বের করে ঝটপটে কাউকে ফোন দিতে, প্রজা বা ভিক্ষুকের মতো সন্তানের পড়ার রুমে ঢুকে তোষামোদ করেন নিজ প্রয়োজনে।

স্কুল পড়ুয়া আশিভাগ ছাত্রছাত্রীর হাতে ফোন, কেউ ফেসবুক পাগল, কেউ রকমারি গেমে পাগল, কেউ ইউটিউবে এটাসেটা দেখা নিয়ে পাগল, কেউ গ্যাং কালচার গ্রুপে সংযোগ হয়ে অপকর্মে ব্যস্ত। অষ্টম হতে একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীর বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী ম্যাসেঞ্জারে চেটিং নিয়ে ব্যস্ত, কখন রাত গেল আর দিন গেলো বুঝতে পারেনা। সকাল বেলা ঘুমে টলতে টলতে স্কুল বা কোচিং এ যাওয়া হয়! আর শিশুদের খেলার আসর মানে ভিডিও গেম,আর কার্টুন দেখা। নিজের আরাম আয়েসের জন্য শিশুর হাতে দেওয়া হচ্ছে রোজ স্মার্ট ফোন। কতটুকু আপনার শিশু সুস্থ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী?

স্মার্ট ফোন এমন একটি মাধ্যম যার মাঝে নরক ও স্বর্গ দুটোই বিরাজমান। এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে বেশিরভাগ অপকর্মের অস্ত্র হিসেবে, ভাল কাজে নয়। যার কারণে এতো খুন, এতো ধর্ষণ এতো ভয়ংকর ঘটনা সমাজে। স্কুল পড়ুয়া বা কলেজ পড়ুয়া অসংখ্য ছাত্রী প্রতিবছর আত্মহত্যা করে প্রাণ হারাচ্ছে! যার কারণ গুলো চিহ্নিত করে সতর্ক করা হচ্ছেনা আদৌ। না সতর্ক না সচেতন কোনোটাই যথাযথ না। বারো হতে বাইশ বছর এ সময়টা সমুদ্র আবেগে ভাসতে থাকে ছেলে মেয়েরা। কারণে অকারণে মরণ আবেগ তাড়া করে, জীবনের কিছু ভুল কিছু অভিমানে মৃত্যুর পথ বেছে নেয়।

এ যুগের বড় ভুল- হাতে হাতে ফোন মানে হাতে হাতে ক্যামেরা, আর প্রেম মানেই ছবি দেনা পাওনার খেলা। অবুঝ মনে প্রেমো দোলায় প্রেমিকের শত আবদারে গলে যায় মন, শত শত বালিকা দিয়ে ফেলে দেহের গোপন ছবি। অনেক ছেলে তা বন্ধুদের মিলে বেশ মজা নিয়ে দেখে কিংবা ইন্টারনেটে দেয় ছেড়ে, শুধু তাই নয়, বার বার দেখা করা বা খারাপ কাজ করার জন্য দেওয়া হয় হুমকী- এই ভুল গুলো থেকে সমাধানের পথ না পেয়ে আত্মহত্যা করে অনেক ছাত্রী। স্বপ্নের জগত, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ক্রীড়া, দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে। বাবা মায়ের গড়পড়তা স্বপ্নের দৌড়, সন্তানের এ প্লাস অর্জন।

পাঠ্যপুস্তকে প্রকৃত মেধা বন্দি, প্রতিভা বিকাশের সুযোগ নেই! নেই কোনো স্বপ্ন দেখার নিজেকে আবিষ্কার করার। খেলাধুলা, ব্যায়ামের প্রয়োজন যেন অপ্রয়োজন হয়ে যাচ্ছে মানব জীবন থেকে। শিশু হতে সকল বয়সীকে ডায়াবেটিস করছে আক্রমণ, অনিয়ম খাওয়া দাওয়া চলাফেরার কারণে । সারা দেশে সকাল বিকালের ব্যায়ামবীর এখন ডায়াবেটিস রোগী, সুস্থ থাকতে দৌড় নেই আর অসুস্থ হয়ে চলে দৌড়ের লড়াই। এ যুগের ছোটোবড়ো সকলের বৃহৎ বিনোদন স্মার্ট ফোন। স্কুল আর কোচিং থেকে ফিরেই ফোনের সাথে মিতালী ছাত্রছাত্রীদের। এখন প্রশ্ন, এক স্কুল হতে মোট পরীক্ষার্থী কতজন? আর কতজন বা তাদের মধ্যে এ প্লাস অর্জন করে? হাজার বা শো এর মধ্যে নিশ্চয় গুটি কয়েক। আর বাকি ছাত্রছাত্রীরা নানাবিধ কারণে ভাল ফলাফল করতে পারেনা , পারেনা তাদের মৌলিক মেধা প্রতিভা বিকাশ করতে। বড় কারণ স্মার্ট ফোন। বাবা মায়েরা হয়তো ভাবছেন, সন্তানকে তো ফোন কিনে দেওয়া হয়নি। তবে ঘরের ফোনটা সারাক্ষণ কার হাতে? নিশ্চয় স্কুল পড়ুয়া সন্তানের হাতে?

অনেক শিক্ষিত বাবা মা, তারা দোকানে অফিসে, বা কোনো প্রোগ্রামে একফালি দাঁত বের করে হেসে হেসে বলেন, ওসব ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার বুঝিনা, চালাতে তো পারিনা, সব আমার ছেলেটা বা মেয়েটাই করে! তারা আমার আইডিটা চালায়- আর আমাকে দেখায়! কত লাইক পড়লো কে কে কমেন্ট করলো স্ট্যাটাস বা ছবিতে? ” এই এক ফালি হাসি আগামী দিনের বৈশাখী ঝড়, ভাল কাজ বা ভাল মানুষীর আভাস নয়! অনেক মা আছেন, পড়ালেখা খুব একটা জানা না। বাবা বাইরে চাকুরী করে ঘরে এক দামী ফোন দেওয়া হয় সব সময় যোগাযোগের জন্য। আর সেই ফোনটার টিপাটিপির মালিক ঘরের ছেলে বা মেয়েটিই।এই ফোন এমন ভাবে এক এক জনের মেধা গ্রাস করে যা ধারণার বাইরে। সব কিছুতেই অনিয়ম হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা, না ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়া, না ঠিক সময়ে ঘুম। না স্নিগ্ধ বিকেলে হাটাচলা,খেলাধুলা।

ঘরে একটি ফোন থাকা মানে স্বর্গ পাওয়া। আপনারা ভেবে দেখুন আপনার সন্তান কতটুকু সুস্থ? কেন মাসে দু চারবার ডাক্তারের চেম্বারে ছুটোছুটি করেন সন্তানকে নিয়ে? কেন এই বয়সে আপনার সন্তানের শরীরে রক্তের ঘাটতি?কেন চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা? আপনার সন্তান কি মহা কিছু আবিষ্কার করতে চলেছে ‘জন লোগি বেয়ার্ড’ বা মার্টিন কুপারের মতো? যার কারণে চোখ বা শরীরের এই হাল, উত্তর দিন-?

জন লগি বেয়ার্ড টেলিভিশন আবিষ্কার করতে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে, হাত মোজা পা মোজা তৈরি করে বাজারে বাজারে বিক্রি করেছেন, করেছেন চাটনি বিক্রি। ভাবুন তবে স্বপ্নটা ছিলো কত অনন্য, লড়াইটা ছিলো কত সাংঘাতিক। মুঠো ফোনের আবিষ্কারক মার্টিন কুপারকে ক’জন স্মরণ অনুসরণ করি? অথচ হাতে হাতে মুঠোফোন আমাদের। এ যুগে যা প্রত্যেকের শ্রেষ্ঠ বন্ধু এবং অনেক কাছের প্রিয় সঙ্গী যার নাম স্মার্ট ফোন। যার সুফলটা ফেলে কুফলটা নিয়ে আনন্দ উল্লাসে ধ্বংসের সাথে মেতে উঠেছি অনেকে- ভাল মন্দ ভাবার সময় নেই যেন কারো। শুধু কি ফরমালিন যুক্ত কেমিকেল খাবার খেয়ে আপনার সন্তান অসুস্থ, বা আমরা অসুস্থ? নাকি এই অসুস্থতার পিছনে বৃহৎ কারণ এই স্মার্ট ফোন?

এই ফোনের ব্যবহার তো শুধু বিশেষ প্রয়োজনে। যেখানে দশ মিনিট কথা বললে মস্তিকের মারাত্মক ক্ষতি সেখানে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বিশঘণ্টায় ফোনের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি। সেলফি তোলা সব ছেলে মেয়ের বড় নেশা, কিন্তু এই সেলফি চোখ ও মস্তিষ্ক দূর্বল করে তোলে, মাইগ্রেনের সমস্যা দেখা দেয়। ব্রেইন ক্যান্সার ব্রেইন টিউমার থেকে নানান ভয়ংকর রোগ সৃষ্টি হয় অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারকারীদের।

সুস্থ থাকবেন কী করে? এই ফোন, আত্মীয় স্বজন বাবা মা সবার প্রতি থেকে আন্তরিকতা কেড়ে নিচ্ছে দিন দিন। ছেলে পাশে থেকেও নেই, মেয়ে পাশে থেকেও নেই যেন ! মন ভাবনা ফোনের জগতে, চার্জ ফুরিয়ে গেছে চার্জে দিয়েও চেটিং বা কথা বলা,,, বার বার ডাকা সত্তেও ছেলেমেয়ের সাড়া নেই! আজ ক্লাস সেভেন পড়ুয়া ছেলের বিশ হতে পঁচিশটা এফবি আইডি, ভাবুন তবে –! আমার বোনের ছেলেমেয়ে ও ভাইয়ের ছেলেমেয়ে , যারা একসময় আমাকে কাছে পেলে খুশিতে নেচে উঠতো। তাদের বাড়িতে গেলে যেন খুশির শেষ থাকতো না ! বানিয়ে বানিয়ে কত রূপকথার গল্প শুনাতে হয়েছে তাদের, কতরকম মজার মজার খেলা খেলেছি! তারা যে এখন খুব একটা বড় হয়ে গেছে তা না। এখনো স্কুলে পড়ে। তারাও আসে আর আমিও যাই, কিন্তু তাদের আর আগের মতো পাইনা-! স্মার্ট ফোনে গেম খেলা, ছবি দেখা, গান শোনা নিয়ে ব্যস্ত, এতোটা কাছে গিয়েও কাছে পাচ্ছিনা অথচ এক বিছানায় ঘুমোচ্ছি, এক সাথেই খাচ্ছি। তারপরও দূরত্ব —!

প্রত্যেকের একটা সম্পর্কের জগত থাকে যা মায়ার বাঁধনে জড়ানো যার পূর্ণতালাভ আসে দেখা হওয়া কথা বলা।অথচ এই স্মার্ট ফোন পরিবার স্বজনকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে দিচ্ছে, এফ,বি বন্ধুদের যতটা সময় দেওয়া হচ্ছে বর্তমান সমাজে পরিবারগুলোতে তা একভাগ সময় দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয়না। বাবার হাতে ফোন মায়ের হাতে রিমোট , ছেলে মেয়ের হাতে স্মার্ট ফোন ব্যস্ত সবাই। প্রিয়জন হিসেবে সম্পর্ক নেই একে ওপরের মাঝে, সম্পর্ক যেন প্রয়োজন হিসেবে। ক্ষুধা পেলে খাবার চাওয়া, টাকা লাগলে টাকা চাওয়া এই শুধু কথোপকথন বাবা মা ভাই বোনের মধ্যে। এক একটি সুন্দর জীবন, একে অপরের সাথে সুসম্পর্ক, মায়া মমতা, দায়িত্ববোধ সব যেন ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে যাচ্ছে !

পরিত্রাণের উপায় কী? ছেলেমেয়েকে প্রচুর প্রচুর সময় দিন, তাদের সাথে খেলা করুন, আড্ডা দিন, গল্পে গল্পে বন্ধু হয়ে উঠুন, ফোনের প্রয়োজন যতটুকু ঠিক ততটুকুই ব্যবহার করুন। নিজেও সুস্থ থাকুন আর সন্তানকেও সুন্দর ও সুস্থ রাখুন।

 জুঁই জেসমিন
 লেখক ও মানবাধিকার কর্মী
 juijesmin2019@gmail.com

Print Friendly

Related Posts