ফারুক হোসেন: আমার ব্যাচমেট ও বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক

মামুন খলিলী
ফারুক হোসেন। আমার ব্যাচমেট ও বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক। সচিব হিসেবে অবসরে গিয়েছে। দীর্ঘ দিন সিপিটিইউ এর ডিজি ছিল। সর্বশেষ সচিব পদ মর্যাদায় জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছিল। সেখান থেকেই অবসরে গিয়েছে ফারুক।
ফারুক সিপিটিইউ এর ডিজি থাকার সময় আমি বেশ কয়েকবার ক্যাবিনেটে পারচেজ কমিটির সভায় গিয়েছি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে। পারচেজ কমিটির সকল সদস্য মন্ত্রী। একমাত্র টেকনোক্রেট সদস্য থাকেন সিপিটিইউ এর ডিজি। সব মন্ত্রীদের বক্তব্যের পর অর্থ মন্ত্রী আহবান করতেন ফারুককে তার মতামত দেয়ার জন্য। ফারুক ক্রয় প্রস্তাবটির চুলচেরা বিশ্লেষন করে পিপি আর এর আলোকে ক্রয় প্রস্তাবের সংগতি, অসংগতিগুলো তুলে ধরতো। মন্ত্রীরা যে যা’ই বলুক ফারুকের মতামতের উপরই ক্রয় প্রস্তাবটির ভাগ্য নির্ভর করতো। ফারুক ক্রয় প্রস্তাবটি সমর্থন না করলে সেটি আর পাশ হতোনা। ফারুককে কেউ প্রভাবিতও করতে পারতোনা। অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ ও আইনানুগ মতামতই দিতে দেখেছি ফারুককে। পারচেজ কমিটিতে ফারুকের প্রভাব ও গুরুত্ব দেখে ব্যাচমেট হিসেবে আমারও গর্বে বুকটা ফুলে উঠতো।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে আমরা একবার চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্যতার উপর একটি ফিজিভিলিটি স্টাডি করার জন্য একটি ক্রয় প্রস্তাব পারচেজ কমিটিতে পাঠিয়েছিলাম। প্রস্তাবটি যথারীতি মিটিং এ এজেন্ডাভুক্ত হয়েছে। মিটিং এর জন্য আমি মন্ত্রী, সচিবকে ফাইল বানিয়ে দিয়েছি। মিটিং এর আগের দিন আমাদের সচিব অশোক মাধব রায় আমাকে বললেন, তুমি একটু সিপিটিইউ এর ডিজি ফারুকের সাথে কথা বলে তার অবজারভেশনটা জেনে আমাকে জানাও। আমি ফারুকের সাথে কথা বললাম। ফারুক জানালো, তোমাদের ক্রয় প্রস্তাবটি ডিফেকটিভ। তোমরা যখন প্রথম টেন্ডারটা বাতিল করে রিটেন্ডার করেছ, তখন তোমরা নতুন করে ফার্ম শর্ট লিস্টিং করোনি। পুরানো শর্ট লিস্টেড ফার্মসমূহকে প্রস্তাব দিতে বলেছ। এটা পিপি আর সাপোর্ট করেনা। আমি সচিব মহোদয়কে ফারুকের অভিমত জানালাম। সচিব তখন মন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে পারচেজ কমিটি থেকে ক্রয় প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সচিব মহোদয় জানতেন, ফারুকের নেতিবাচক মতামতের পর ক্রয় প্রস্তাবটি আর পাশ হবেনা।
ফারুক দীর্ঘ দিন সিপিটিইউতে কাজ করার ফলে সরকারী প্রকিউরমেন্ট সম্পর্কে দেশ সেরা একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। আমি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে থাকতে যখনই সংস্থা থেকে ক্রয় প্রস্তাব পেয়েছি ফারুকের সাথে আলোচনা করে নিয়েছি। ফারুক তার শত ব্যস্ততার মধ্য থেকেও আমার সাথে কথা বলেছে, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছে। যখনই কথা বলেছি, তাৎক্ষনিকভাবে মুখস্থ বলে দিয়েছে, পিপি আরের অমুক ধারা অনুযায়ী এই বিষয়ে বিধান এই রকম। পিপিআর সম্পর্কে এই রকম গভীর জ্ঞান রাখে আমি ফারুক ছাড়া দ্বিতীয় আর কাউকে দেখিনি। ফারুক ছিল ন্যাশনাল ট্রেইনার অফ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট, Chartered Institute of Procurement and Supply(CIPS) এর Resource person, President of South Asia for Public Procurement Network in 2015.
আমি একবার বাংলাদেশে পিপিপি প্রকল্পসমূহের সমস্যা এবং সম্ভাবনার উপর হোটেল সোনারগাঁয়ে অনুষ্টিত এক সেমিনারে অংশগ্রহন করেছিলাম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান মন্ত্রীর তদানীন্তন মুখ্য সচিব জনাব আবুল কালাম আজাদ সাহেব। অনুষ্ঠানে কী নোট পেপার প্রেজেন্টেশন করেছিলেন পিপিপির তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব ডঃ সাইদ উদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠানে সব মিনিস্ট্রি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার পদস্থ অফিসাররা উপস্থিত ছিলেন। ডঃ সাইদ উদ্দিনের কী নোট পেপার উপস্থাপনের পর ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। ডঃ সাইদ উদ্দিন বৃটেনে সরকারী চাকরি ছেড়ে এসে পিপিপি অফিসে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি যথেষ্ট প্রফেশনাল, খুব ভাল উপস্থাপন করেছিলেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রশ্ন করতে গিয়ে ফারুক প্রায় পনের মিনিট ধরে যে বক্তব্য দিয়েছিল বাংলাদেশের পিপিপি প্রজেক্ট সম্পর্কে, তা’ ডঃ সাইদ উদ্দিনের উপস্থাপনাকে ম্লান করে দিয়েছিল, ফারুকের অসাধারন উপস্থাপনা, গভীর জ্ঞান ও বাচন শৈলীর কারনে।
ফারুককে যখন সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে পোস্টিং দেয়া হয়েছিল, আমি কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম। তাকে যদি জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিবর্তে সচিব পদ মর্যাদায় সিপিটিইউতে অথবা আইএমইডিতেও রাখা যেত, তাহলে দেশের সরকারী ক্রয়ে আইন ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় ফারুক ভূমিকা রাখতে পারতো। এতে সরকারই লাভবান হতো।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটি নতুন প্রতিষ্ঠান। ফারুকই এর প্রথম চেয়ারম্যান। সেই হিসেবে ফারুক প্রতিষ্ঠানটির কাজ-কর্ম গুছিয়ে নিয়ে এসেছিল, প্রতিষ্ঠানটিকে একটি ভিত্তি দিয়েছিল ফারুক। কিন্তু এর মধ্যেই ফারুকের পি আরএল এসে গেল। প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আর তার হলোনা। সরকারী মহলে ফারুকের যথাযথ মুল্যায়ন না হলেও বিশ্ব ব্যাংক ফারুকের সরকারী চাকরি থেকে অবসরের সাথে সাথেই বিশাল বেতনে ফারুককে লুফে নিয়েছে তাদের প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে।
ফারুক দীর্ঘদিন ইন্টারন্যাশনাল জুট অরগ্যানাইজেশনে লিয়েনে চাকরি করেছে। লিয়েন শেষে সে জয়েন করলো অর্থ মন্ত্রণালয়ে। তখন ফারুক আর মুসলিম চৌধুরীকে দেখতাম অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরীর কাজে মহাব্যস্ত। এরমধ্যে একদিন শুনলাম ফারুক পাবলিক প্রকিউরমেন্টের উপর মাস্টার্স করতে ইটালীর তুরিন যাচ্ছে। এক বছর পর তুরিন থেকে এসে সে জয়েন করে সিপিটিইউএর ডিজি হিসেবে। এরপর বাকীটুকু ইতিহাস।
ফারুকের সাথে আমার প্রায় চল্লিশ বছরের সম্পর্ক। ফারুক আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক হলে থাকতাম সেই ১৯৭৯ সাল থেকেই। আমরা ফজলুল হক হলে সুখে-দুখে এক সাথে কাটিয়ে ছিলাম প্রায় ছয় বছর। তাকে প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল স্কুল বালক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে চাকরিতে ঢুকার পরও তাকে সেই রকম স্কুল বালকই মনে হতো। এমনকি চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরও তাকে এখনো স্কুল বালকই মনে হয়।
ফারুক চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে, এটা আমার বিশ্বাস হয়না। মনে হয় ফারুকের এখনো রিটায়ার করার বয়স হয়নি। ফারুক যখন গত ফেব্রুয়ারীতে পি আরএলে গেল, আমার বিশ্বাস হয়নি। ফারুকের মতো একজন প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞকে সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেবেনা, সেটাও আমার বিশ্বাস হয়নি। তাই তাকে আমি তখন কভি আল বিদা না কেহনা বলিনি। বিশ্ব ব্যাংককে ফারুক জয়েন করার পর এখন আমার মনে হচ্ছে তাকে আল বিদা দেয়া যায়।
ফারুক সাবেক সচিবালয় ক্যাডারের অফিসার। আমরা একসাথে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করেছিলাম। ফারুক ছিল তখন হোম মিনিস্ট্রির সহকারী সচিব। ফাউন্ডেশন ট্রেনিং এর কিছুদিন পর ফারুকরা দেখলাম আন্দোলন করছে সচিবালয়ে, সচিবালয় ক্যাডার বিলুপ্ত করার জন্য। একদিন ইত্তেফাকের পেছনের পাতায় দেখি প্লে-কার্ড হাতে ফারুকের ছবি। সচিবালয়ে মিছিল করে এগিয়ে যাচ্ছে সচিবালয় ক্যাডারের অফিসাররা। মিছিলের অগ্রভাগে ফারুক, ব্যানারে লেখা, সচিবালয় ক্যাডার বিলুপ্ত করে দাও। আমি ফারুককে বললাম, তোমরা কেন সচিবালয় ক্যাডার বিলুপ্ত করতে চাও? আমরাতো মাঠ প্রশাসন থেকে সচিবালয়ে বদলী হয়ে আসতে চাচ্ছি। ফারুক বললো, আসলে সচিবালয় ক্যাডার একটি পঙ্গু ক্যাডার। এই ক্যাডারের ক্যাডার কম্পোজিশনে যুগ্ম সচিবের উপরে কোন পোস্ট নেই। আমাদের সচিব হওয়ার কোন সুযোগ নেই। এ’ছাড়া প্রত্যেক ক্যাডারের কাজের নির্দিষ্ট জুরিসডিকশন আছে। সচিবালয় ক্যাডারের কোন অরিজিনাল জুরিসডিকশন নেই। এর কিছুদিন পর দেখলাম সচিবালয় ক্যাডার প্রশাসন ক্যাডারের সাথে একীভূত হয়ে গেছে। এই চান্সে আমি হবিগঞ্জের বাহুবল থেকে বদলী হয়ে সচিবালয়ে ঢুকে পড়লাম। সেদিন যদি ফারুকরা আন্দোলন করে প্রশাসন ক্যাডারের সাথে একীভূত না হতো, তাহলে আসাদ, সামাদ, আফরাজা খান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, রকিব ও ফারুকরা সচিব হতে পারতোনা।
ফারুক দেশের খ্যাতনামা ছড়াকারদের একজন। ফারুককে আমরা ফজলুল হক হলে থাকতেই ছড়াকার ফারুক বলতাম। আবার কেউ কেউ বলতো কবি ফারুক। তখন থেকেই সে দেশের জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যের পাতায় ছড়া লিখে বিখ্যাত। এখনো সে প্রতিদিন করোনার উপর ছড়া লিখে পত্রিকার সাহিত্য পাতা ভরে ফেলছে।
ফারুক আমলা হিসেবে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছে। ও যদি আমলা না’ও হতো তাহলে লেখক হিসেবে, বুদ্ধিজীবি হিসেবে দেশের শীর্ষস্থানীয়দের একজন হতো। ফারুকের সাহিত্য কর্ম শুধু ছড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। অসংখ্য ছড়ার বই ছাড়াও তার অনেকগুলো গল্পের বই, ভ্রমন কাহিনীও বের হয়েছে। সব মিলিয়ে তার গ্রন্থ সংখ্যা ৬০ এরও বেশী হবে। প্রতি বছরই বইমেলায় ফারুকের বই বের হয়। এ’ বছরের বইমেলায় ফারুকের চারটি বই বের হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে কাবা শরীফ, সাজানো কাজান, বিশ্ব দেখি ছন্দে ছন্দে ও মুজিব বাইয়া যাওরে। গত বছর বের হয়েছিল নীতিকথার গল্প। তার সবচাইতে জনপ্রিয় বই হচ্ছে ‘৮০০ ছড়া’।
সাভারের ব্র্যাক সিডিএম সেন্টারে অনুষ্ঠিত আমাদের ব্যাচের গত পিকনিকের কালচারাল পর্বে ফারুক একটা ভাওয়াইয়া গান গেয়েছিল। খুব দরাজ গলায় ফারুক গানটা গেয়েছিল। আমার তখন কেবলই মনে হচ্ছিল আমাদের ভাওয়াইয়া গানের মরমী শিল্পী আব্দুল আলিমের কথা। আব্দুল আলিমের পর এত দরাজ গলায় ভাওয়াইয়া গান গাইতে আমি আর কাউকে দেখিনি। ফারুকের গানের গলা যে এত ভাল আমি আগে জানতামনা।
ফারুক অবসরে চলে গেছে, কেন জানি আমি বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। ও বিশ্ব ব্যাংকে জয়েন করার পর এখনো আমার মনে হচ্ছে, ফারুক লিয়েনে বিশ্ব ব্যাংকে জয়েন করেছে। লিয়েন শেষে সে আবার সচিবালয়ে ফিরে আসবে। যেমন সে আইজেআরে দীর্ঘদিন লিয়েনে কাজ করার পর আবার সচিবালয়ে ফিরে এসেছিল।
ফারুকের অবসরোত্তর কর্মজীবন সাফল্যময় হোক- এ’ কামনা করছি।
মামুন খলিলী : সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা
Print Friendly

Related Posts