গ্রামে গ্রামে ঘুরে আর বই বিলি করবেন না পলান সরকার

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে ঘুরে সবার দোরগোড়ায় বই বিলির কারনে দেশব্যাপী পরিচিত একুশে পদকপ্রাপ্ত পলান সরকার।আজ শুক্রবার দুপুরে ৯৮ বছর বয়সে জেলার বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামের নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেছেনে (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)।

কেউ তাকে ডাকতেন ‘বইওয়ালা দাদুভাই’, কেউ আবার ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন পলান সরকার। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পলান সরকারের ইন্তেকালে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আজ এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী দেশে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তুলতে পলান সরকারের অবদানের কথা স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি ছাড়াও স্থানীয় রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতির সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পলান সরকারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

এক শোক বার্তায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী উল্লেখ করেন, পলান সরকারের মৃত্যুতে জাতি একজন বিশিষ্ট সমাজকর্মীকে হারালো। তিনি বলেন, পলান সরকার রাজশাহীর ২০টি গ্রামজুড়ে গড়ে তুলেছিলেন অভিনব শিক্ষা আন্দোলন এবং নিজের টাকায় বই কিনে পড়তে দিতেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। তাঁর অবদান রাজশাহীর মানুষসহ বাঙালি জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে বলেও উল্লেখ করেন শাহরিয়ার আলম।

নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পলান সরকার ২০১১ সালে একুশে পদক পান। পরে সরকারিভাবে পলান সরকারের বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেওয়া হয়।

২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বিশ্বের ভিন্ন ভাষার প্রধান প্রধান দৈনিকে একযোগে পলান সরকারের বই পড়ার এই আন্দোলনের গল্প ছাপা হয়। সারা দেশে তাঁকে বহু বার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। তাঁকে নিয়ে ‘সায়াহ্নে সূর্যোদয়’ নামে একটি নাটক তৈরি হয়েছে।

পলান সরকারের জন্ম ১৯২১ সালে। তাঁর আসল নাম হারেজ উদ্দিন। তবে মা ‘পলান’ নামে ডাকতেন।  পাঁচ বছর বয়সে বাবা হায়াত উল্লাহ সরকারকে হারান পলান। এরপর আর্থিক সংকটে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় চতুর্থ শ্রেণীতেই। পরে নানা ময়েন উদ্দিন সরকার মা মইফুন নেসাসহ পলান সরকারকে নিয়ে আসেন নিজ বাড়ি বাউসায়।তবে নিজের চেষ্টাতেই চালিয়ে যান পড়ালেখা।

সেখানকার স্কুলে ভর্তি হন পলান। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণীর পর ইতি টানেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। তবে থেকে যায় বই পড়ার অভ্যাস। প্রথমে এর ওর কাছ থেকে বই ধার করে এনে পড়তেন। যখন যে বই পেয়েছেন, সাগ্রহে পড়েছেন।

পলান সরকার বড় হন নানা বাড়িতে। নানা ময়েজ উদ্দিন সরকার ছিলেন স্থানীয় ছোট জমিদার। যৌবনে তিনি নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন। দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকরি পান। নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তিরও মালিক হন পলান।

ব্রিটিশ আমলে তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। অভিনয় করতেন ভাঁড়ের চরিত্রে। লোক হাসাতেন। যাত্রার পাণ্ডলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন। এভাবে বইপড়ার নেশা জেগে ওঠে তার।

১৯৬৫ সালে ৫২ শতাংশ জমি দান করে বাউসা হারুন অর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন পলান সরকার। ১৯৯০ সাল থেকে ওই বিদ্যালয়ে মেধাতালিকায় প্রথম ১০ স্থান অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের বই উপহার দিতেন তিনি।

এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরা বইয়ের আবদার করলে সিদ্ধান্ত নেন তাদেরও বই দেবেন। শর্ত দেন পড়ার পর তা ফেরৎ দেওয়ার। এরপর গ্রামের মানুষও তার কাছে বই চাইতে শুরু করেন। ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বইপড়া আন্দোলন। ১৯৯২ সালে ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত হন পলান সরকার। ওই সময় তিনি হাঁটার অভ্যাস করেন। এ থেকে বিদ্যালয়কেন্দ্রিক বই বিতরণ প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া শুরু করেন। পথে পথে ঘুরতে শুরু করেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার হয়ে।

পড়তে দেওয়ার জন্য বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি লেখকদের বইগুলো ছিল পলান সরকারের সবচেয়ে পছন্দের তালিকায়। তাছাড়া লোকসাহিত্যসহ অন্যান্য জনপ্রিয় লেখকের বইও তিনি বিতরণ করেন।

এভাবে চা দোকানি থেকে শুরু করে গৃহবধূ সবাই তার পাঠকের তালিকায় চলে আসেন। বদলে যায় দৃশ্যপট। নিজের গ্রামে তার বাড়ি হয়ে ওঠে পাঠাগার। তবে ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। দান-অনুদানে মিলে যায় বইসহ অন্যান্য আসবাব।

প্রথমে আশপাশের ১০ গ্রামের মানুষ কেবল জানতেন পলান সরকারের কীর্তি। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ তাকে তুলে আনে আলোকিত মানুষ হিসেবে। এরপর তিনি ২০১১ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন পলান সরকার।

২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার উপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয় নাটক, বিজ্ঞাপন চিত্র। শিক্ষা বিস্তারের অনন্য আন্দোলন গড়ে তোলায় ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে সাদা মনের মানুষ খেতাবে ভূষিত করে।

Print Friendly

Related Posts